রায়হান উদ্দিন : হিজরি বর্ষের ৮ম মাস হলো মাহে শাবান। শাবান মাস রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এ মাসেই রয়েছে পবিত্র শবেবরাত। আল্লাহ পাক মানবজাতির ওপর অনেক নেয়ামত দান করেছেন।
সূরা আর রাহমানে বহু নিয়ামত প্রদানের কথা বলেছেন। এসব নেয়ামতের মধ্যে অন্যতম নেয়ামত হচ্ছে বিশেষ বিশেষ দিন ও রাতকে মর্যাদা প্রদান করা। এসব পুণ্যময় রাতের মধ্যে ‘শবেবরাত’ এমন একটি মহিমান্বিত রাত।
‘শবেবরাত’ বা মধ্য শাবান আরবি নিসফে শাবান বা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত। তাকে অর্ধ শাবানও বলা হয়। ‘শবেবরাত’ দুটি শব্দের সমষ্টি। প্রথম শব্দটি ‘শব’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে রাত রজনি। দ্বিতীয় শব্দটি ‘বরাত’ আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো মুক্তি। আর ‘শবেবরাত’-এর অর্থ হচ্ছে মুক্তির রাত।
বাংলাভাষায় বরাত শব্দটি ব্যবহৃত ও প্রচলিত। যার অর্থ ভাগ্য। এক্ষেত্রে শবেবরাতের অর্থ হবে ভাগ্যের জনি। তাফসিরে সাবিতে শবেবরাতের চারটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যথা : ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ তথা বরকতময় রাত। ‘লায়লাতুল বরাত’ তথা মুক্তির রজনি। ‘লাইলাতুর রহমাত’ তথা রহমতের রজনি। ‘লায়লাতুস সক’ তথা পুরস্কারের সনদপ্রাপ্তির রজনি।
এছাড়া বণ্টনের রাত, গুনাহর কাফফারার রাত, দোয়া কবুলের রাত, পুরস্কার পাওয়ার রাত ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। এ পবিত্র রজনি মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত রাত। মুসলমানরা এ পবিত্র রজনি লাইলাতুল বরাতে রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি করে রাত কাটান। ‘শবেবরাতে’ উম্মতে মুহাম্মাদি মসজিদে গিয়ে জামাতসহকারে বা আলাদা করে নফল নামাজ আদায় করেন। এ পবিত্র দিবাগত রাতে আল্লাহর কাছে বিগত গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহতায়ালা এ রজনিকে উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য বরকত স্বরূপ ও গুনাহ মার্জনা মৌসুম বলে অবহিত করেছেন।
পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফের মধ্যে লাইলাতুল বরাতের আমল ও ফজিলত সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা দোখানের ১-৪ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন-‘হা-মীম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। নিশ্চয় আমি পবিত্র কুরআনকে বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। ওই রাত্রিতে ফয়সালাকৃত বিষয়সমূহ বণ্টন করা হয়।’ পবিত্র হাদিস শরিফে বলা হয়েছে-‘হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, শাবান মাসের অর্ধ রাতে জিবরাইল (আ.) আমাকে বললেন-হে রাসূল (সা.) আকাশের দিকে মস্তক উত্তোলন করুন। আমি বললাম এ রজনির গুরুত্ব কী? তদুত্তরে তিনি বললেন-এ রজনিতে আল্লাহ পাক ৩০০ রহমতের দরজা খুলে দেন। যারা আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে না, জাদুকর জাদু করে না, জিনাকারী জিনা করে না, মদপান করে না তাদের ছাড়া-সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’
এ পবিত্র রজনির ফজিলত সম্পর্কে আরও উল্লেখ আছে-শায়খুল ইসলাম ইমাম নববী (র.) বলেন, ইমাম শাফেয়ী (র.) তার প্রণীত কিতাব ‘কিতাবুল উম’-এ বলেন-আমাদের কাছে এ বাণী পৌঁছেছে যে, পাঁচটি রজনিতে দোয়া নিশ্চিত কবুল হয়। ১. জুমাবারের রাতে, ২. ঈদুল ফিতরের রাতে, ৩. ঈদুল আজহার রাতে, ৪. রজব মাসের প্রথম রাত, ৫. শাবানের রাতে শবেবরাতের রজনিতে। শবেবরাতের এ মহিমান্বিত রাতে দোয়া কবুল হয়। কেউ খালি হাতে ফিরে না। এ পবিত্র রজনির রাতে ইবাদত করলে ইবাদত কবুল হয়। অধিক সওয়াব পাওয়া যায়।
হাদিস শরিফে আছে যে ব্যক্তি দোজখের আজাব থেকে নিরাপত্তা চায় সে যেন এ পবিত্র রজনিতে ইবাদত করে। কিছু কিছু মানুষ এ পবিত্র রজনিতে দোয়া করলেও দোয়া কবুল হবে না। এ ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এরশাদ করেন-‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সেসব মুসলমানদের ক্ষমা করবেন। কিন্তু গণক, জাদুকর, মদ্যপায়ী, মাতা-পিতার অবাধ্যকারী এবং ব্যভিচারী ছাড়া। (এটি তাফসিরে কবীরে উল্লেখ রয়েছে।)
এই পবিত্র রজনি হলো দোয়া কবুল হওয়ার রাত। এ মহিমান্বিত রাতে মানুষের ভাগ্য বণ্টিত হয়ে থাকে। এ পবিত্র রজনিতে জাহান্নামিদের মুক্তি দেওয়া হয়। হাদিস শরিফে আছে-যে ব্যক্তি এ পবিত্র রজনিতে খাবার, পোশাক, পরিচ্ছদ অথবা নগদ যা কিছু দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে রিজিক বাড়িয়ে দেবেন এবং বরকত দান করবেন।
বিশেষজ্ঞ আলেমরা মনে করেন, এ রাতে আলোকসজ্জা, পটকা ফোটানো, হালুয়া রুটি ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে বিরত থেকে নবি কারিম (সা.)-এর ওপর দরুদ শরিফ পাঠ করা। দান-সদকা করা ও মানুষদের খাওয়ানো, মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে বিগত সব গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। সারা রাত জাগ্রত থেকে কুরআন তেলাওয়াত, তসবিহ তাহলিল পড়া, বুজুর্গানে দ্বীন ও আউলিয়া কেরাম ও পূর্ব পুরুষসহ মুরব্বিদের কবর জিয়ারত ইত্যাদি উত্তম আমলের মাধ্যমে এ পুণ্যময় রজনি অতিবাহিত করার উচিত।