ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির সুদক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও সাম্প্রতিককালে তাতে কিছু পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। নিকট প্রতিবেশী ভারত এবং চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি-কূটনীতির চালে শেখ হাসিনা নৈপুণ্য, দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তিন শক্তি, মহাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজ দেশের স্বার্থরক্ষা করে চলার সুকঠিন কাজটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এ-যাবৎ করে এলেও ক্রমে বিষয়টি জটিল রূপ নিচ্ছে। এই জটিলতা আসন্ন নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অধিকতর জটিলতা, স্পর্শকাতরতার জন্ম দিতে পারে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এ অবস্থা ও আগামীতে এর সম্ভাব্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দেশই নিজেদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির স্বার্থে বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকে। ভূ-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ একতরফাভাবে কারও তাঁবেদার বা কারও স্বার্থ রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে আগ্রহী নয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব বৈরিতার পর্যায়ে না গেলেও দ্বন্দ্বগুলো ইদানীং প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করছে, যা ইতিপূর্বে লক্ষণীয় ছিল না।
নিকটতম প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত মিত্র বলেই এ যাবৎ দু’দেশই মনে করে আসছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ দাবির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড় দিয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে তার সুদীর্ঘ দিনের সমস্যাগুলোর সমাধান পায়নি। কোনো একটি ক্ষেত্রেও ভারত এই উদারতা দেখাতে পারেনি। কয়েকটি বিষয় নিষ্পত্তি করা হলেও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা শর্তসাপেক্ষ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ শর্তহীনভাবে ভারতের অনুরোধ রক্ষা করেছে, অতীতে কোনো সরকারই যা করেনি। যুগের পর যুগ তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা সুরাহা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত, তবে তা-ও শর্তসাপেক্ষে। যাতে বাংলাদেশকে ক্ষতির বোঝাই বহন করতে হবে।
ভারত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে সব সময়ই ভারত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে। তারা কখনোই বলেনি যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহ রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। সাম্প্রতিককালে লক্ষণীয়ভাবে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনসমূহ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পেশা ও সমাজ শক্তিসমূহে ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। নির্বাচনে তারা অপ্রকাশ্যে, আভাস-ইঙ্গিতে কোনো বার্তা পায়নি, যা সমাজ শক্তিসমূহকেও বিস্মিত করেছে এবং তাদের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। অবশ্য সরকারি মহল গভীরভাবে আশাবাদী, সময়মতোই বার্তা আসবে।
চীনের ওপর বাংলাদেশের অতিমাত্রায় নির্ভরতা প্রতিবেশী ভারত যেমনি সহজভাবে নেয়নি, বিশ্ব মোড়ল বলে এ যাবৎ দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হালকা করে নিচ্ছে না। বিশেষ করে, ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোটের সামরিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অতিমাত্রায় সতর্কতা যুক্তরাষ্ট্র ভিন্নভাবে দেখছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করেন। গার্মেন্টসামগ্রী আমদানি কমিয়ে দেওয়াসহ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি কঠোর অবস্থানও নেয়, সে ক্ষেত্রে চীনের দ্ব্যর্থহীনভাবে পাশে থাকার নীতি সরকারকে শক্তি জোগাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে নানাভাবে লাভবানও করছে চীন। কোনো দেশের নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে চীন কখনোই হস্তক্ষেপ করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চীন তা করেনি। কিন্তু এবার বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা তাদের নীতির পরিবর্তন করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ও তার নেত্রীর দূরদর্শী, প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চীনের প্রতি এ দেশের মানুষের একটা আবেগ, আস্থাশীল দুর্বলতা রয়েছে। সরকার নির্বাচনে একে পুঁজি করছে। অভ্যন্তরীণ পেশাজীবী ও গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলো এতে প্রভাবিত হবে। এই শক্তিগুলোর প্রবল দুর্বলতা রয়েছে চীনের প্রতি। সরকার এদেরকে নির্বাচনে তার পক্ষে পাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
চীন বাংলাদেশে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি স্থানান্তর করবে। এখনে শ্রমশক্তি তুলনামূলক কমমূল্যের সহজলভ্য বলেই নয় কেবল, বাংলাদেশকে গার্মেন্ট খাতে আরো এগিয়ে নিতেই তাদের এই ভূমিকা। বাংলাদেশে তারা গার্মেন্ট পল্লি স্থাপন ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জনসাধারণের বিভিন্ন অপরিহার্য পণ্য উৎপাদনের ফ্যাক্টরি স্থাপন করবে। পশ্চিমবঙ্গেও চীনা সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চীন অল্প সময়েই ভারতের শতাধিক কোটি মানুষের বাজারে পরিণত হয়ে উঠবে, যা সেখানকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাশিত নয়। চীনের ওপর বাংলাদেশের অতিমাত্রায় নির্ভরতা এবং এখানে চীনের বিপুল বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতে ভূমিকা রাখছে বলে কূটনৈতিক মহল মনে করেন। বাংলাদেশ সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বা বৈরী করার মতো প্রকাশ্য বক্তব্য, মন্তব্য দিতেও দেখা গেছে। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিএনপির প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে কার্যকলাপ চালানো ও বক্তব্য রাখার পরই সরকারের মন্ত্রীরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু কৌশলী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন প্রশাসনকে বৈরী করতে চান না। চীনের সঙ্গে সুগভীর সখ্য গড়ে তোলার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা ও নতুন মাত্রা যোগ করতে উদ্যোগী হন। এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রধানমন্ত্রী-তনয় ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। মার্কিন শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক বিশেষ ফলদায়ক হয়েছে। দেশি-বিদেশি কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী নানাভাবে চেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে সরকারের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সখ্য প্রতিষ্ঠা না পায়। তাদের মধ্যে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা এক বিশিষ্ট ব্যক্তিও রয়েছেন।