মোহাম্মদ মুকিত চৌধুরী
হজরত শাহজালালের (রহ.) পুণ্যভূমি সিলেট বিভাগ অনেক সময়ই বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির অন্যতম উদাহরণ। গত ৭ নভেম্বর রাতে সিলেটের দুই মেয়রের একসঙ্গে ডিনার, অভিবাদন জানানো ও একত্রে কেক কাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরল ঘটনা। এই ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ চোখের সামনে ভেসে ওঠার পর দেখলাম, সিলেটের মেয়র পদে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় বিএনপিদলীয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ থেকে নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ মতবিনিময় হয়েছে। দেখে খুব ভালো লাগল এবং মনে হলো আর খুব বেশি দিন নেই, দেশ এগিয়ে যাবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের এ রকম পরিবেশ বাংলাদেশে এখন পুনরায় চালু হওয়া উচিত। বর্তমানে যারা রাজনীতিকদের কাছে থেকে রাজনীতি শিখছেন, তাদের কাছে তো এ রকম ঘটনা অলীক কল্পনা বা স্বপ্ন ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এ রকম একটি পরিবেশ সিলেট বিভাগসহ বাঙালি জাতির সামনে সাহসের সঙ্গে উপহার দেওয়ায় দুই নেতাকে অভিনন্দন।
একটি দেশ বা নদী হাজার হাজার বছর বাঁচে। বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৫৪ বছর।
সে হিসাবে বয়সে আমাদের বাংলাদেশের কিশোর জীবন চলছে। কিশোর দেশে, নাগরিক মানুষের কিশোর বয়সের অভিজ্ঞতায় কিছু ভুল থাকতে পারে। নির্বাচনে কারচুপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এ রকম একটি ভুল। কিছুটা পেছন ফিরে যাই, সে সময় তো পূর্ববঙ্গের জনগণ ছয় দফা দাবির মাধ্যমে শুধু ন্যায়বিচার, সমতা ও স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ভারত তাদের প্রয়োজনে লাঠি, দা-কুড়াল, বন্দুক ট্রেনিং, খাদ্য-বাসস্থান দিয়ে এমনকি সপ্তম নৌবহর বন্ধ করে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করল। স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও জাতীয় পতাকা সবই হয়েছে। তাই ভারত ও ইন্দিরা গান্ধীকে দেশবাসী কর্তৃক এখনো অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য করা হয় না।
আগের কথায় আসি, দুই মেয়রের খুঁটির জোর কোথায়? এ রকম বহু নেতা তো সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাব বজায় রেখে অথবা সংবিধান মোতাবেক পদ সংরক্ষণ করে চলতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। মরহুম রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জনপ্রিয়তা একসময় দেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগে ছিল খুবই তুঙ্গে। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় একবার যখন বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারতে যেতে পারলেন না, তখন থেকে তার জনপ্রিয়তায় ধস নামা শুরু হলো। আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমানের মাজারে কোনো এক বার্ষিকীতে যেতে না পারায় তিনিও মান-সম্মান ও ক্ষমতা হারালেন। এমনকি মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনের দাবি ওঠে। তখনকার বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা জনগণের তুমুল দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলে কী এমন অসুবিধা? তারপর তিনি নিজ দলে ঘরকুনো হয়েছিলেন। এমনকি ব্যারিস্টার হুদার বিষয়ে দলীয় লোকেরাই বলতে শুরু করল, তিনি পাগল, বেহুদা কথা বলেন।
পরের কথা হলো দেশের এসব বিষয় নিয়ে ভাবলে অনেকের শরীরে আজকাল রক্তের চাপ বেড়ে যায়। উপরের এসব সমস্যা যে আমরা মনকে কী দিয়ে বোঝাই, তা বুঝে আসে না। মানুষের দেহে রক্তচাপ কমিয়ে রাখার জন্য জোড়াতালি দিয়ে বোঝানো হলো, আমাদের পুর্বপুরুষদের রক্ত ও ভারতের সহযোগিতায় পাওয়া সোনার বাংলাদেশ যদি হাজার হাজার বছর বাঁচে, তবে ৫৪ বছর কিছুই না। দেশের শিশুকাল চলছে। সত্যিই দেশের শিশুকাল চলছে। তাই ৫৪ বছর বয়সের ইতিহাসে বাংলাদেশ এখনো শিশুরাষ্ট্র। ধীরে ধীরে কিংবা যত দ্রুত সম্ভব দেশে এসব সমস্যার সমাধান হবে।
তবে বাস্তবে যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে নির্বাচনে কারচুপি একটি সমস্যা। নির্বাচনী জট-ঝামেলা সমাধানের লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে এখন তুমুল আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলনকারী সকল দলের সকল রাজনীতিককে এখন দেশের জনগণের কাছে রূপরেখা দিতে হবে। যারা এখন দেশের জন্য আন্দোলন করছেন, জনগণের কাছে গিয়ে পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-শহরে, চৌমুহনায় ভোটারদের কথা দিতে হবে। রাজনীতিকেরা বলবেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে আর কোনো দিন দেশে নির্বাচন অস্বচ্ছ হবে না। তখন আন্দোলন আরও বড় হবে এবং দেশে স্বচ্ছ নির্বাচন হবে। কারণ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ আর অস্বচ্ছ নির্বাচন দেখতে চায় না।
দেশের মানুষ শতভাগ বিশ্বাস করে, ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে, বাংলাদেশে রাতে যদিও ভোট হয়, তবু তা হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
দুই মেয়রের মতো রাজনীতিতে এ রকম বেশ কিছু বিরল ঘটনা ও শুভক্ষণের সৃষ্টি করে আমাদের দেশীয় রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করা অতীব জরুরি। দেশের রাজনীতিতে শুভক্ষণের জন্ম দেওয়ার জন্য তাদেরকে অনেক অভিবাদন ও শুভ কামনা।