জাকিয়া শিমু :
শরীরমনের এই বেহাল দশাতেও সারাদিনে একদণ্ড বসে জিরিয়ে নেয়ার জো নেই তার। সকালে দু’প্রস্থ দু’স্কুলে হেঁটে, প্রথমে ছেলে এবং আধঘণ্টা পরে মেয়েকে পৌঁছে দিতে হয়। তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরে ঘরের হাজার কাজ। একা চারদিক সামলে ইদানিং সে আর পারছে না, হাঁপিয়ে উঠেছে। একহাতে রান্না, কাপড় কাচা, বাজারঘাট পুরোটাই নিজের একার কাঁধে। দিনের মধ্যভাগে মেয়েকে স্কুল থেকে তোলে বাকি কাজ আধাআধি না সারতে ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে যায়। ওদিকে করোনার মহামারির আগের চিত্র ছিল অনেকটাই ভিন্ন। শরীফ সাহেব অফিস শেষে ফিরতি পথে সংসারের বাজারসদাই করে বাসায় ফিরতেন। সংসারের খুঁটিনাটি কাজে হরহামেশা স্বেচ্ছায় হাত লাগাতেন। সকালবিকাল কাজেরলোক এসে সংসারের বাড়তি কাজ করে দিয়ে যেতো। সেসবই আজ অতীত ইতিহাস। করোনায় শিখাকে বড়ো শিক্ষা দিয়ে গেছে- সংসারটা তাঁর নিজের না হলেও সংসারটা ধরে রাখার দায়ভার সম্পূর্ণটা তাঁর একার ওপর বর্তায়!
মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে মা-মেয়ে তুমুল ব্যস্ত ফুটপাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটে। শিখা এসময়ে আশপাশের শেষবাজারের সস্তা সবজি কিংবা পরতিবেলার নরম- আধক্ষয়া মাছের খোঁজে চোখ সজাগ রাখে। মেয়েটাও হয়েছে মায়ের মতো। মেয়েরা মায়েরজাত বলে কথা। বৈরি পরিবেশে আত্মসম্মানের সাথে প্রাণপণ লড়ে যেতে কাউকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হয় না। পাঁচ বছরের মেয়েও জানে শকুনচোখে সস্তাদরে সবজি খুঁজতে হবে। মেয়ের হাতের ইশারায় ফুটপাতের উল্টো দিকে চোখ ফেরাতে সবজির ভ্যানে চোখ পড়ে শিখার। দিনের মধ্যবেলা, মাথার উপর সূর্যরশ্মি তেতিয়ে রোদ ঢালছে। চারপাশে অতিরিক্ত মানুষজন, অযাচিত বাড়তি দালানকোঠায় শহরের অসহনীয় তাপমাত্রায় মানুষগুলো আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে, সবজির হাল সেখানে সহজেই অনুমেয়। পাটশাকের আঁটি হাতে ধরে শিখার চোখ আঁটির একদম ভেতরে সতেজপাতার খোঁজে। শিখার পছন্দ তিতা পাটশাক। আঁটিটি নাকের কাছে ধরে চোখ বুজে ঘ্রাণ নেয়। মুহূর্তে হুহু করে পেছনছুটে, ফিরে যায় তাঁর ছোট্টবেলার সেসব রঙিনদিনের স্মৃতিতে।
তাদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তর খোলা মাঠ ছিলো। দিগন্তজোড়া সেসব মাঠে বিভিন্নজাতের পাট চাষ করা হতো। বৈশাখ মাসে মাঠজুড়ে ঘনসবুজে দুপাতা নিয়ে পাটেরচারা জেগে উঠে। দেখতে দেখতে খুব অল্পসময়ে পাটের চারাগাছ ডালপালাহীন একপায়ে বেড়ে উঠে, হাঁটু সমান হয়ে। সকালবিকাল বাবা যত্ন নিয়ে চারার গোড়ায় নিড়ানি দিতেন। শিখা মনের সুখে ক্ষেতের আল ধরে এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দৌড়ে বেড়ায়। বাতাসে পাটেরগাছ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু সবুজের ঢেউ খেলে যায় দিগন্তছোঁয়া মাঠে। আকাশে ভরা বোশেখের ছুটা-মেঘ, ক্ষণেক্ষণে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে যায়। মেঘের লুকোচুরির মাঝে মেঘখণ্ডের ফাঁকফোকরে সূর্য তার ফোকলা দাঁতের হাসি হাসে, মাঠজুড়ে রোদের ঝলক পড়ে। মেঘ, রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি, বৈশাখী হাওয়া পাটেরমাঠে অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য তৈরি করে। শিখা, মুগ্ধ চোখে মাঠের দিকে তাকিয়ে কল্পনার রাজ্যে ঘুরেফিরে।
ঠিক সেসময়-বাবার মায়াভরা গলাটা শিখার খোঁজে দূরপ্রান্ত থেকে বৈশাখী হাওয়ার সাথে ভেসে আসত শিখার কানে। বাবা, দুর্বল পাটগাছগুলোকে উপড়ে এনে ক্ষেতেরআলে ছড়িয়ে দিতেন। শিখা পাটগাছের স্তুপ থেকে কচি পাতা- ডগা তুলে আলাদা করত। সন্ধ্যা নামার আগে বাঁশের ঝুড়িতে তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরত। পাটশাকের সাথে মায়ের হাতের কাসুন্দি ঝালের স্বাদ আজও জিভে লেপটে আছে।
মেয়ের ডাকে শিখার সম্বিত ফেরে। শেষবেলার নুয়েপড়া দু’আঁটি শাকের ভেতর সেসব স্মৃতি পুরে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাড়ির কাছে আসতে সেই লোকের সাথে দেখা। শিখার বুকটা ধুরুম ধুরুম ঢাকের শব্দে কেঁপে উঠে। তার চোখ দ্রুত সিতারা ভাবির বারান্দা ঘুরে নিজ বারান্দায় চলে যায়। দু’বারান্দা ফাঁকা। শিখা আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, জোরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তড়িঘড়ি বাড়ির রাস্তা ধরে। কিন্তু কী কাণ্ড! যাকে নিয়ে তাঁর নিশিদিন ভয়আতঙ্কে কেটে যায়, সে লোক তাঁর দিকে ফিরেও যে তাকাল না! লোকটির ব্যস্তচোখ রাস্তার ওপাশে। হয়তো রিকশার খোঁজে। শিখা তার খুব সামনে দিয়ে চলে আসতে সামান্য ভাসা চাহনি, মনে হয় শিখাকে সে চিনতে পারে নাই। শিখা মস্ত বড়ো বাঁচা বেঁচে যায়। মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে।
বুক ঢকঢক শব্দ করে কাঁপছে, হৃদয়ে রক্তের চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণে। শরীরে বাড়তি ঘাম। মনে হচ্ছে শ্বাসনালিটা খুব শক্ত করে কেউ চেপে ধরে আছে। নিশ্বাসটা ঠিকঠাক মতো বের হতে পারছে না। শিখা নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই লুকোচুরির মাত্রা দিনকে দিন হুহু করে বেড়েই চলছে। ঘরের মানুষ শরীফ সাহেব, তার সাথেও ওঁর স্বাভাবিক কথাবাতরা বলতে গিয়েও কেমন যেন নিজেকে গুলিয়ে ফেলে। সিতারা ভাবির সামনে সে স্বাভাবিক হতে পারে না। অন্য ভাবিদেরও এড়িয়ে চলে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এমনকি নিজের বাবামায়ের ছায়াও এখন আর স্বস্তি দেয় না। ঘুম হয় না। একটা সময় বিছানা যাওয়া মাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে যেত। সে মানুষ সারারাত আকাশের তারার মতো একলা জেগে বসে থাকে, ভোর হওয়ার অপেক্ষায়।
শরীফ সাহেব বারান্দায় বসে আয়েশ করে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতে শিখা চা নিয়ে হাজির হয়। এ সময়ে সে আয়েশ করে এককাপ ধুঁয়াওঠা চা খায়। আগের সময়ে অবশ্য ছুটির দিনে দুজনে মিলে সকালবেলায় চায়েরকাপে আড্ডায় বসতেন কিন্তু এখন শিখার ছায়া-ও তার কাছে অসহ্য ঠেকে। ইদানীং তিনি চাকরির খোঁজখবরও বাদের তালিকায় তুলে রেখেছেন। সারাক্ষণ বাসায় থাকেন আর ঘ্যানঘ্যান করেন। যেমন- শ্বশুরের জমিতে তার ভাগের অংশ কলমেকাগজে পইপই করে হিসাব কষেন। শিখার কিছু ধনী দাম্ভিক স্বজন আছে, যাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে শিখাদের যোগাযোগ থাকার কথা নয় কিন্তু সেসব জনের নামঠিকানা যোগারযন্ত করছেন। টাকাপয়সা কিভাবে আদায় করা যায় সেই ভাবনাচিন্তায় সে ব্যস্ত এবং অস্থির। শিখার গহনা বিক্রির টাকার একাংশ শিখা বাসাভাড়ার জন্যে আলাদা তুলে রেখেছিল, সেই টাকা শরীফ সাহেব নিজের বাবার সংসারে পাঠিয়ে দেন। সামনের মাসের বাসাভাড়া নেই, খাবারের যোগার কী করে হবে তার কোনোরকম চিন্তা তার মধ্যে দেখা যায় না। এভাবে শিখার জন্যে যতপ্রকার যন্ত্রণা তৈরি করা যায় তার কোনোটারই কমতি তিনি রাখেন না। শিখা সমস্তটা নিরবে মাটির মতো করে সয়ে যায়।
শিখা বিএ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিল। বিএ পাসের পর বন্ধুরা দলবেঁধে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়ে। সেসময়ে এই পেশায় সরকার থেকে ভালো সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল। শিখা ছাত্রী হিসেবে বরাবরই মাঝারিগোছের ছিলো। এবং বন্ধুদের মধ্যে শিখার রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো আসে। বাবার আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে হওয়ায় শহরে এমএ করার সুযোগ হয়নি। সেসময়ে পরিবারের দিকে তাকিয়ে বিশেষ করে মায়ের জোরাজোরিতে সে বসল বিয়ের পিঁড়িতে। অবশ্য শরীফ সাহেবকে শিখা বাসরঘরে তাঁর মনের গোপন ইচ্ছেটা বাতলে ছিলো। এমএ ক্লাশটা পার হওয়া তাঁর বহুদিনের লালিত-স্বপ্ন এবং এরপর একটা চাকরি! স্বপ্ন আকাশসমান না হলেও এই স্বপ্ন-ই তার বুকে এঁটে আছে জীবনভর। গ্রাজুয়েট শরীফ সাহেব, নবপরিণীতার লালিত স্বপ্ন হাসির ছলে, কৌশলে একফুঁ’য়ে সারাজীবনের তরে উড়িয়ে দেন।
নিজের যে গণ্ডি ধরার যোগ্যতা নেই, অন্যকে সে স্বপ্নে পৌঁছে দেওয়ার মতো সৎসাহস বা ধৃষ্টতা শরীফ সাহেবের থাকার কথা নয়। বরং সেসময়েই সে শিখাকে এমনভাবে বশের জালে আটকে দেন যাতে সারা জীবনে শিখা এমন দুঃসাহস দ্বিতীয়বার আর ভাবনায় আনার সুযোগ না পায়।
অবশ্য এসব তার মনের কথা, সেযাত্রায় মুখে হাসি মেখে কৌশলে তা এড়িয়ে যান। ভালোবাসার ভুলভাল কথায় বাসরঘরেই শিখার সে স্বপ্ন তিনি কবরচাপা দিয়ে দেন। শিখা সেসব মিথ্যে কথায় ডুবে গিয়ে নিজের স্বপ্ন বুকগভীরে চেপে রেখে সংসারে মন দেয়। তারপর ছেলেমেয়ে সংসারে এলো। নিজের সাধআহ্লাদ ধরাছোঁয়ার বাইরে কোথায় ছুটে পালালো। এখন অবশ্য তাঁর সত্যটা বুঝতে বাকি নেই – জীবনের সেরা ভুলটি সে বাসরঘরে করে এসেছে। বাবার চেহারাটা চোখের সামনে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ঘুরেফেরে। বাবা খুব করে বলতেন, ‘কিছু একটা করার মধ্যে লেগে থাকো’। বাবার কথার গুরুত্ব শরীফ সাহেবের হুংকারের নিচে চাপা পড়ে যায়।
ঢাকা শহরে মাথার উপর আকাশটাকে খোঁজে খোঁজে বের করে দেখতে হয়, তাও জায়গাবুঝে মুশকিল হয়ে পড়ে। যেমন- শিখার নতুন বাসায় তিনদিক ঘিরে আছে জ্যান্ত দানবের মতো অযত্নে গড়ে উঠা আকাশঢাকা অট্টালিকা। ছোট্ট বারান্দার এককোণা দিয়ে কষ্ট করে হলেও খুঁজেফিরে একখণ্ড আকাশ, দালানের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা মেলে। শিখা মেয়েকে স্কুলে রেখে, ফিরতিকালে দুআঁটি হেলেঞ্চা শাক প্রতিদিনের মতো নিয়ে ফিরে। রান্নাঘর বলতে একজোড়া চুলা। নিচে বসে কাজ করার জায়গা নেই। বাড়তি কাজ সে বারান্দায় সারে। ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। বারান্দায় কুটাবাছার কাজ করে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন অট্টালিকার ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে দেখে নিয়ে যেন দম ফিরে পায়। কূটাবাছার মধ্যিখানে হঠাৎ চোখ পড়ে পাশের বাড়ির বারান্দায়। লোকটা বারান্দার নেড়ে দেওয়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো বের করে শিখার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্বভাবত সে ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠে।
ওদিকে শরীফ সাহেব বিশেষ একটা কাজে ঘরের বাইরে গেছেন। সিরাতের মাকেও এ সময়ে দেখা যায় না। শিখার মেজাজ হঠাৎ কেমন বিষিয়ে উঠে। এবং সুযোগ পেয়ে আগপাছ না- ভেবে, পায়ের পরনে স্যান্ডেলটা লোকটার মুখ বরাবর তুলে ধরে। লোকটা হোঁচট খায়, এমন পরিস্থিতির জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে সে কড়া আওয়াজে চেঁচিয়ে ওঠে। শিখা দ্রুতপায়ে ঘরে ছুটে আসে। লোকটার অস্বাভাবিক চেঁচামেচিতে প্রতিবেশিরা যার যার বারান্দায় ভিড় করে। লোকটা শিখাদের বারান্দা উদ্দেশ করে চিৎকারের আওয়াজ আরও বাড়িয়ে দিলে সবার চোখ শিখার বারান্দার দিকে। ঠিক এসময়ে সেলফোনটা বেজে উঠে এবং অনবরত বাজতেই থাকে। সিফাত ভাবির ফোনটা শেষপর্যন্ত শিখার ধরা হয় না। তার শরীর কাঁপছে, ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে। মনে হচ্ছে পুরো বিশ্ব বুঝি সর্বোচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। সে ঘরের মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে।
শরীফ সাহেব শেষবেলাতে বাসায় ফিরেন। ঘরে ঢুকেই খাবারের জন্যে হুঙ্কার দেন। দুপুরের ঘটনায় শিখা এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। তারপরও তটস্থ হয়ে চটজলদি খাবারের যোগারযন্ত করতে যায়। ঘটে আরেক বিপত্তি। ট্যাংরা মাছের ঝোলতরকারির কাঁচের বাটিটা খাবার টেবিলের কাছে নিতে কাঁপন্তহাত ফসকে পড়ে যায় ঘরের মেঝেতে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শিখা আহত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়।
শরীফ সাহেব বছরদুই আগের সময়ে এমন ঘটনা ঘটলে হাসিমুখে সবকিছু সয়ে যেতেন। অবশিষ্ট শাক-ডালে কবজি ডুবিয়ে হাসিমুখে ভাত খেয়ে সুখের ঢেঁকুর তুলতেন। কিন্তু আজকের সময়-চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই তুচ্ছ-ঘটনার রেশ টেনে বহুদূর নিয়ে গেলেন। শোরগোল, চেঁচামেচি দিয়ে শুরু করলেও শেষপর্যন্ত শিখার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করলেন না। এ উছিলায় যৌতুকের টাকার প্রসঙ্গ তুলে শিখার বাবা-মাকে উদ্দেশ করে অকথ্য গলাবাজি চলল আরও বহুক্ষণ।
বাচ্চা দুটোর বাবার এমন অগ্নিমূর্তির সাথে পরিচয় নেই। বাবা তার মাকে নিচুলোকদের মতো করে পেটাতে পারেন তাদের কল্পনাতে হয়তো ছিলো না। ভয়ে এরা দু’ভাইবোন জড়াজড়ি করে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। শরীফ সাহেব শেষমেশ ভাতের প্লেট আছড়েছুড়ে ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। শিখা অপমানে নিজের চেহারা বাচ্চাদের কাছ থেকে আড়াল করতে বারান্দার এককোণে আশ্রয় নেয়। ঢাকার শহরে পাশেরবাসায় কোনো মুমূর্ষু রোগী শেষসময়ে প্রতিবেশির কাছে কোনরকম সাহায্য না পেলেও, অন্ধরমহলের এমন কুৎসিত কিচ্ছা কাহিনী শুনতে কান বিছিয়ে রাখে এবং পৈশাচিক সুখও শুষে নেয় কেউ কেউ। এখানেও তাই, আশপাশের মানুষের চোখ শিখার বারান্দায় ভিড় করে। শিখার চোখ পড়ে লোকটার বারান্দায়। সেও গ্রিলের ফাঁক দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। একই সময়ে সিতারা ভাবিকেও নির্লজ্জ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। লজ্জা অপমানে শিখার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
পরদিন ভোরবেলার সকালের-বাস ধরে শিখা বাবারবাড়ি চলে আসে। বাবার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। চাকরির বয়স শেষ হতে আর মাত্র বছরদুই বাকি আছে। ওদিকে মা সারাক্ষণ বাবাকে জ্বালিয়ে যায়। ছোট দু’মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। মেয়েদের এ-বয়সে আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকে, এরপর তা মরতে শুরু করে। শিখা মায়ের এমন কথায় যারপরনাই বিরক্ত হয়। মায়ের এমন চিন্তাধারার ফলাফল শিখার বর্তমান অবস্থা। বাবা শিখার বিয়েতে রাজি ছিলেন না। বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে শক্তপায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মায়ের কারণে তা হয়নি। বাবাকে অনেকটা জোর করে রাজি করানো হয়। মায়ের কারণে, হয়তো না হলে শিখার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!
বাচ্চাদের স্কুল খোলা থাকা অবস্থায় কেনো শিখা বাবারবাড়ি এলো, সে বিষয়ে কারও কাছে সে খোলাসা করে না। তবে দুর্ঘটনা কিছু একটা যে হয়েছে এ বিষয়ে সবাই নিশ্চিত। শিখা মরে গেলেও বাবাকে শরীফের এমন প্রস্তাব দিতে পারবে না। যদিও নিজের সংসারে ফিরে যাওয়ার পথটুঁকু বন্ধ হয়ে আছে। শরীফ গতকাল বাসা থেকে বেরিয়ে আর বাসায় ফিরে আসেনি। সারারাত বাচ্চা দুটোকে নিয়ে নির্ঘুমে কাটিয়ে ভোরে বাবার বাড়িতে চলে আসে শিখা।
চরম অস্থিরতায় দুদিন কাটিয়ে একসময়ে শিখা নিজের সংসারে ফিরে আসে। শরীফ সাহেব বাসাতেই ছিলেন। শিখা যেন কিছুই হয়নি এমন অভিনয়ে শরীফের সাথে হাসিমুখে গল্প জমাতে গেলে চরম অপমান করে সে। টাকার কথা তুলতে শিখা চুপ হয়ে যায়। এসময়ে শরীফ সাহেব শিখাকে শক্তহাতে কষে কান বরাবর চড় মারেন। আঘাতের তীব্রতায় মেঝেতে ঘুরে পড়ে যায় সে, কানফেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। হাতে কানচেপে উঠে দাঁড়াতে গেলে শরীরের সমস্তজোর ব্যয়ে শিখাকে উপর্যুপরি কুকুরের মতো লাথিতে বেহুঁশ করে মেঝেতে ফেলে রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় শরীফ সাহেব।
লোকটা শিখাদের বারান্দার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কাউকে যেন খুঁজছে। সিতারা ভাবি মনের আনন্দে নিজ-বারান্দা থেকে ফোনে তা ভিডিও করেন। শিখা একসপ্তাহ পর বাচ্চাদের আজ স্কুলে দিয়েছে। শরীফ সাহেব সেই যে বেরিয়েছে দুদিন হয় বাসায় ফিরেনি। যাওয়ার সময় শিখাকে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়ে গেছে। এর মধ্যে বাবার কাছ থেকে টাকা না আনতে পারলে সংসার থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
শিখা ভেজা কাপড় দ্রুত নেড়ে দেয় বারান্দার টেনে দেওয়া দড়ির আড়ায়। পাশের বারান্দায় চোখ পড়তে সেই একই দৃশ্য। ফ্যালফ্যাল চোখে তাঁকে দেখছে। লোকটার ওপর চরম বিরক্তি-ঘৃণা ধরে গেছে ওর। নিজের বর্তমান মনের অবস্থাটা কী ভয়ঙ্কর, দিশেহারা। কষ্টগুলো কেমন আষাঢ়ে মেঘের মতো শরীর-মনের ওপর পোক্তভাবে জেঁকে বসেছে। তার ওপর বাইরের এমন উটকো ঝামেলা! ঘর-বাইর কোথাও এক ফোঁটা শান্তি নেই। বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার মতো একখণ্ড জায়গা অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তা তাঁর বরাদ্দে রাখল না! শিখার সহনের ক্ষমতা ভেঙে যায়।
ইদানিং সারাক্ষণ আত্মহননের চিন্তাটা মাথায় ভর করে থাকে। নিয়মিত ঘুমের ওষুধ নিয়েও একদণ্ড ঘুম হয় না। ঘরে একটা কানাকড়ি নাই। গতকাল বিকেলে বিয়ের কানের দুলটা অর্ধেক দামে পরিচিত জুয়েলারিতে দিয়ে আসতে হয়েছে। সেই থেকে মনটায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শিখা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাত বাড়িয়ে লোকটাকে থাপ্পর দেখিয়ে ভিতরে চলে আসে। কী অবাক করা কাণ্ড! এবার লোকটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ঠিক সে সময়ে শিখার সেলফোনটা বেজে উঠে। এবং একটানা খেক-শিয়ালের ডাকের মতো ভয়ার্ত সুরে বেজেই যায়। সিতারা ভাবির ফোন বুঝতে ওর দেরি হয় না। ও মহিলা ফোন না ধরা অব্দি ক্ষান্ত হবেন না। বিরক্তি নিয়ে হলেও শিখা ফোনটা কানের পাশে চেপে ধরে। ওপাশ থেকে ভাবির অট্টহাসির শব্দ। শিখার কাছে তার হাসির আওয়াজটা সাক্ষাত পিশাচের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার মানে ভাবি পুরো ঘটনা দেখে ফেলেছে। ঘটনার সময় মনটা এমন বিক্ষিপ্ত ছিল, ও-বারান্দার দিকে খেয়াল করার কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। ফোনটা কেটে দিতে ওপাশ থেকে শিখার ফোনে ভাবির পাঠানো একটা ভিডিও মেসেজ আসে। মেসেজটা খুলতে শিখা নদীর পাড় ভেঙে উপড়েপড়া গাছের মতো নিরুপায় হয়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায়।
(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)