গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্র মানেই সভ্যতা। মানব সম্প্রদায় ও অন্যান্য প্রাণী সম্প্রদায়ের মধ্যকার ব্যবধানের মাপকাঠি হলো গণতন্ত্র। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণীবর্গ যেমন ডাইনোসর কিংবা বিশালাকৃতির সরীসৃপ অথবা বর্তমান বিশ্বের দৃশ্যমান প্রাণীবর্গ হাতি, ঘোড়া, গরু, ছাগল ইত্যাদির গণতন্ত্র আমাদের মানবগোষ্ঠীর কাছে অজানাই রয়ে গেছে। কারণ তাদের ভাষা আমরা জানি না বলে। মানবকুল ব্যতিরেকে অন্যান্য প্রাণীকুলে আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো গণতন্ত্রের প্রবর্তক এসে হয়তো বলে গিয়েছিল, OF THE ANIMALS, BY THE ANIMALS, FOR THE ANIMALS. তাই তো বনে সিংহকে প্রাণীকুলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্য প্রাণীরা মেনে চলে। সিংহ তার নিজস্ব মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রেখে বনে বিচরণ করে।
আমরা মানবকুল বিভিন্ন বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আধুনিক হয়েছি এবং গণতন্ত্রকে ধারণ ও বহন করছি। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র শৃঙ্খলা। গণতন্ত্র মানা মানে শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-অবয়বে আধুনিকতার স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হতে শুরু করে। তখন জনশাসকের কেউ কেউ ব্রিটিশ দৌরাত্ম্যপনা থেকে পালিয়ে এসে নতুন সমাজপ্রথার চিন্তাভাবনা করেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো মনীষী যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সন্নিবেশিত করেন, OF THE PEOPLE, BY THE PEOPLE, FOR THE PEOPLE.
যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে চেয়েছে পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র ও তাদের মানব সম্প্রদায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় গণতন্ত্র মানবের সভ্যতার আধুনিকতম প্রক্রিয়ার সর্বোত্তম একটি। প্রাচীন অনেক তন্ত্র এখনো মানব সম্প্রদায়ে বিরাজমান। তন্ত্র যেমন রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্র অনেক রাষ্ট্রের কাঠামোয় বসতি গেড়ে বসেছে। বিগত শত বছরের কালসীমায় প্রজাতন্ত্রের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে। এই প্রজাতন্ত্রই মানবের মাঝে নিয়ে এসেছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের হাতিয়ার চালিয়ে আমরা নিজ ও অপরের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করি। স্বার্থপরতা ও হীনম্মন্যতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতা থেকে আমাদের সরিয়ে রাখে গণতন্ত্র। একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানব সমাজ তার নিজস্ব চিন্তাধারার প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে সেখানে একটি সুস্থ, শিক্ষিত সমাজ গড়ে ওঠে। সকল মানুষের সমান অধিকার, গণতন্ত্রের এই বেদবাক্য আধুনিক বিশ্বের সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বয়স দেখতে দেখতে ১৬৬ বছর পার করেছে। এ দেশের সংবিধানে গণতন্ত্রের বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুন, বিধিবিধান বর্ণিত হয়েছে সুশৃঙ্খলিত সংবিধানে। আদি সংবিধান রচিত হওয়ার পর বিভিন্ন পর্যায়ে এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন ও সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু কিছু মৌলিক ধারার পরিবর্তনের কিংবা সংশোধনের (AMENDMENT) প্রয়োজন পড়েনি।
গণতান্ত্রিক সংবিধানের নিয়মকানুনের মধ্যে পড়ে রাষ্ট্র পরিচালনযন্ত্রের নিয়োগ-পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উৎকৃষ্ট নিয়ামক নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে ভোটাভুটির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালক নির্বাচন করা হয়। সেই পরিচালক, PRESIDENT/PRIME MINISTER, মানব সমাজের সর্বাপেক্ষা বিচক্ষণ, জ্ঞানী, গুণী হয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র মানে ৫০টি রাষ্ট্র মিলে যে উপমহাদেশ, সেটির পরিচালক নির্বাচিত হতে হলে নির্বাচনের আগে তার যেসব যোগ্যতা ও গুণাবলি তুলে ধরতে হয় হাজার কোটি নাগরিকের সামনে, তা পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় যে সত্যি ব্যতিক্রমধর্মী, তা অবশ্য স্বীকার্য।
৪৬তম প্রেসিডেন্ট পরিচালনা করছেন বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রকে। এর পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যবসা থেকে লাফ মেরে রাষ্ট্রের মাথায়, প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউসে। চার বছর হোয়াইট হাউসে কাটিয়েও তার তৃপ্তি মেটেনি। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার অসাধু আচরণ ও কার্যকলাপে অতিষ্ঠ জনগণ চার বছরের মাথায় তাকে বর্জন করে। নির্বাচনে হেরে গিয়েও হার মানতে নারাজ। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যে নাটক মঞ্চস্থ হয়; শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, সারা পৃথিবী তা প্রত্যক্ষ করেছে। ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় টিকে থাকার তার যে দুরভিসন্ধি, সেটির ফাঁদে এখন হাবুডুবু খাচ্ছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। মিথ্যাচারের ভান্ডারি ছিলেন ট্রাম্প। সিএনএনের হিসাবমতে চার বছরে ট্রাম্প মোট ৩০ হাজার ৫৭৩ বার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য তার সমর্থকদের বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে, MAGA (MAKE AMERICA GREAT AGAIN), যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস ভবন CAPITAL HILL আক্রমণ করে ধ্বংসের জন্য লেলিয়ে দিয়েছিলেন। চারিত্রিক বেহায়াপনায়ও তিনি রেকর্ড ব্রেক করেছেন। তার ব্যক্তিগত উকিলকে ব্যবহার করে তিনি যেসব অসৎ কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, সেসবের দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছিলেন উকিলের ঘাড়ে। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে আদালতে। আর যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে আইন আছে এবং তা প্রয়োগের জন্য আদালত আছে। এই একই প্রেসিডেন্ট দীর্ঘ ৭৭ বছরের জীবনের যে বড় সময় ব্যবসা করে কাটিয়েছেন, সেই ব্যবসায়ে অসংখ্য কারচুপি ও ফাঁকিবাজির আশ্রয় নিয়েছিলেন, আইন বিভাগের তদন্তে সব বেরিয়ে আসছে।
সেই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খায়েশ আগামী ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ফের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবেন। অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী জরিপে দেখা যাচ্ছে, তার প্রতি জনসমর্থনের আদৌ কোনো কমতি নেই। এর পেছনে যে কারণ তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কেবল তার উগ্রবাদী, মৌলবাদী গোষ্ঠীর ৩০ শতাংশের বেশি সমর্থন পাবেন, যদি নির্বাচনের মনোনয়ন পেয়ে যান। কাল্ট লিডাররা (CULT LEADER)যেভাবে তাদের প্রভাব খাটিয়ে হাজার হাজার নরনারীকে মন্ত্রবলে মোহবিষ্ট করে ফেলেন, ট্রাম্পের বেলায়ও তা-ই হয়েছে। ট্রাম্পের মেগা রিপাবলিকানরা একইভাবে তাদের নেতা ছাড়া কিছুই বোঝে না। যেমন হয়েছিল ১৯৭৮ সালে জ্যামাইকার জেইমস টাউনে জিম জোন্স, ১৯৮১ সালে টেক্সাসের ওয়াকোতে ডেভিড কোরেশ এবং একই ১৯৮১ সালে অরিগনের অ্যান্টিলোপের বসতকারী বাবা রজনিশের অনুসারীদের ক্ষেত্রেও।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনের ফল পাল্টাতে ট্রাম্পের অনুসারীরা রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল হিল বলে খ্যাত কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ভবন আক্রমণ করে ভাঙচুর করেছিল। ফলস্বরূপ ৬০০ গুন্ডা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেল খাটছে। তার পরও সেই দলের অগ্রেপ্তারককৃত সদস্যরা প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে দিয়ে পুনরায় হোয়াইট হাউস দখল করার প্রচেষ্টায় রত আছে। ট্রাম্প যে রিপাবলিকান দলের সদস্য, সেই দলের নির্বাচিত কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের বেশ বড় অংশ এত সব কলঙ্কের ধ্বজাধারী প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এর পরিণাম দাঁড়াতে পারে যে ট্রাম্প আবার ২০২৪ সালের নির্বাচনে ফের নমিনেশন পেয়ে যাবেন। মারহাবা, মারহাবা! যদি তা-ই হয়, তবে কি ধরে নিতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান মোতাবেক একজন প্রমাণিত দুষ্কৃতকারীও জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। সংবিধানের ধারা সংশোধন ও পরিবর্তন করে কি একজন দাগি আসামিকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিহত করা যায় না?
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র তার সমুন্নত সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণে নতুন ধারা সংযোজন করুক, যাতে আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে ২০১৬ সালের মতো কালিমা লেপন না হয়, আপামর জনগণ তা চায়।