Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

প্রবাসী জাগরণে বিপ্লবী ঠিকানা

প্রবাসী জাগরণে বিপ্লবী ঠিকানা

এম এম শাহীন

অমর একুশ বাঙালি জাতির ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়, একুশ হলো একটি চেতনার বীজমন্ত্র। একুশ মানে কারও কাছে মাথা নত না করে মাথা উঁচু করার অঙ্গীকার। একুশ একদিকে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রেরণার উৎস, অন্যদিকে স্বপ্ন, আশা ও ভালোবাসার নাম। একুশ একটি অনুভূতি, বৈশ্বিক পরিচয় ও মহান বিপ্লবের নাম।
সেই একুশের চেতনা লালন ও বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত করার মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘ঠিকানা’ পত্রিকা। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঠিকানা বহির্বিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত ও সর্বোচ্চ কলেবরের পত্রিকা। আপনাদের প্রিয় পত্রিকা ৩৩ পেরিয়ে এখন ৩৪ বছরে। ঠিকানার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভদিনে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই আমাদের অগণিত সম্মানিত পাঠক, গ্রাহক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গসহ শুভানুধ্যায়ীদের। বিশেষভাবে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই পত্রিকাটির প্রাণসঞ্চালনায় অন্যতম শক্তি হিসেবে পাশে থেকে যারা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন, সেই সুপ্রিয় বিজ্ঞাপনদাতাদের। অশেষ কৃতজ্ঞতা রইল বিভিন্ন গ্রোসারি বা ক্যান্ডিশপের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দের প্রতি, যারা ফ্রি পত্রিকা প্রচারে ফ্রি স্পেস দিয়ে আমাদের প্রকাশনার অবিরাম পথচলায় নিঃস্বার্থ সহযোগিতা করে চলেছেন।
আজ থেকে ৩৩ বছর আগে বিশাল স্বপ্ন, বুকভরা প্রত্যাশা আর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঠিকানা। কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদে পদে ছিল পাহাড়সম বাধা। নব্য ও ছোট্ট বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নেই কোনো সাংবাদিক, লেখক কিংবা পৃষ্ঠপোষক। এখনকার মতো তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদ পাওয়া সে সময় ছিল কল্পনারও অতীত। বিশাল এই আমেরিকায় বিচ্ছিন্নভাবে ছিলেন মাত্র কয়েক সহস্রাধিক বাংলাদেশি। তাদের দিনলিপির হাজারো সংবাদ থাকলেও ছিল না সংবাদদাতা। যোগাযোগের অপ্রতুলতা, ভাষার জটিলতা আর মূলধারায় মেশার ব্যর্থতায় পাওয়া যেত না সঠিক কোনো তথ্য। এখনকার মতো তখন ছিল না বাংলাদেশি কোনো গ্রোসারি, রেস্তোরাঁ, ট্রাভেল এজেন্সি, মানি এক্সচেঞ্জ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ড্রাইভিং স্কুল, টিউটরিং, অ্যাকাউন্টিং সার্ভিস, হোম কেয়ার, ফার্মেসি, মসজিদ, মন্দির, কনস্ট্রাকশন কিংবা প্লাম্বার। ছিলেন না ল’ইয়ার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তা, শিক্ষক, কাজী, ইমাম বা মার্কিন প্রশাসনে কর্মরত কোনো বাংলাদেশি। ছিল না ক্লিনিক, স্বাস্থ্যবিমা, ইমিগ্রেশন কিংবা হাউজিং সেবা। দু-একটি সামাজিক সংগঠন থাকলেও ছিল না কোনো রাজনৈতিক সংগঠন।
এ রকম হাজারো প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সাথী করে কেবল মনের জোরে পথচলা শুরু করে ঠিকানা। ওপি-ওয়ান, ডিভি লটারি ও ইমিগ্র্যান্ট ভিসার মাধ্যমে আস্তে আস্তে বাঙালি-বাংলাদেশির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ঠিকানা প্রকাশের পর ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হতে থাকে। চলতে থাকে নানা কর্মসূচি। ঠিকানা ফলাও করে ছাপতে থাকে অনুষ্ঠানের খবরাদি। এতে নীরব কমিউনিটিও নব উদ্যমে জেগে উঠতে থাকে। ঠিকানার দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। বিচ্ছিন্ন নব্য কমিউনিটির মধ্যে যোগসূত্র তৈরির উদ্যোগ নেয় ঠিকানা। দায়িত্বশীল সাংবাদিকেরা বাড়িয়ে দেন তাদের কর্মপরিধি। কালের পরিক্রমায় আজ আমাদের বিশাল কমিউনিটি। শুধু বাংলাদেশি ক্রেতানির্ভর বাংলাদেশি মালিকানাধীন বহুমুখী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন হাজারে হাজার। বাংলাদেশের বাইরে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবচেয়ে বেশি পালিত হয় এই আমেরিকাসহ নিউইয়র্কে।


একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত! ১৯৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বহির্বিশে^, নিউইয়র্কে, সর্বপ্রথম অস্থায়ী শহিদ মিনারে মহান ভাষা শহিদদের সম্মান জানাতে উপস্থিত প্রবাসী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এম শাহীন-এ আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ছবিতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত লীগ অব আমেরিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে- ০১. মি. তালুকদার, ০২. সংগঠনের সাবেক সম্পাদক ও সিলেট গণদাবি পরিষদের প্রধান হাসিব চৌধুরী, ০৩. শফিকুর রহমান, ০৪. কৃতি অ্যাথলেট সাঈদ-উর-রব (ঠিকানার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সিইও), ০৫. পারভীন রহমান, ০৬. বেগম রেহানা রব, ০৭. সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম এম শাহীন, ০৮. নাজনীন শাহীন, ০৯. বেগম আব্দুল মালেক, ১০. সংগঠনের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে প্রয়াত রাণী কবির, ১১. সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি ইলিয়াস কবির, ১২. বিশিষ্ট কমিউনিটি লিডার বান, ১৩. রাজনীতিবিদ আব্দুর রহিম, ১৪. কৌশিক আহমেদ (বর্তমানে বাঙালী সম্পাদক), ১৫. সংগঠক ড. খন্দকার আলমগীর এবং ১৬. নাদিয়া শাহীন


প্রিয় পাঠক, একুশের জাতক ঠিকানার স্বপ্ন ও লক্ষ্য ছিল মানুষে মানুষে ঐক্য তৈরি করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-মেধায় ভরপুর পথ না-হারানো এক বাংলাদেশি কমিউনিটি বিনির্মাণ, যার হাত ধরে প্রবাসীরা নিজেদের নীড় বা প্রকৃত ঠিকানায় পৌঁছাবেন। ৩৩ বছর পর আজও মনের কোণে এই প্রশ্ন জাগে, এত ঘামে-শ্রমে যে ঠিকানা আবর্তিত, তার চাওয়া ও শ্রম কি সার্থক হয়েছে? তবে আজ যখন দেখি জাতিসংঘ (ইউনেসকো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রস্তাবে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে একযোগে দিবসটি পালিত হচ্ছে; তখন গর্বে বুক ভরে ওঠে। যখন দেখি নিউইয়র্কের সাবওয়েতে, বাসে, হাসপাতালে, স্কুলে, ইমিগ্রেশনে, আইআরএসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফর্মে বাংলা স্থান পাচ্ছে, তখন আমরা বলতেই পারি, ঠিকানা সফল। বর্তমানে ঠিকানা ফ্রি হলেও যখন দেখি পাঠকেরা আগের চাইতে আরও অধিক যত্নের সঙ্গে, নিজ সন্তানের মতো করে একে হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, তখন গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।
প্রিয় পাঠক, মাত্র তিন দশকের নব্য বাংলাদেশি কমিউনিটি আজ অভাবনীয় উত্থানে এগিয়ে যাচ্ছে। বহু ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের এই অভিবাসীর মেল্টিং পটে বাংলাদেশিরা প্রতিযোগিতায় কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। মূলধারার নির্বাচনে খুব বেশি সাফল্য না হলেও (নিনা আহমেদ, শেখ আব্দুর রহমান, শাহানা হানিফ, সোমা সায়ীদ ব্যতীত) কমিউনিটির বিভিন্ন ব্যক্তির প্রভাব অতুলনীয়। এ দেশের সম্মানিত সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, গভর্নর, মেয়রসহ স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা আজ আর চাইলেও বাংলাদেশি কমিউনিটিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। বাংলাদেশি বিভিন্ন ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির আহ্বানেও সানন্দে সাড়া দেন তারা। এতেও আমাদের গর্বে বুক ভরে ওঠে। তখন ঠিকানা প্রকাশের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলে ধরে নিই।
আমাদের সাফল্য এখানেই থেমে নেই। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম আজ ঈর্ষণীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে এ দেশের বিভিন্ন করপোরেটে শীর্ষ পদে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়, হাসপাতালে সুনামের সঙ্গে চিকিৎসাসেবায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে, রিয়েল এস্টেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে স্থায়ী ঠিকানা গড়েছেন এবং প্রতিনিয়ত ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শূন্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশি কমিউনিটি আজ বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এক সময় আমার চেনাজানা মাত্র ২০-২৫ জন মিলিয়নিয়ার ছিলেন, আর এখন হয়েছেন ২০-২৫ হাজার মিলিয়নিয়ার। আমার দেখা প্রথম প্রজন্মের সম্মানিত মানুষেরা যেভাবে পরিবারের সদস্য হিসেবে ঠিকানাকে আগলে রেখেছেন, আমার বিশ্বাস তাদের উত্তরসূরিরা- যারা জ্ঞানে-গুণে-মেধায় ও অর্থে অনেক অনেক এগিয়ে, সেই দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও ঠিকানাকে বাঁচিয়ে রাখবেন।
প্রবাসে একটি কথা চাউর আছে, ঠিকানা নাকি বাংলাদেশের ইত্তেফাক! এ কথাটির অর্থ বুঝতে আমাকে বিদগ্ধজনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক যে ভূমিকা, প্রবাসে বাঙালি-বাংলাদেশি জাগরণে একই ভূমিকা পালন করেছে বিপ্লবী ঠিকানা। পাঠকের মূল্যায়নকে সব সময় শিরোধার্য মনে করি। তবু কমিউনিটির উত্থানে ঠিকানার পাশাপাশি অন্যান্য প্রকাশনারও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করি। আমাদের প্রকাশনা-জগতের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চেষ্টা করছি একে অপরের পরিপূরক হয়ে সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে একযোগে কাজ করতে।
ঠিকানার পথচলাটা কখনোই একেবারে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। নানা সময়ে নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ-পরিস্থিতি অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণ বা অর্থনৈতিক দৈন্য যতটা না ভুগিয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভুগিয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কতিপয় কুচক্রী মহল ঠিকানার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমেছে। এমনকি পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধের পাঁয়তারা পর্যন্ত করেছে, যা আমাদের সবচেয়ে বেশি মনঃপীড়া দিয়েছে। কুচক্রীদের এমন ভুরি ভুরি ঘটনার মধ্যে মাত্র দুটি ঘটনা আজকের লেখায় সম্মানিত পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
এক. ১৯৯২ সাল। ঠিকানার বিরুদ্ধে ‘সংগ্রাম পরিষদ’গঠন করে একটি মহল। ঠিকানার কণ্ঠ রোধ করতে এহেন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই, যা করেনি তারা। বড় দুটি রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার নেতৃত্বে এবং ছোট ছোট কয়েকটি দলের বড়কর্তারা মিলে গঠন করেন আহ্বায়ক কমিটি। কিন্তু কী অপরাধ করেছিল ঠিকানা? প্রবাসীদের প্রিয় মুখপত্রটিকে গলাটিপে কেন হত্যা করতে চেয়েছিলেন তারা? ঠিকানার সহকারী সম্পাদক, অত্যন্ত প্রবীণ সাংবাদিক আনোয়ারুল হক (প্রয়াত) ‘জনতার আদালত’ শিরোনামে প্রতি সপ্তাহে একটি কলাম লিখতেন। স্বদেশ ও প্রবাসের নানা বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখতেন বলে পাঠকের নিকট কলামটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। একটি পর্বে তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে তথাকথিত বস্তাপচা রাজনীতি আমদানি করে আমাদের শান্তিপ্রিয় কমিউনিটিকে শতধাবিভক্ত করা হচ্ছে।’ তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে কথাটি ছিল চরম সত্য। এই ‘অপরাধের’ জন্যই তারা গঠন করে সংগ্রাম পরিষদ। শুধু এতেই থেমে থাকেনি তারা, ঠিকানার বিজ্ঞাপনদাতাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। এমনকি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হুমকি-ধামকি প্রদর্শন করে। এ ছাড়া নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন গ্রোসারি ও ক্যান্ডি স্টোরে সশরীরে গিয়ে শেলফ থেকে পত্রিকা নামিয়ে ফেলতে মালিকদের বাধ্য করে। শুধু তা-ই নয়, ঠিকানা বিক্রি করা যাবে না বলে সিটি কর্তৃপক্ষের মতো গ্রোসারির মালিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। স্টোরের মালিকেরা নিরুপায় হয়ে আমাদের সাহায্য কামনা করেন। তৎকালীন সময়ে ঠিকানা প্রকাশের দিন পত্রিকাটি সংগ্রহের জন্য কোনো কোনো স্টোরে শত শত মানুষ সকাল থেকে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতেন। পাঠকের চাপে সম্মানিত গ্রোসারি মালিকেরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পত্রিকা ডেলিভারি বন্ধ না করার অনুরোধ জানান। এমনকি তারা কোনো মুনাফা নেবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। কিছু স্টোরে সরেজমিনে দেখতে পাই, মালিকগণ পত্রিকাটি প্রকাশ্যে না রেখে লুকিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। একপর্যায়ে পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও গ্রোসারির মালিকদের তোপের মুখে সংগ্রাম পরিষদের ‘সংগ্রামীরা’ পিছু হটতে বাধ্য হন। এরই মধ্যে একদিন ৬ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় সংগ্রাম পরিষদের সভা আহ্বান করলে সেখানে ঠিকানার কিছু শুভাকাক্সক্ষীরা প্রতিবাদ জানালে তারা সভা মুলতবি করে স্থান ত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে সমঝোতার অনুরোধ জানালে বিষয়টি মিটমাট হয়।
দুই. আপনাদের নিশ্চয় স্মরণ আছে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে শতাব্দীর জঘন্য ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। নিউইয়র্কের অহংকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসীদের বিমান হামলা আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত আল-কায়েদাসহ কতিপয় মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সরাসরি দায়ী করা হয়। এই কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকায় মুসলমানদের ভয়ানক এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে নিরীহ মুসলিমদের ওপর চলতে থাকে আক্রমণ। আমেরিকায় মুসলিমরা হয়রানি ও প্রাণের ভয়ে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ করে দেন। প্রায় প্রতিটি উপাসনালয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়ে অনেকে গৃহবন্দী হয়ে পড়েন।
একই কায়দায় ঠিকানাকেও ধ্বংস করতে আমাদেরই কমিউনিটির কিছু কুলাঙ্গার ঠিকানা পরিবারের ওপর হামলে পড়ে! তারা ঠিকানা ও দর্পণ অফিসে লেটারবোম (নার্ভ গ্যাস) পাঠায় এবং পে-ফোন থেকে ফোন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায়। ফোন পেয়ে নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগ, এফবিআই, ফায়ার ব্রিগেড, বোম উদ্ধারকারী সদস্যরা পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে।পুলিশ বিভাগের সদস্যরা দুটি অফিস পুরো তছনছ করে এবং ঠিকানায় কর্মরত সকল সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিরাপত্তার নামে নাজেহাল করে।। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদেরই নিরাপত্তার জন্য এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, ঐ ঘটনাটি নিউইয়র্ক টাইমসসহ মূলধারার অনেক মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে।
সেদিন কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর এমন বর্বরোচিত ঘটনা নাইন ইলেভেনকেও হার মানায়। তবে ৯/১১ ঘটনার পরবর্তী সময়ে আমেরিকাকে যেভাবে আরও ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে, ঠিক তেমনি ঠিকানা পরিবারও আরও শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের সামষ্টিক শক্তি কখনো গুটিকতকের নিকট পরাভূত হয় না। অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আজও পথ হারায়নি ঠিকানা, অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীরা নিক্ষিপ্ত হয়েছে সময়ের আস্তাকুঁড়ে। এভাবে যখনই ঠিকানার ওপর কোনো ঝড় এসেছে, তখনই প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন এর অগণিত পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীরা। ঠিকানার ভেতরের শক্তি সর্বশ্রেণির প্রবাসী লেখক ও বিজ্ঞাপনদাতা আর বাইরের শক্তি পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
প্রবাসীদের পত্রিকা হিসেবে প্রবাসী লেখকদের লেখাই প্রাধান্য দিয়ে থাকে ঠিকানা। এই বর্ষপূর্তি সংখ্যার শতাধিক লেখকের প্রায় সবাই প্রবাসী। তাদের মধ্যে যেমন রয়েছেন প্রবাসের স্বনামধন্য কবি, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী; তেমনি রয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, সমাজসেবক, রাজনীতিক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এমনকি গৃহিণীরা। ঠিকানার লেখকদের প্রত্যেকেই শক্তিমান। তাদের তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর লেখনীর মাধ্যমে প্রবাসীরা সঠিক পথের সন্ধান পান ও অনুপ্রাণিত হন। এ জন্য সকল লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন। দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রিকাটির পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছেন ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাদের এই সহযোগিতায় বিরামহীন এগিয়ে চলছে ঠিকানা। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপনদাতারা ঠিকানাকে তাদের নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে বেছে নিচ্ছেন আর পাঠকও ঠিকানার বিজ্ঞাপনে আস্থা রাখছেন। এ জন্য ঠিকানার প্রাণসঞ্চালক বিজ্ঞাপনদাতাদের বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
দীর্ঘ এই সময়ে সহস্রাধিক সাংবাদিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ঠিকানার নিউইয়র্ক ও ঢাকা অফিসে শ্রম ও সময় দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ দুই-তিন দশকও ঠিকানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সময়ের অনিবার্যতায় তাদের অনেকেই এখন ঠিকানায় কর্মরত নেই। আবার অনেকে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। তবে বর্তমানেও অনেক পুরোনো সহকর্মী ঠিকানার সঙ্গে যুক্ত আছেন। নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে দুই অফিসে একঝাঁক অভিজ্ঞ সাংবাদিক ঠিকানার সেবায় নিয়োজিত আছেন। বর্তমান-সাবেক সহকর্মীদের নিরলস শ্রম ও মেধায় ঠিকানা তার বস্তুনিষ্ঠতা ধরে রেখে পথচলা অব্যাহত রেখেছে। ৩৪তম বর্ষে পদার্পণের এই শুভ মুহূর্তে বর্তমান-সাবেক সকল সহকর্মীর প্রতি রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। আর যারা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
পরিশেষে একটাই প্রার্থনা-সকলের সমর্থন-সহযোগিতায় ঠিকানা বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। পত্রিকাটির সম্মানিত পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, গ্রাহক, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে জন্মদিনের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, ঠিকানা, এবং সাবেক এমপি।


কমেন্ট বক্স