Thikana News
২১ জুলাই ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫

কৃষক যুবক মোজার মুক্তিযুদ্ধ ও গাইয়ের পাছা ঘোরানোর গল্প

কৃষক যুবক মোজার মুক্তিযুদ্ধ ও গাইয়ের পাছা ঘোরানোর গল্প
ফিরোজ হুমায়ুন


এক.

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। এই দিনে আমরা পাক হানাদার বাহিনীর শোষণের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে এক স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলাম। এই বিজয় অর্জন করতে দিতে হয়েছিল অনেক রক্ত। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ ও ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এসেছে এই বিজয়। এই বিজয়ের পেছনে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন বাজি রাখতে হয়েছিল। তারা সেদিন দেশপ্রেম, দেশমাতার প্রতি ভালোবাসার টানে যুদ্ধ করেছিলেন। আজ তেমনি একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলব, সে কোনো বড় নেতা নয়। নয় কোনো বিদ্বান কিংবা ধনী ব্যক্তি। সে বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত এক যুবক। সে কোনো স্কুলে যায়নি। 

কোনো বই-পুস্তক পড়েনি। কিন্তু তার দেশপ্রেম ছিল আকাশের মতো উঁচু। আর সেই দেশপ্রেমের টগবগে আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে ভারতে যায় গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য। আর আজন্ম আকাশচুম্বী দেশপ্রেমের দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে ফিরে আসে দেশে। দেশ স্বাধীন করে। আশা ছিল একটা ভালো জীবনের। আশা ছিল প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটানোর। আশা ছিল দু’বেলা খেতে পরতে পারবে। সেদিন যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের ৯০ শতাংশ ছিল ছাত্র কিংবা যুবক। সেদিন তাদের আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের হাতে না ছিল না অস্ত্র। তাদের শুধু ছিল অপরিসীম সাহস আর আকাশচুম্বী দেশপ্রেম। তা নিয়েই তারা লাফিয়ে পড়েছে যুদ্ধে এবং পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করেছে।

সময়টা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সে সময় বাংলাদেশে আমার মতো শত শত তরুণ-যুবক দারুণ উত্তেজনায় ভুগছে। এইটাই সুযোগ। এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে। মওকা একটা পাওয়া গেছে। এই মওকায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে কুপোকাত করতেই হবে। মওকার কারণ বাংলাদেশের অন্যতম সংগ্রামী ও জনপ্রিয় নেতা মওলানা ভাসানী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কিন্তু তিনি পরোক্ষভাবে শেখ মুজিবকে সমর্থন করছেন এবং করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সে সময় আমরা ছাত্ররা ছিলাম সবাই দেশের সৈনিক। সেখানে আমাদের অন্য কোনো পরিচয় ছিল না। 

ছিল না পরিচয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা অন্য লীগ। লক্ষ্য একটাই-দেশের স্বাধীনতা। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ, একটাই কাজ, একটাই লক্ষ্য। দেশমাতার মুক্তি। এই পর্যায়ে উদ্দেশ্য ছিল এই নির্বাচনে জেতা এবং আমাদের বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জন। তার পরবর্তী পর্যায়ে আসবে স্বাধীনতা। এটাই ছিল আমাদের ছাত্রদের মূল লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্যে আমরা পুরো ছাত্রসমাজ ছিলাম একত্রিত। শুধু কিছু ছাত্র সংগঠন যারা পশ্চিম পাকিস্তানের লেজুরবৃত্তি করত, তারা ছাড়া।

নির্বাচনের এমন সন্নিকটে আমাদের কলেজ দুই সপ্তাহের ছুটি দিল। সহপাঠী ও প্রিয় বন্ধু হাসান মাহমুদ ফরিদী খুব রাজনীতিসচেতন। সে ফরিদপুরে তার গ্রামে চলে গেল এবং আমাকেও যেতে বলল। তা ছাড়া আমাদের নেতৃস্থানীয় সিনিয়র ভাইরাও চলে গেল তাদের নিজ নিজ গ্রামে। তাই আমিও চলে এলাম আমার গ্রামে। এসেই নির্বাচনের জন্য লেগে পড়লাম। আমার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার পলাশবাড়ী থানায়। গ্রামে এসে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বাচনী জ্বরে ভুগছে। 

এই সময়ে আমাকে ওরা কাছে পেয়ে দারুণ খুশি। আমি গ্রামে আমাদের পরিবারের কারণে, আমার বাবার জন্য ও ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাদে সবার ভালোবাসার পাত্র ছিলাম। গ্রামে এসে আমি আমার ছোট চাচা, যিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, স্কুল-কলেজে পড়া আমার কাজিন ও পুরোনো বন্ধুদের একত্রিত করলাম। রাতদিন মিছিল-মিটিং চলছে। সে কারণে আমাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগল। বিশেষ করে, আমি আমাদের গ্রামের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব যুবকের কথা শুনতাম। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আমাদের ইয়াং জেনারেশন দেশের জন্য কিছু করতে উন্মুখ হয়ে আছে। আমরা প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করতে লাগলাম।

কিন্তু আমাদের বড় প্রবলেম ছিল অপজিট পার্টির ক্যান্ডিডেট খুবই শক্তিশালী ছিলেন। তার নাম অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। তিনি তিন-তিনবার এমএনএ ছিলেন। তিনি এর মধ্যে দুবার আমাদের গ্রামে ক্যানভাস করে গেছেন। কিন্তু আমাদের এমএনএ ও এমপিএ ক্যান্ডিডেট কেউ এখনো আসেনি। আমাদের এমএনএ ক্যান্ডিডেট ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ আব্দুল হামিদ সাহেব, যিনি বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম স্পিকার হয়েছিলেন কিন্তু কার্যভার গ্রহণ করার আগে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে অবিভক্ত বঙ্গ পরিষদের সদস্য ছিলেন। আব্দুল হামিদ সাহেবের বয়স তখন ৮০। তার পক্ষে গ্রামে গ্রামে চষে বেড়ানো সম্ভব ছিল না। আর এমপিএ ক্যান্ডিডেট ছিলেন জনাব আজিজুর রহমান বিএসসি। তিনিও এখনো আসেননি। আমাদের দলের সবাই খুব অসন্তুষ্ট এ কারণে। 

অবশেষে আমি ও আমার ছোট চাচা অনেক কষ্টে দুজনকে রাজি করালাম। ওনারা গ্রামে এলেন। আমরা খুব বড়সড় একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করলাম। প্রচুর লোকসমাগম হলো। প্রথমে অ্যাডভোকেট শাহ আব্দুল হামিদ সাহেব বক্তৃতা করলেন। উনি বৃদ্ধ মানুষ। ওনার শুদ্ধ ভাষার বক্তৃতা গ্রামের লোকের বোধগম্য হলো না। প্রচণ্ড হতাশা আঁচ করতে পেলাম। তবে এমপিএ ক্যান্ডিডেট জনাব আজিজুর রহমান বিএসসি সাহেব খুব চালাক মানুষ। উনি শেষ বক্তা। এই মিটিং আমি পরিচালনা করছিলাম। তাই তাকে পুরো পরিবেশ এবং পুরো অবস্থাটা জানালাম এবং মানুষের আশা ও চাহিদা সম্বন্ধে বুঝিয়ে বললাম। উনি বললেন যে উনি বুঝেছেন এবং আমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। আমি ওনার পরিচিতি জানালাম এবং বললাম, উনি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। প্রচণ্ড করতালির মধ্যে উনি ওনার বক্তৃতা শুরু করলেন একদম রংপুরের গ্রামের ভাষায়।

* কী বাহে, কেমন আছেন?
-ভালো। সবাই উত্তর দিল।
* তোমরা তো সবাই ক্ষেতত কাম করেন?
-হ্যাঁ, করি।
* তোমার ঘরে গাই গরু আছে না?
-আছে?
* কার কার গাই আছে, হাত তোলো?
-প্রায় সবাই হাত ওঠাল।
* কী খিলান তোমার গাইক?
-ঘাস। সারা দিন খিলাই বাহে।

* মনে করো হামার দ্যাশটা একটা গাই। হামরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গাইক সারা দিন ঘাস খাওয়াই। আর পশ্চিমারা সারা রাত সেই গাইয়ের দুধ দোয়ায়া নিয়ে যায়। আবার হামরা সারা দিন ঘাস খাওয়াই, ওরা সারা রাত দুধ দোহায়া নিয়া যায়। এমনি করে একদিন নয়, দুই দিন নয়, আজ তেইশ বছর ধরে এই কাম করছে। তাই তোমাদের গায়ে কাপড় নাই। তোমাদের পেটেত ভাত নাই। তাই তোমরা গরিব। তাই এবার আমরা ভোট করছি। হামরা যদি ভোটে জিতি, তবে এবার গাইয়ের পাছা ঘোরাব। আর হামরা সারা দিন দুধ দোয়াব। আর শালা পশ্চিমারা সারা দিন ঘাস খাওয়াবে। তোমরা রাজি?
মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল। পরদিন থেকে এই কথাটাই আইকন হয়ে গেল। সবার মুখে মুখে একই কথা। এবার আমরা গাইয়ের পাছা ঘোরাব। পরে এটা আমাদের স্লোগানে স্থান পায় : ‘নির্বাচনে জিততে হবে, গাইয়ের পাছা ঘোরাতে হবে’।

এবার এই লেখার নায়কের কথা বলি। মোজাম্মেল শেখ (মোজা)। মোজার বয়স ১৮-১৯ বছর। টগবগে যুবক। সারা দিন ক্ষেতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। পেশিবহুল শরীর। সব সময় হাসিমুখ। এতিম শিশু মমজান আমাদের বাড়িতে বড় হয়েছে। মোজা তার প্রেমে পড়ে এবং আমার দাদা দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেয় বছরখানেক হলো। সে খুব পেটুক। একাই এক সের চালের ভাত খায়। আমার ছোট্টবেলার খেলার সাথি। তবু আমাকে ভাইজান বলে সম্বোধন করে।

অবশেষে এল সেই আরাধ্য দিন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সাল। নির্বাচনের দিন। মওকা মওকা...। সকাল থেকেই চারদিকে সাজ সাজ রব। আমি মেডিকেল কলেজে আমার এক সিনিয়র ছাত্রনেতা আশিক ভাইয়ের কাছে স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন করার কিছু ট্রেনিং পেয়েছিলাম। সেটাই এখানে কাজে লাগিয়েছিলাম। আমরা আমাদের টিমগুলোকে খুবই সুসজ্জিত করে সাজিয়েছিলাম। প্রতিটি বাড়িতে কয়েকজন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের হাতে ওই বাড়ির লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের দায়িত্ব হলো ওই সব ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। সকালে প্রথমত মেয়েদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে যাদের ভোট দেওয়া হয়েছে, তারা তখন অন্য মেয়েদের বাচ্চা রাখতে সাহায্য করবে। তারপর যাবে ছেলেরা। কিন্তু দুপুর নাগাদ দেখা গেল পুরুষ ভোটাররা তখনো ক্ষেতে কাজ করছে। তারা এখনো ভোট দিতে আসেনি। মোজা বারবার বিরক্ত হয়ে ও আশাহত হয়ে আমার কাছে আসছিল এবং বলছিল :

* ভাইজান, গাইয়ের পাছা বোধ হয় আর আমরা ঘোরাতে পারলাম না।
-কেন, কী হয়েছে?
তখন সে বর্ণনা করল যে ক্ষেতে এখনো প্রচুর লোক ভোট দেয়নি।
আমি বললাম, কী করা যায়?

সে বলল, আমি কয়েকজনকে নিয়ে যেয়ে ক্ষেতে কাজ করি আর তাদেরকে ভোট দিতে এখানে পাঠাই।
যেই কথা সেই কাজ। এভাবে মাঠের কৃষকেরা ভোট দিতে পারল। আমরা প্ল্যানমাফিক কাজ করছি। আমরা খুব খুশি ছিলাম যে আমাদের টিম খুব সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছিল। তখন ছিল শীতের দিন। পাঁচটায় ভোট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন প্রায় চারটা বাজে। আমরা সবাই সবার কাজের রিপোর্ট নিচ্ছিলাম। ঠিক সে সময় মোজা উত্তেজিত হয়ে এসে বলল :
* ভাইজান, ওই পাড়ার নয়ার মা বুড়িমা তো ভোট দিতে পারল না।
আমি বললাম, কেন?
* সে তো আজ পনেরো বছর ধরে বিছানায়। প্যারালাইসিস।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। কী করবি আর। সে ভোট দিতে পারবে না।

* না ভাইজান, যদি একটা ভোটের জন্য আমরা হেরে যাই, তবে তো গাইয়ের পাছা আর ঘোরানো যাবে না। আপনি যদি বলেন, আমি তাকে কোলে করে নিয়ে আসি?
-পারবি?

* অবশ্যই পারব।
আধা ঘণ্টা পরে দেখা গেল মোজা বুড়িমাকে কোলে করে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে নিয়ে আসছে। বুড়িমা ভোট দিল।
সেদিন ভোট শেষে দেখা গেল আমরা তিনগুণ ভোটে জয়ী হয়েছি। ওই সেন্টারে নৌকা পেয়েছে ৫২২ আর গোলাপ ফুল ১৬৪।
মোজা দারুণ খুশি। এইবার গাইয়ের পাছা ঘুরবে। তার আর কোনো চিন্তা নাই। সে দুমুঠো খেতে পারবে। এবার সে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে একটা সোনার গহনা বানিয়ে দেবে। কারণ সে প্রতিজ্ঞা করেছে।

দুই.

মধ্য মার্চ ১৯৭১। উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে গ্রামে ফিরলাম ঢাকা থেকে। পরিস্থিতি চারদিকে থমথমে, অনিশ্চয়তার ছায়ায় ঢাকা। কী হয় কী হয়? কী হবে? বাড়ির উঠানে আমাকে দেখামাত্র দৌড়ে এল মোজা। তার মুখে আর সেই হাসি নেই। তার মুখে-চোখে এক অজানা উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার ছায়া লেগেছে।

* কী হবে ভাইজান?

-দেখা যাক। কিছু একটা হবেই। শেখ সাহেব চেষ্টা করছেন।

রাতে আমাদের বাড়িতে রেডিও শোনার জন্য বাইরের উঠানে ১৫০-২০০ লোকের বিরাট এক জমায়েত হয়ে যায় প্রতিদিন, তার মাঝে মোজা সবার আগে। তারপর এল সেই পঁচিশে মার্চ। এই রাতেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপিপাসু সেনাবাহিনী ইতিহাসের বর্বরতম ও কাপুরুষোচিত গণহত্যা চালায়। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, পিলখানার বিডিআর ক্যাম্পে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। ২৬ মার্চ মেজর জিয়ার ঘোষণা শোনা গেল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ঘোষণা দান করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মেজর জিয়া আমাদের মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। এমনি করে চলে গেল একটা মাস। এমনি করে এপ্রিল প্রায় শেষ। আমাদের গ্রামের দু-তিন মাইলের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ। তা পার হলেই ভারত। হঠাৎ খবর এল, আমাদের এদিকেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শত শত যুবক বর্ডার ক্রস করে ভারতে যাচ্ছে। মোজার বউ আমাদের বাড়িতে কাজ করে। হঠাৎ এক সকালে মোজার বউ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হাজির। কী ব্যাপার? সে যা বলল, তার মানে হচ্ছে সে আহাজারি করতে করতে বলল। তার স্বামী মোজা যুদ্ধে গেছে। এখন তার কী হবে? যুদ্ধে যাওয়া মানে আর সে কখনো ফিরবে না। ১২ ডিসেম্বর আমাদের গাইবান্ধা মুক্ত হয়েছে। চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মুক্তির আনন্দ। বিজয়ের আনন্দ। চারদিকে বন্যার মতো শুধু আনন্দ আর আনন্দ। কিন্তু মোজার বউ মমজান এখনো জানে না তার স্বামী মৃত না জীবিত।

সবাই তাকে সমবেদনা জানায়, সাহস জোগায়। কিন্তু সে শুধু আহাজারি করে যে মোজা আর ফিরবে না। আমাদের পাশের গ্রাম পদুমশহরের এক মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়ে মোজা খবর পাঠিয়েছে তার বউকে, তারা কুড়িগ্রামের কোদাল কাটার যুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। সেটাও প্রায় কয়েক মাস আগের খবর। এমনি করে এক কুয়াশাঢাকা সকালে হঠাৎ করে দূর থেকে দেখা গেল কেউ যেন একজন আসছে। আর তার পেছনে পেছনে ১০-২০ জনের বিরাট মিছিল। কাছাকাছি আসার পর দেখা গেল, সে আমাদের মোজা। উষ্কখুষ্ক চুল, কমান্ডো ড্রেস, ঘাড়ে রাইফেল। আমাদের মোজা মুক্তিযোদ্ধা মোজা। কোথা থেকে ওর বউ মমজান খবর পেয়ে দৌড়ে এসে ওর বুকে লাফিয়ে পড়ল আর চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগল। মোজা আমাকে সামনে পেয়ে তার হাতের রাইফেল শূন্যে উঁচিয়ে বলল :

-ভাইজান, এবার গাইয়ের পাছা ঘুরাইছি। জয় বাংলা ॥
-রলি, নর্থ ক্যারোলিনা। ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

কমেন্ট বক্স