দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। চলমান আন্দোলন ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তরালে ঘুরছে নানা ছক-অঙ্ক। রাজনীতির সঙ্গে কূটনীতির সংঘাতও ব্যাপক। রাজনীতি জিতবে না কূটনীতি জিতবে-এ ফয়সালা নিয়ে টানাটানি। বিশ্ব প্রেক্ষাপট তথা চলমান কোল্ড ওয়ার দৃষ্টে স্থানিক রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি কেমেস্ট্রি করার প্রক্রিয়া চলছে। নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর কানাঘুষা পরিস্থিতিকে নিয়ে যাচ্ছে আরেক ফরম্যাটে।
নির্বাচন ছাড়া এই সংসদ ও সরকারকে আরও পাঁচ বছর টেনে নেওয়ার ফর্মুলাটি বাজারে ছাড়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে দিয়ে। সামনে আর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন সম্ভব নয়, তা নিশ্চিত হয়ে সরকারের একটি গ্রুপ এ ফর্মুলা বাজারে ছেড়েছে অ্যাসিড টেস্টের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন তার ফর্মুলা বাস্তবায়নের একটি রাস্তা দেখিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারির কারণ দেখিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দল চাইলেই জাতীয় সংসদে এই সংসদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। আসন বিচারে সংসদে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়েও বেশি আছে সরকারের।
রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতি মিলিয়ে দেশ এখন এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে। তার ওপর সরকার আর রাখঢাক না রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টাগ অব ওয়ারে চলে গেছে। তা জেনে-বুঝেই করেছে সরকার। সামনে আরও স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে গুজব-গুঞ্জন তুঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা স্যাংশন দেওয়া, তাদের সঙ্গে কেনাকাটা না করার মতো হুমকির পর এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদেরও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে সতর্ক করা উচিত বলে বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণেও বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের সতর্ক করা উচিত বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। এর যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাস্তায় গোলাগুলি হয় না কিংবা কেউ কাউকে মারে না। সেই বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা চলাফেরাও ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ বিদেশি কোনো রাষ্ট্র চোখ রাঙিয়ে কথা বললে ঘাবড়ে যায় না-এমন কঠিন কথাও বলেন তিনি। এর আগে গোলমালটা বাধে ঢাকাসহ সারা দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা জারি নিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এ সতর্কতা জারি করা হয়। রোববার বিকেলে মার্কিন দূতাবাসের ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’ শিরোনামে প্রচারিত হালনাগাদ করা ভ্রমণ সতর্কবার্তাটি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, মার্কিন নাগরিকদের জন্য জারি করা ওই সতর্কবার্তা ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্য শহরগুলোর জন্যও প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে বা ওই সময়ে হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন দূতাবাসের বার্তাটিতে বাংলাদেশ যেকোনো সময় সংঘাতপূর্ণ হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে মার্কিন নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। মার্কিন বা যেকোনো দেশের এমন সতর্কবার্তা হোস্ট কান্ট্রির জন্য অপমানের।
এমন অপমানের জবাব দিতে গিয়েই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক এমন জায়গায় চলে গেছে, সেখান থেকে ইউটার্নের লক্ষণ সাদা চোখে দৃশ্যমান নয়। গোটা বিষয়টি চলে গেছে কূটনীতির সাবজেক্টে। ভূ-রাজনীতি, জাতীয় নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ আরও নানা কারণে বাংলাদেশের দিকে এমনিতেই গত কিছুদিন ধরে গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি। তার ওপর চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। বিগত কোল্ড ওয়ারে ১৯৪৮ সাল থেকে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রুম্যান ডকট্রিন আর আরেকদিকে চলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ রপ্তানির ডকট্রিন। এবার সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন ডকট্রিন। অন্যদিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ার সঙ্গে জোট বেঁধে বিশ্বের দেশে দেশে ‘উন্নয়নের মডেল’ রপ্তানির ধারা বেশ গতিময়।
‘শিল-পাটায় ঘষাঘষি, মরিচের জান শেষ’-এ প্রবাদের মর্মার্থ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন গরিব দেশের নিরীহ মানুষেরা। তাদের জন্য সামনে যে ধারা বা মডেল আসার লক্ষণ উঁকি দিচ্ছে, তা কারও জন্য সম্ভাবনার, কারও জন্য শঙ্কার। এরই মধ্যে এর ছাপ পড়েছে আশপাশের দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে। ভারতেও কিছু নমুনা ধরা পড়ছে। ভারত ও চীন কোনোভাবেই চায় না বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে চলে যাক। বাংলাদেশের কে মার্কিন বলয়ে যাবে, কে ভারত বলয়ে-তা পুরোপুরি স্বচ্ছ নয় এখনো। ভেতরে ভেতরে বোঝাপড়ার অঙ্ক আরও নানান দিকে। এসব গণিত ও সমীকরণ বাংলাদেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে একটি টানেল পয়েন্টের দিকে। এ নিয়ে প্রতিদিনই নানা গুঞ্জন-গুজব। আর গুজব কখন সত্য হয়ে যায়-বাংলাদেশের ইতিহাসে এর কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না।