এস এম মোজাম্মেল হক
মিডিয়া এখন প্রায় সব মানুষের নিকটই একটি পরিচিত শব্দ। মিডিয়া বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে, রেডিও টেলিভিশন সংবাদপত্র ফেসবুক টুইটার ও ইউটিউব। যদিও ইন্টারনেট সুবিধার কারণে ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বহুল অংশ দখল করে নিয়েছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কারণে একসময়ের বহুল প্রত্যাশিত টেলিফোন, যা ছিল কিনা সোনার হরিণ প্রাপ্তিসম, তা মোবাইল সেটের কারণে বহু দামি পাঙ্গাশ মাছ, যা কিনা হালে অতি সহজলভ্য, ঠিক তেমনি অতি সহজলভ্য হয়ে গেছে। তার ওপর কম মূল্যের অনেক সেটেও এখন ক্যামেরা সংযোজিত থাকার ফলে স্থিরচিত্র ও ভিডিও, ছবি তোলা ও প্রয়োজনে তার ব্যবহার অতিমাত্রায় সহজলভ্য হয়েছে। এ কারণে প্রচলিত গণমাধ্যমের সমান্তরাল হিসেবে সামাজিক মাধ্যমসমূহ ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, যেসব দেশে প্রচলিত সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন পক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের স্বার্থের পরিপন্থী এমন খবর, ছবি বা ভিডিও প্রকাশের ক্ষেত্রে বহু বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ার শঙ্কা থাকে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিধিনিষেধের কারণে নিজ থেকেও অনেক কর্তৃপক্ষ এমন সব নিরপেক্ষ সংবাদ, ছবি ও ভিডিও প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া স্বার্থের অনেক বিষয়ও এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে প্রচলিত সংবাদমাধ্যম কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যের নিরপেক্ষতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনাপূর্বক সঠিক তথ্যপ্রাপ্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্তমানে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে অনেকটা জায়গা করে নিতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্য ভূমিকা পালন করতেও সক্ষম হয়েছে।
রাষ্ট্রকে মনে করা হয় একটি জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান কিন্তু রাষ্ট্রের যদি তার সে অবস্থানচ্যুতি ঘটে, তাহলে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক তেমন নিবিড় হয় না। রাষ্ট্র ও জনগণ যেহেতু পরস্পর একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ, তাই এর কোনোটিকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য যেসব মৌলিক বিষয় নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, তার মধ্যে রয়েছে সার্বভৌম সত্ত্বা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সরকার, আইন ও বিচার বিভাগ; যা হওয়া প্রয়োজন স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তবেই রাষ্ট্র জনপ্রত্যাশার মূল আকর্ষণে পরিণত হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণ রাষ্ট্রের মূল আকর্ষণ। তাই রাষ্ট্র ও জনগণকে ঘিরেই রাষ্ট্রের বাকি প্রয়োজনীয় অঙ্গসমূহ, যেমন সরকার, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ আবর্তিত। কোনো রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগ যখন পরস্পর বিযুক্ত অবস্থায় না থেকে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ব্যক্তি, সংগঠন বা দলীয় আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের প্রধান আকর্ষণ জনগোষ্ঠী হয়ে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত এবং এক অংশ অন্য অংশের ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ। ফলে জনগণের পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্য হ্রাস পেয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের প্রতিপক্ষ না হয়ে শত্রুপক্ষে রূপান্তরিত হয়, যা কোনো আধুনিক ও কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য মোটেই শোভন নয়। আর এর ফলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসন থাকা বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব তৈরি হয়, যা একপর্যায়ে পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করে, যা কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক নয়। তা সত্ত্বেও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকেরা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে নিজেদের অপরিহার্য বিবেচনা থেকে অন্যের মতামতকে উপেক্ষা করতে থাকে, যা তাদের গুটিকয় স্তবক শ্রেণি ব্যতীত অন্য সবার থেকে বিচ্যুত করে উভয় পক্ষের মধ্যে এমন দেয়াল/বাধা তৈরি করে, যার মাশুল দিতে হয় অকল্পনীয় নিষ্ঠুর পদ্ধতির মাধ্যমে। ইতিহাসে এমন হাজারো উদাহরণ বিদ্যমান থাকলেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করার বাস্তবতাই পরিণতির জন্য দায়ী।
তথ্য অতি মূল্যবান একটি উপাদান। যে কারণে তথ্যের অবাধ প্রবাহ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দোষ-গুণ প্রকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই যে বা যারা নিজেদের কোনো তথ্য প্রকাশ পেলে ক্ষতি হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ পাক, তা তারা চায় না। এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি হয় খুব শক্তিশালী যে তারা তথ্য নিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা রাখে, সে ক্ষেত্রে তারা চাইবে যেসব তথ্য প্রকাশে তাদের লাভ হয়, সেগুলো প্রকাশ পাক এবং যেসব তথ্য প্রকাশ পেলে তাদের ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে, সেগুলো যেন প্রকাশ না পায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশক্তি আইনগতভাবেই তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। ফলে রাষ্ট্র না চাইলে বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার পক্ষে রাষ্ট্রীয় ইচ্ছার প্রতিকূলে কোনো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার থেকেও বিরত থাকতে হয়। এতে সঠিক তথ্য পাওয়া থেকে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ বঞ্চিত হয় কিন্তু তাই বলে তাদের জানার আগ্রহ প্রশমিত হয় না। আর তখনই বিকল্প হিসেবে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যে কারণে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচলিত গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে এমনও দেখা যায়, কোনো কোনো প্রচলিত গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিউয়ার অনেক বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আরেকটি বিশেষত্ব হলো এ মাধ্যমটি নতুন লেখক ও বিশ্লেষক তৈরিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখে চলছে। 
পাশাপাশি এমন সব খুঁটিনাটি বিষয় এ মাধ্যমটিতে উঠে আসে, যা সাধারণত প্রচলিত গণমাধ্যমে স্থান পায় না। সে বিবেচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্বনিয়ন্ত্রিত একটি অতি শক্তিশালী মাধ্যম, যাকে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ অন্য সব প্রচলিত মাধ্যমের মতো ততটা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এ মাধ্যমটি সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে। তবে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এর অপব্যবহারও করছে, যা নীতিনৈতিকতার পরিপন্থী। স্বনিয়ন্ত্রিত মাধ্যম হিসেবে প্ল্যাটফর্মটির মর্যাদা রক্ষা করা ব্যবহারকারীদের একান্ত কর্তব্য।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক। কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক।
 
                           
                           
                            
                       
     
  
 


 ঠিকানা অনলাইন
 ঠিকানা অনলাইন  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
