দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ৩০০ সংসদীয় আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছিলেন দলটির ৩ হাজার ৩৬২ জন নেতা। তাদের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র ২৯৮ জন। মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অংশ নিচ্ছেন আসন্ন নির্বাচনে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হতে দলীয় প্রার্থীর বাইরে ৪৫৫ জন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে তাদের মধ্যে ২০৭ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যে দেখা যায়, মোট স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন ৭৪৭ জন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা ছাড়া ছিলেন ২৯২ জন। এই ২৯২ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে আবার ২১০ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া নৌকার ২৯৮ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
যাচাই-বাছাই শেষে ৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, ৩০০ সংসদীয় আসনে মোট ২ হাজার ৭১৬টি মনোনয়নপত্র জমা হয়েছিল। তার মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ে টিকেছে ১ হাজার ৯৮৫টি। বাকি ৭৩১ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। তিনি জানান, যাদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, তারা ৫ ডিসেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল করতে পারবেন। ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুনানি হবে। এতে মোট প্রার্থীসংখ্যার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়ার পরও আওয়ামী লীগের প্রায় আড়াইশ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টিকে আছেন। বাদ পড়া ২০৭ নেতার মধ্যে আপিলে অনেকেই প্রার্থিতা ফিরে পেলে সংখ্যাটা তিন শতাধিক হতে পারে। ফলে এবার ভোটের লড়াইটা মূলত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই। ডামি প্রার্থীদের বিষয়ে কেন্দ্রের ইতিবাচক মনোভাব থাকায় বেশ কিছু আসনে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিরা এবার নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হয়েছেন। তাদের অনেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যা বহু হেভিওয়েট নেতাসহ নৌকার প্রার্থীদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। স্বতন্ত্র ও ডামি প্রার্থীদের দাপটে অনেক আসনে কোণঠাসা ক্ষমতাসীন জোটের বাঘা বাঘা নেতারা। কেন্দ্র থেকে ডামি প্রার্থীদের লাগাম টেনে না ধরলে ৭ জানুয়ারি তাদের সত্যিকারের জনপ্রিয়তার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে একধরনের অস্বস্তি।
একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন এমন অন্তত ৭২ জন নেতা এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় জায়গা পাননি।
তাদের অনেকে যেমন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোটে লড়ছেন, তেমনি এলাকায় যারা নিজেদেরকে জনপ্রিয় বলে মনে করছেন, তারাও ভোটে দাঁড়িয়েছেন। বিগত দুটি নির্বাচনে প্রায় একচেটিয়া বিজয় লাভের সমালোচনায় নির্বাচনগুলো নিয়ে বেশ অস্বস্তি রয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলটির মনোনীত প্রার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এবারও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি। পাশাপাশি একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য বিদেশি চাপও রয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ চাইছে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে।
এ জন্যই প্রয়োজনে ‘ডামি’ প্রার্থী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়; স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ প্রয়োগ না করতে দলের প্রার্থীদের তিনি নির্দেশনা দিলেও ইতিমধ্যে একাধিক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ মনে করছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার কৌশল হিসেবে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শেষ বিচারে সেটি ‘একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ অনুষ্ঠানে তাদেরকে সাহায্য করবে।
এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সবাইকে আপাতত অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হলেও প্রয়োজন হলে নির্বাচনের আগে তাদের লাগাম টানারও পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক পড়ায় শঙ্কায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে সম্প্রতি ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা, ফ্রি স্টাইলে হবে না। আমরা দেখি কারা কারা চাইছেন। সেটার ওপর আমাদের একটি সিদ্ধান্ত আছে। আমাদের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের হাতে সময় আছে। কাজেই এর মধ্যে আমরা এখানে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, সংশোধন, অ্যাকোমোডেশন-সবকিছুই করতে পারি।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে দল করেন।
এমন নেতারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
কোন পক্ষে অবস্থান নেবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন তারা। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না এলে এই বিভক্তি স্থায়ী হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকলে তারাই নৌকার প্রার্থীর জন্য ‘বিষফোড়া’ হয়ে দাঁড়াবেন। কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্রদের উৎসাহিত করলে হিতে বিপরীত হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করছেন তারা। নির্বাচনের মাঠে একই দলের একাধিক প্রার্থীর উপস্থিতি বিশৃঙ্খলা এবং দলীয় কোন্দল বাড়াতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।