হাসিনা আকতার নিগার
একাত্তর দেখিনি, তবে সে সময়ের স্লোগানগুলো আলোড়িত করে মনকে বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের এ অনুভূতিতে বেদনার সুর বেজে ওঠে, একাত্তর ও জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে বিতর্ক হতে দেখলে।
২০১৭ সালে আইনজীবী ড. বশির আহমেদ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে এক রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলার মৌখিক আদেশ দেন।
এ ঘোষণাকে জাতির জন্য আইনগতভাবে প্রত্যাশার আলো হিসেবে মনে করেছিল সবাই। তবে সে আলো তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। কারণ, জয় বাংলা স্লোগানটি রাজনৈতিক মতভেদের কারণে সর্বজনীন হতে পারছে না। আসলে আইনিভাবে কিংবা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দিয়ে সবকিছু করা যায় না। এর প্রমাণ হলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি তোমার আমার সবার না হওয়া। কিন্তু জাতিগতভাবে বাঙালিবোধের আবেগে পীড়াদায়ক। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি, বাংলাদেশÑএ তিনটি শব্দ দিয়ে জাতি লাল-সবুজের পতাকার জন্য লড়াই করেছে ১৯৭১ সালে। আর যুদ্ধের সে সময়টাতে সারা দেশে একটা স্লোগানই বাংলার মানুষকে এক করেছে আর তা হলো ‘জয় বাংলা’। এ স্লোগানটির দৃঢ়তা মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই করার যে শক্তি ও সাহস দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ধর্ম-বর্ণ বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এ দেশের মানুষের কাছে ছিল না। সবার কাছে পরিচয় ছিল একটাই ‘আমি জয় বাংলার লোক’। এমনকি ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালিদের বলা হতো জয় বাংলার মানুষ। আবার সে সময় চোখের একটি রোগকে বলা হতো ‘জয় বাংলা রোগ’।
সাধারণ মানুষের প্রচলিত কথার অনেক ঊর্ধ্বে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মর্মার্থ। ৭ মার্চের ভাষণের শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি আজও শিহরিত করে মানুষকে। এ স্লোগানে উচ্চারিত প্রতিটি অক্ষর বাংলা মায়ের সন্তানদের দেশাত্মবোধকে জাগ্রত করে আপনা হতে। সে কারণে বাংলার মুক্তিসেনারা একাত্তরে যুদ্ধের মাঠে এই একটি স্লোগান দিয়ে পরাজিত করেছে পাকিস্তানিদের।
যে স্লোগানে পুরো জাতি এক হয়েছে, ধমনিতে জেগেছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্পৃহা; সে স্লোগানকে আজীবন ধারণ করতে না পারা বিবেককে দংশন করে দেশপ্রেমীদের। তাদের কাছে মনে হয়, এ স্লোগানকে প্রাণখুলে বলতে গেলে নিজের রাজনৈতিক চিন্তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। তবে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। যে স্লোগানের জন্ম মানুষের দেশপ্রেমের আবেগ থেকে, আজ সে স্লোগানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় আইন ও সংবিধান দিয়ে।
এর কারণ হলো স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া ৭১-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি হয়ে গেল একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ স্লোগান এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও জয় বাংলা স্লোগানকে আর আত্মিকভাবে একাত্ম হয়ে ধারণ করতে পারেনি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষেরা।
এ ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক দলের। তারা নিজেদের স্বার্থে সুবিধামতো ব্যবহার করছে বাঙালির আবেগকে। জাতিকে এক পতাকার তলে রাখার বদলে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটিকে নিষিদ্ধ করা হলো ৭৫-পরবর্তী সময়ে। বলা হলো, এটি আওয়ামী লীগের স্লোগান। রাজনৈতিক মতবিরোধকে প্রাধান্য দেওয়া নেতারা ভুলে গেলেন, বাংলার মাটিতে তারাও লড়াই করেছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে।
তবে নির্মম সত্য হলো, যারা দেশের জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে পারে, তাদের কাছে দুই শব্দের স্লোগানের কীবা মূল্য থাকবে! শুধু তা-ই নয়, এ হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ছিল মুক্তিযোদ্ধা। ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থে অন্ধ হয়ে হয়ে তারা বাঙালির মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি।
অন্যদিকে বাঙাীির দেশপ্রেম এখন রাজনীতিবিদদের খেলার হাতে বন্দী। জয় বাংলাকে দলীয় স্লোগানের ফ্রেমে আবদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ‘জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু’ কোনো দল বা ব্যক্তির সম্পদ নয়। এ চিন্তা আর চেতনাকে আমরা ধারণ করতে পারিনি বলে আজও হাইকোর্টের আদেশের প্রয়োজন হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য।
অথচ ভারতে দলমত-নির্বিশেষে সবাই গান্ধীজির ছবি আর জয় হিন্দ স্লোগানকে যুগ যুগ ধরে ধারণ করে আসছে। এ বিষয়গুলোতে তাদের কোনো মতান্তর নেই। দেশের স্বার্থে জয় হিন্দ বলে তারা এক হয়ে যায়। আর বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে জাতির পিতার ছবির অবমাননা অতীতে বারবার হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ অবমাননা যে হবে না, তা জোর করে বলা যায় না। একই কথা আসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়েও।
হাইকোর্টের আদেশের পর সাংবিধানিকভাবে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’কে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হলেও এর ব্যবহার কিন্তু দলগতভাবেই সীমিত। তাই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের এ নির্দেশ দেখে সাধারণ মানুষের মনে এখনো নানা প্রশ্ন রয়েছে। এখনো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলে এ আদেশ কার্যকর করে তাদের মতো করে। এটাকে সর্বজনীন করতে পারেনি। যদি আগামীতে এ চিত্র না থাকে, তখন আইন কতটা কার্যকর হবে? আরেক রিটে বদলে যাবে কি আদেশ? দেশের সংবিধানে আজ অবধি এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে সংযুক্ত হয়নি। অন্যদিকে গেজেটে ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’কে যুক্ত করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। এসব প্রেক্ষাপটে মানুষের মনের প্রশ্ন অবান্তর নয়।
আবেগ ও আইনের বিপরীতমুখী অবস্থানে মাননীয় আইনজীবীদের এ রিটসমূহ সাধুবাদের যোগ্য। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি জাতির প্রাণকে সঞ্চারিত করেছিল বলে লাল-সবুজের বিজয় পতাকা আকাশে উড়েছিল ১৯৭১ সালে। তাই এ স্লোগানটিকে আত্মিকভাবে ধারণ করে প্রতিটি বাঙালি দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করবে-এটাই প্রত্যাশা সবার কাছে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ কোনো দল বা ব্যক্তির একক সম্পত্তি নয়। এ স্লোগান সারা বাংলার-এ কথাটা রাজনৈতিক দলগুলোকে মানতে হবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর স্লোগান নিয়ে বিতর্ক করা বড় বেশি বেমানান।
কেননা একটি দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা আসে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে। আর বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। তাই বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রযাত্রায় তোমার আমার সকলের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি আত্মার টানে বেজে উঠলেই আপন মনে জাতি উদীপ্ত হবে নতুন এক বাংলাদেশের জন্য। সে উদ্দীপনায় ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার জন্য রাজনৈতিক চিন্তার গরমিল নিয়ে ভাবতে হবে না। কারণ ‘জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু’ এক সুরে গাঁথা একটি স্লোগান।
লেখক : কলামিস্ট