ড. রফিকুল ইসলাম
প্রতিটি শিশুই কাদামাটির মতো। তাই উপযুক্ত শিক্ষাই নির্ভর করে শিশুর ভবিষ্যৎ। ওদের ভবিষ্যৎ খারাপের কিনারায় চলে যায়, যদি মিথ্যার দিকে ধাবিত হয়। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে সত্য বলাকে অনেক অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা বলাকে সবচেয়ে বড় পাপ বলা হয়েছে। এমনও বলা হয়, মিথ্যাই সব পাপের শুরু। দুনিয়ার যত খুনখারাবি, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ, বাটপারির পেছনে শুরু হয় মিথ্যা দিয়েই। তাই মিথ্যা না বলা ও সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সন্তানকে ছোটবেলা থেকে সততা, সত্যবাদিতা শেখানো বাবা-মায়ের দায়িত্বের মধ্যে একটি। কারণ পরিবার থেকেই শিশুর বেড়ে ওঠা, শিশুর অভ্যাস গড়ে ওঠা। ভালো অভ্যাসগুলো ছোটবেলা থেকে শিশুর মাঝে তৈরি করতে না পারলে ছোট ছোট ভুলগুলোই শিশুর পরবর্তী জীবনে বড় কোনো ভুলের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মিথ্যার কারণে বড় কোনো অপরাধের শুরু হতে পারে।
তিন থেকে চার বছর বয়সে শিশুরা মিথ্যা বলে। তবে সেটা যত না মিথ্যা, তার থেকে তার মনের কল্পনা বেশি। আপনার শিশু হয়তো আপনার কাছ থেকে কোনো খেলনা আবদার করছে, আপনি দিতে রাজি নন। তাই সেটা সে আদায় করার জন্য কোনো বন্ধুর উদাহরণ টানল। দেখা গেল সেটা পুরোটাই মিথ্যা। কাজেই মিথ্যা আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য থাকবে। তাই বলে মিথ্যা কল্পনাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকেও সে মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। আবার অনেক সময় আপনার মারধরের ভয়ে বা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে মিথ্যা বলে থাকে, সেটাও ঠিক নয়। আপনার চেষ্টায় শিশুরা সত্যবাদী হয়ে উঠবে, তা যেমন ঠিক নয়, তেমনি আপনি যদি এ সত্য বলা অভ্যাসের দিকে নজর না দেন, তাহলে দেখা যাবে, সে অবলীলায় মিথ্যা বলছে।
কী করে শিশুর মাঝে সততা, সত্যবাদিতার মতো গুণগুলো তৈরি করতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু উপায় কাজে লাগতে পারেন। সত্য, মিথ্যা এবং কল্পনার পার্থক্য শিশুকে ধরিয়ে দিন। কাছের মানুষ হিসেবে আপনি খুব সহজেই তা ধরতে পারবেন এবং সুন্দরভাবে তাকে মিথ্যার খারাপ দিক থেকে বিরত রাখতে পারবেন। সত্য বলায় সাহসী করে তুলুন। সব সময় সত্য বলার উৎসাহ দিন, তা যতই অপ্রিয় হোক না কেন। শিশুকে কখনো সরাসরি এ কথাটি বলবেন না যে তুমি মিথ্যাবাদী।
শিশুদের কিন্তু মান-অপমানবোধ অনেক বেশি। এতে করে সে অপমানিত বোধ করে জেদের বশে বারবার একই ভুল করতে পারে। তাকে খুব শান্তভাবে আদর করে বুঝিয়ে বলুন, সে যা করছে তা ঠিক করছে না কিংবা তাকে সত্য বলার পরিবেশ তৈরি করে দিন, যাতে সে নির্ভয়ে সত্য বলতে পারে। যখন আপনি জানতে বা বুঝতে পারেন, আপনার সন্তান মিথ্যা কথা বলছে, তখন কথা ঘুরিয়ে না বলে সরাসরি কথা বলুন। এক কথা বারবার জানতে চেয়ে কিংবা শিশু সত্য বলার পরও তাকে বারবার জেরা করলে আপনার সন্তানের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে।
শিশু কেন মিথ্যা বলছে, তার কারণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব কিন্তু আপনারই। সে কী কারণে বা কোন ভয়ে মিথ্যা বলছে, তা তার কাছ থেকে বন্ধুসুলভ আচরণে জেনে নিতে চেষ্টা করুন। তাকে অভয় দিন, মিথ্যা বলার কারণ বলে দিলে তার কোনো রকম শাস্তি হবে না। এতে করে আপনিও জেনে নিতে পারবেন কী কারণে আপনার সন্তান মিথ্যা কথা বলছে এবং এ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন। সত্য বলাকে সব সময়ই ভালো চোখে দেখুন, উৎসাহিত করুন। এতে শিশু মিথ্যা বলতে আগ্রহী হবে না।
আদর-ভালোবাসা দিয়ে সত্য বলার দিকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। সত্য বলার জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন। এতে সে উৎসাহিত হবে সত্য বলার জন্য। তবে অবশ্যই মিথ্যা বলার জন্য ভয়ে রাখুন, যাতে সে অন্যায়টা বুঝতে পারে। সন্তানকে বুঝিয়ে দিন, মিথ্যা কখনো কাউকে কোনো বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে না। বরং বড় কোনো বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। তাই যখনই সুযোগ পান শিশুকে বিভিন্ন কৌশলে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিন। এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং খুবই দরকারি। মিথ্যাকে সে মিথ্যা বলা শিখবে। মিথ্যা ছোট আর বড় হোক, তা মিথ্যাই। ছোট ভুল ভেবে সন্তানের কোনো রকমের মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেবেন না। এতে সে ভাববে, মিথ্যা বলা এমন কোনো দোষের কিছু নয়, তাই ভবিষ্যতে আরও বড় মিথ্যা বলতে সাহস পাবে।
যথাসম্ভব সন্তানের সঙ্গে মিথ্যা বলবেন না। এমনকি তার সামনে অন্যদের ক্ষেত্রেও না। অনেকে মোবাইলে অবলীলায় মিথ্যা বলে শিশুর সামনে। তারা ভাবে, শিশুরা হয়তো বোঝে না। সেটা খুবই ভুল ধারণা। শিশুদের বোঝার ক্ষমতা খুবই তীব্র। অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সবার আগে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নিন। সত্য বলার অভ্যাস ও চর্চা কখনোই বিফলে যাবে না। আপনি যদি সন্তানের দিকে এখনই নজর না দিন, তবে ভবিষ্যৎ কিন্তু ভালো নয়। বর্তমান জমানায় শিশুদের নিয়ে খুব সতর্কতায় থাকলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে বাধ্য।
একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠনে অভিভাবকদের বিশাল ভূমিকা পালন করতে হয়। তাদের ব্যক্তিগত আচরণ, পাঠাভ্যাস, সমাজের অন্য মানুষের প্রতি আচরণ, দায়িত্বশীলতা, ক্ষমা ও উদারতার দ্বারা শিশুরা প্রভাবিত হয়। আর শৈশবে যদি একজন অভিভাবক তাদের মাঝে এসব মানবীয় গুণাবলি প্রবেশ করাতে পারেন, তাহলে আজীবন তা শিশুদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে। আর তার জন্য অবশ্যই অভিভাবকদের হতে হবে ব্যক্তিগত লোভ-লালসামুক্ত। সমাজে প্রতিটি সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, উদার, আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করা জরুরি।
শিশুর ধারণক্ষমতা অনুসারে শিক্ষা দিলে সে ভবিষ্যতে কালজয়ী বিশেষজ্ঞ হতে পারবে। কঠোর শাসন, প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর জীবনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেয়। তা ছাড়া আনন্দ হচ্ছে শিশুর শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। শিশুর মনের আনন্দই তার দেহমনের শক্তির মূল উৎস। সুশিক্ষা, নিরাপত্তা, সুস্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও ভালোবাসা দিয়ে শিশুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পূর্ণ বিকশিত করে তুলতে হবে।
পৃথিবীতে কোনো শিশুই বিবেক, নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি মানসিক গুণাবলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। আবার এত সব সে একাকী শিখতে পারে না। তাকে শিক্ষিত করতে হবে। শিশুর সঠিক বিকাশের স্বার্থে তার প্রতি শাসনসুলভ মনোভাব এড়িয়ে গিয়ে বন্ধুসুলভ মনোভাব প্রকাশ করে তার সান্নিধ্যে যেতে হবে। শিশুর সুস্থ বিনোদনের ব্যাপারে পিতা-মাতাকে স্বশিক্ষিত হতে হবে, তাদের ভাবনার জগৎও প্রসারিত করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনও হতে হবে সুদৃঢ়।