মুহম্মদ শামসুল হক : আমেরিকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, বিনোদনকেন্দ্র, পার্ক, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ইত্যাদি সবকিছুই বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং ম্যাস শুটিংয়ের অভয়ারণ্য। অথচ আধুনিক বিশ্বের ভূস্বর্গ বা তিলোত্তমা নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদ পাবলিক স্পেসের চরম সংকট বিদ্যমান বললে এর আজন্মের শত্রুরাও তা সহজে স্বীকার করতে রাজি হবেন না। কিন্তু ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরির সর্বশেষ বুলেটিন বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে সেই ভ্রম ঘুচিয়ে দিয়েছে। বুলেটিন অনুসারে, সমগ্র আমেরিকার প্রতিটি পাবলিক স্কয়ারের (গণচত্বর) অংশবিশেষই ব্যাপক সহিংসতা ও আগ্নেয়াস্ত্র হামলার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
বুলেটিন অনুসারে, সর্বসাধারণের আড্ডাখানা ও বিনোদনমূলক স্থানগুলোতে গত নয় বছর পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা অবলীলায় চলে আসছে। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২১ মে ২০২৩ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে সর্বমোট নিহত হয়েছেন ৯৮ হাজার ৮৩১ জন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৪০০ জন। আর গত বছর এককভাবে নিহত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৯৯৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৬৬ হাজার ৫৫৪ জন। অন্যদিকে চলতি বছরের মে মাসে দুই শতাধিকসহ ইতিমধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ সহস্রাধিক আমেরিকান। অপর এক পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় আমেরিকার অভ্যন্তরে প্রতিদিন গড়ে ৩১টি তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে। বুলেটিন অনুসারে, জনসমাবেশ, ধর্মীয় উপাসনালয় বা আশ্রম, স্কুল, বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সরকারি স্থাপনা ও ব্যক্তিবর্গ, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, মিডিয়া এবং ভিন্ন মতাবলম্বী বা আদর্শগত প্রতিপক্ষ হামলার মূল টার্গেট হয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে পাইকারি সহিংসতার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে টেক্সাস। সম্প্রতি টেক্সাসের এলেনের প্রিমিয়াম আউটলেটস স্ট্রিপ মলে নৃশংস হামলায় খুন হয়েছেন আটজন। আর গভর্নর গ্রেগ অ্যাবটের কার্যকালের সাতটিসহ গত ১৪ বছরে সেখানে সর্বমোট নয়টি ম্যাস শুটিং সংঘটিত হয়েছে এবং শুধু গভর্নর অ্যাবটের কার্যকালেই আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় ১০০ টেক্সাসবাসী প্রাণ হারিয়েছেন। কে-টোয়েলভ স্কুল শুটিং ডেটাবেসের পরিসংখ্যান অনুসারে, স্কুল শুটিংয়ের ক্ষেত্রেও জাতীয় পর্যায়ে টেক্সাস দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এই মর্মবিদারী পরিস্থিতির অবসানকল্পে গভর্নর অ্যাবট মানসিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক নেতাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানালেও কার্যত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে অ্যাবটের আন্তরিকতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, গবেষণায় দেখা গেছে, আগ্নেয়াস্ত্র আইন শিথিলতার সুবাদেই সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সমস্যার প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপে অবজ্ঞা এবং টেক্সাসের জনগণকে রক্ষায় গভর্নর অ্যাবটের অক্ষমতা দেশবাসীর অজানা নয়।
পর্যবেক্ষণ এবং জনমত জরিপে আগ্নেয়াস্ত্র মালিককে যাবতীয় সহিংসতার জন্য দায়ী করাসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিরাপত্তা পদক্ষেপের প্রতি টেক্সাসের বাসিন্দারা বারবার অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে আট বছর যাবৎ টেক্সাসের বিদ্যমান আইনকানুনই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। আবার ২০১৮ সালে সান্টে ফে হাই স্কুল হামলার পর রেড ফ্ল্যাগ ল’ নামে পরিচিত এক্সট্রিম রিস্ক প্রটেকশন অর্ডারসের (চরম ঝুঁকি প্রতিহত আদেশাবলি) সমর্থনে গভর্নর অ্যাবট ২০১৮ সালে এক র্যালির উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। অবশ্য টেক্সাসের এলেনের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পর অ্যাবট বলেছেন, ক্ষোভ ও ভয়ে আমাদের সমাজ তটস্থ হলেও দ্রুত সমাধানের কোনো লক্ষণ আপাতত নেই। মূলত নিজ দলীয় নেতাদের প্রতিবন্ধকতার মুখে টেক্সাসে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণে গভর্নর অ্যাবট পুরোপুরি অসহায়। আর ডান ও বাম দলীয় রাজনৈতিক বিভক্তিই টেক্সাসসহ সমগ্র আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র সহিসতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যাহোক, মানবিক কারণে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে টেক্সাসে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা নির্মূলে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অ্যাবট। এদিকে জননিরাপত্তা জোরদার করার নিমিত্তে টেক্সাসে অ্যাসল্ট আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতার বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ বছর করার লক্ষ্যে টেক্সাস হাউস কমিটি অন কমিউনিটি সেইফটি একটি বিল অনুমোদন করেছে। অবশ্য অনুমোদিত বিলটি টেক্সাসের হাউস ক্যালেন্ডারে সংযুক্ত না থাকায় চলতি সেশনে কমপ্রিহেনসিভ গান রিফর্ম কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেহাত ক্ষীণ বলেই সবার ধারণা। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, ডান ও বাম দলীয় রাজনৈতিক বিভক্তি ৩০ বছর ধরে টেক্সাসসহ জাতীয় পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা নির্মূলে প্রধান অন্তরায় সৃষ্টি করে আসছে।
৩৩ শতাংশ ভিকটিমই নিরাপত্তাহীনতার শিকার : আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ও পঙ্গুত্ববরণকারী প্রতি তিনজনে একজন বা ৩৩ শতাংশ সারাক্ষণ ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বলে এভরিটাউন ফর গাই সেইফটির ২০ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে আগ্নেয়াস্ত্র হামলায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে রক্ষা পাওয়া কোল গেইয়ার এক সাক্ষাৎকারে এবিসি নিউজকে বলেন, আমি অদ্যাবধি নিজকে পুরোপুরি নিরাপদ মনে করি না। হামলায় বেঁচে যাওয়ার পর সর্বমহল আমার প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভীতিমুক্তি এবং মানসিক অসহায়ত্ব কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমি অনেক স্কুলে গিয়েছি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার লক্ষ্যে পাঁচ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার পক্ষ থেকেও সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং পরামর্শ পেয়েছি।
কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার বিষাদময় স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা কোনোক্রমেই ভুলতে পারছি না। লোকপ্রবচন অনুসারে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা; প্রাণে বাঁচলেও সারা জীবন ক্ষতচিহ্ন বহন করতে হয়। আমার দশাও তদ্রুপ। অসহায়ত্ব, ভীতি ও আতঙ্ক সারাক্ষণ আমাকে নরখেকো বাঘের মতো তাড়া করছে। আমার বিশ্বাস, আমি বাকি জীবনে কখনো শতভাগ নিরাপত্তাবোধ করতে সক্ষম হব না। মোদ্দাকথা, ভীতি ও দুশ্চিন্তাই আমার জীবনে নিরেট বাস্তবতা। আবার ৩৩ শতাংশ সাইভাইভার বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ পরিষেবা তাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ সাইভাইভার বলেছেন, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার প্রথম ছয় মাসের স্মৃতি ও বিষক্রিয়া কাটিয়ে উঠতে তাদের নানামুখী সাহায্য, পরিষেবা এবং সহানুভূতির প্রয়োজন হয়েছিল। বর্তমানে তারা নিয়তিলাঞ্ছিত ও অন্যের কৃপাপুষ্ট জীবন নির্বাহ করছেন।
পক্ষান্তরে ১০০ জন গান সাইভাইভারকে ১৬টি গ্রুপে বিভক্ত করে তিন মাস ধরে তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা সারভাইভারদের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উভয় ধরনের ট্রমা-ইনফরমড কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি, প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসা ব্যয় কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গেলে প্রাইভেট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি তা পরিশোধে অপারগতা প্রদর্শন করে। ফলে মুমূর্ষু ও গুরুতর আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবাও বাধাগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এদিকে এভরিটাউনের ট্রমা-ইনফরমড প্রোগ্রামের পরিচালক অ্যাবিগেইল হার্স্ট এবিসি নিউজকে বলেন, প্রতিটি আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় শুধু নিহত-আহত ব্যক্তি/ ব্যক্তিবর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তার বা তাদের পরিবারের সদস্যবর্গ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ধর্মাবলম্বী, বর্ণ ও গোষ্ঠীর লোকজন এবং সমষ্টিগতভাবে পুরো কমিউনিটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনতর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতার কালোমেঘ শান্তিপ্রিয় আমেরিকানদের ভাগ্যাকাশকে দিনে দিনে আচ্ছন্ন করার উপক্রম হচ্ছে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২১ মে ২০২৩