বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও আমেরিকায় ঋতুর সংখ্যা চার। গ্রীষ্ম,, হেমন্ত (ফল্), শীত এবং বসন্ত। তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে আমেরকাবাসী হিসেবে আমার এখানকার সবচাইতে প্রিয় ঋতু হচ্ছে গ্রীষ্ম আর বসন্ত। বাংলাদেশে অবশ্য আমার প্রিয় ঋতু হেমন্ত আর শীত। আমেরিকায় আমার সবচাইতে অপ্রিয় কাল হচ্ছে শীত। অনেকে এখানকার শীতে বরফ পড়া দেখে আলোড়িত বা মজা পেলেও আমার কাছে এটাকে সেরকম কিছু মনে হয় না। বরং বরফ পড়াকে আমার কাছে অত্যন্ত আপদ বলে মনে হয়। বরফের সঙ্গে তুষার ঝড়ে (Blizzard) জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হাঁড় কাঁপানো শীত আর বরফাচ্ছাদিত সড়কে নিরাপদে চলাচল দুরূহ হওয়ায় বাইরে বেরোতে প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে কাজে-কর্মে বা কারো বাড়িতে যাওয়া রীতিমতো ঝক্কিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর আগে বরফের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে কাজে যাওয়ার সময় আমার গাড়ির চাকা পিছলে যাওয়ায় দুর্ঘটনায় কবলে পতিত হয়। রাস্তায় পাশে গার্ড রেইল থাকায় গাড়ি সমেত নিচে পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলেও গাড়িটি টোটাল হয়ে যায়। তাছাড়া বাড়ির আশেপাশের বরফ ও গাড়ি সাফ করার প্রচণ্ড ঝামেলার কথা নাই বা বললাম।
কিছুটা ঠান্ডার দিক বাদ দিলে আমেরিকায় হেমন্ত বা ফল্ ঋতুটিকেও আমার কাছে মন্দ লাগে না! বিশেষ করে এ সময় প্রকৃতিতে যে বর্ণময় পরিবর্তন ঘটে, তা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
গ্রীষ্মের শেষে এ সময় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) কঠিন দুর্যোগময় শীত আসার বার্তা নিয়ে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। ক্রমেই দিন ছোট আর রাত বড় হতে থাকে। তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৬০-৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে উঠানামা করে থাকে। গরম জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করতে এ সময় বেশ ভালো লাগে। নীল আকাশ, চিলিক দেয়া রোদ দেখতে ও উপভোগ করতে বেশ লাগে। এ সময়টা ফসল তোলা আর তা গোলায় ভরার সময়। কুমড়ো, আপেলসহ নানা ধরনের ফলে-ফুলে ক্ষেতগুলো ভরে ওঠে। সকালে ঘাস আর বৃক্ষের পাতায় পড়ে থাকে শিশির বিন্দু। সেজন্যই বোধ করি ইংরেজ করি কীটস্ এই কালকে The season of mists and mellow fruitfulness বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এ সময় খাবার-দাবারেও আসে বৈচিত্র্য। বিশেষ করে আপেল আর কুমড়ো দিয়ে তৈরি আপেল পাই, পামকিন পাই, স্যুপ, কেক আর পামকিন স্পাইস ও ফ্লেভার দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পানীয় ও খাবার মানুষের রসনা তৃপ্তিতে বড় ভূমিকা রেখে থাকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি পামকিন স্পাইস ফ্লেভারের চা ও লাটে পান করতে দারুণ পছন্দ করি।
অক্টোবর হচ্ছে সেই মাস, যখন মৃদু বাতাসে বৃক্ষের পাতা ঝড়ে পড়ে। October is red, golden and brown অক্টোবরের প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ দর্শনের জন্য ২২ অক্টোবর (রবিবার) নিউইয়র্ক থেকে দেড় ঘণ্টার ড্রাইভে বেয়ার মাউন্টেন স্টেট পার্কে বেড়াতে যাই। সঙ্গে আমার স্ত্রী। ড্রাইভ করে আমার পুত্র সাকিব। কন্যার পেটের পীড়া এবং পুত্রবধূর কাজ থাকায় তারা সঙ্গী হতে পারেনি।
সকাল ১০টা নাগাদ ঘর থেকে বের হয়ে হোয়াইটস্টোন ব্রিজ পার হওয়া মাত্র পথের দু’ধারের বৃক্ষরাজিতে দৃশ্যমান হলো ফলের অপরূপ দৃশ্য। কিছুদিন পূর্বেও যেসব বৃক্ষ সবুজ পত্ররাজিতে আচ্ছাদিত ছিল, সেগুলো এখন বর্ণ পরিবর্তন করে লাল, কমলা, হলুদ, বাদামী ও আরো কতো কী রঙয়ে বর্ণময় হয়ে উঠেছে। হালকা বাতাসে পত্ররাজি গাছের নিচে এবং এদিক-সেদিক ঝড়ে পড়ছিল। মাঝে মাঝে কিছু পাতা আমাদের গাড়ির উইন্ডশিল্ডের উপর দিয়ে উড়ে সড়কের যত্রতত্র ঝরে পড়ছিল।
মাউন্ট ভারনন, স্লিপি হলো, পিক্সকিল ও আরো কিছু এলাকা পাশ কাটিয়ে ঘণ্টা দেড়েক পর আমরা বেয়ার মাউন্টেন স্টেট পার্কে এসে পৌঁছলাম। পথে বহু পাহাড়ের অন্যতম Anthony’s Nose পাহাড় দেখলাম। নিকটবর্তী একটি ব্রিজের কাছে পাহাড়টির আকৃতি মানুষের নাকের মতো দেখতে হওয়ায় পাহাড়ের নামটি এরকম হয়েছে। পাহাড়ে হাঁটার পথ বেয়ে উপরে উঠে সেখান থেকে হাডসন ও মোহাক ভ্যালির ফল ফলিয়েজ দেখার অভিজ্ঞতা এক কথায় মনোমুগ্ধকর। এই পাহাড়টি হাইকিংয়ের জন্য খুবই বিখ্যাত। প্রতি বছর বহু মানুষ এখানে হাইক করতে আসেন। কিন্তু গত বসন্তে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে ভূমিধ্বস হওয়ায় এবার হাইকিং-এর সুযোগ অত্যন্ত সীমিত করা হয়। স্টেট পার্কের পার্কিং লটে গাড়ি রেখে আমরা নিকটবর্তী বেয়ার মাউন্টেন ইন ও ক্যাফেতে চা-কফি খেতে গেলাম। ক্যাফে ছিল পর্যটকে ভরপুর। দিনটি রোদ ঝলমলে হওয়ায় সেদিন পর্যটকের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বেশি। যাহোক, চা-কফি শেষে আমরা ক্যাফের পেছনের হেসিয়ান লেক দেখতে গেলাম। লেক ও লেকের ওপারে পাহাড়ের বর্ণিল বৃক্ষরাজি দেখে আমরা সবাই মুগ্ধ হলাম। এ দৃশ্য দেখার সময় গাছ থেকে ঝরে পড়তে থাকা কয়েকটি পাতা আমার মাথার উপরে এসে পড়লো, যা দেখে অনেককেই মুচকি হাসি হাসতে দেখলাম। তখন ইংরেজি ভাষার কবির একটি কবিতার কথা আমার মনে পড়লো। তিনি লিখেছেন, The tree was empty, no green in sight, until a little leaf grew at night, it was great, then changed to red, tyrned to dark brown and fell on my head.
জানা গেলো, বেয়ার মাউন্টেন পাহাড় হয়ে আমেরিকার বিখ্যাত জর্জিয়া থেকে মেইন পর্যন্ত বিস্তৃত Apalaching Trail চলে গেছে। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এই পাহাড় ও পার্ক দর্শনে এসেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন, এলেনোর ও ফ্রাংকলিন রুজভেন্ট, ডুয়াইট আইজেন হাওয়ার, হ্যারি ট্রুম্যান প্রমুখ।
এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে কারণে এখানে একাধিক চলচ্চিত্রের শুটিং করা হয়। যাদের মধ্যে At First Sigkt ও সোপ্রানো (Soprano) সিরিজের একটি এপিসোড রয়েছে। নিউইয়র্কের একপ্রান্ত থেকে হাডসন ভ্যালি পর্যন্ত বিস্তৃত এই পাহাড় এই রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ল্যান্ডমার্ক এলাকা।
হেমন্ত বা ফলে বৃক্ষরাজি থেকে পত্র ঝড়ার সঙ্গে মানুষের জীবনের কিছুটা মিল লক্ষ্য করা যায়। সবুজ থেকে নানা রং ধারণ করে যেমনিভাবে পত্ররাজি শেষ পর্যন্ত বিবর্ণ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তেমনিভাবে মানুষের ক্ষেত্রেও শৈশব, কৈশর, তারুণ্য, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যে এসে জীবনের সমাপ্তি ঘটে। জনৈক কবি লিখেছেন, I hope I can be the Autumn leaf, who looks at the sky and lived and when it was time to leave, gracefully, it knew life was a gift. Come Autumn, and it’s leaves will turn to red. What I must do is live to see that. This will end the game for me, thoughlife continues all the time.
ঘণ্টাখানেক বেয়ার মাউন্টেনে ঘোরাঘুরি শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। পথে জেফারসম ভ্যালি মলের Great American Cookis থেকে এক বাক্স কেক ও এস্টোরিয়ার বৈশাখী রেস্তোরাঁ থেকে কিছু দেশি খাবার কিনে গোধূলী বেলায় ঘরে ফিরে এলাম। ইনশাল্লাহ আগামী ফলেও কোথাও যাওয়ার আশা রেখে লেখাটি শেষ করছি।
লেখক : কলামিস্ট।