হাসিনা আকতার নিগার
আগামী প্রজন্মের হাতে একটি উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ উপহার দিতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। সে জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় একমুখী শিক্ষাপদ্ধতি না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা জটিলতা। সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের সন্তানদের চেষ্টা করে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাতে। এর কারণ হলো এই মাধ্যম বর্তমান বিশ্বের সব দেশে গ্রহণযোগ্য শিক্ষাপদ্ধতি। এই মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধা ও সম্ভাবনা বেশি।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন আসছে বিগত কয়েক বছর যাবৎ। যার ফল হিসেবে শিক্ষার গুণগতমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে। প্রকৃতভাবে এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার হার বাড়ানোর চেয়ে শিক্ষার মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া অতীব জরুরি হয়ে পড়ছে।
প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে শঙ্কা। ফলে ইংরেজি মাধ্যমের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। সে কারণে পারিবারিকভাবে অর্থ জোগাড় করে বা নিজেদের মেধা দিয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করে উন্নত শিক্ষালাভের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যায় তারা। বর্তমানে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় এ ধরনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হলো এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা সুযোগ গ্রহণ করতে পারে বেশি। যেহেতু তাদের ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা হয় আর্ন্তজাতিক মানে এবং তাদের পরীক্ষার ফলাফল উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাচাই-বাছাই করতে পারে সহজে।
দুঃখের বিষয় হলো, বিদেশে অধ্যয়নে আগ্রহী বা অধ্যয়নরত মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই, যা বিশ্বের অনেক দেশে আছে। এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া, ভারতে সে দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি ও ব্যাংকঋণের সুবিধা রয়েছে; যা তারা শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে গিয়ে কিস্তিতে পরিশোধ করে। যদিও ইদানীং বেসরকারি কিছু ব্যাংক অভিভাবকদের লেনদেন বিবেচনা করে লোন দিয়ে থাকে। সেখানে শিক্ষার্থীর মেধার অবস্থান মুখ্য বিষয় নয়। আর এটা সবার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা নিজের সবটুকু সম্বল দিয়ে সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠান। ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়ার পাশাপাশি কাজ করে। এতে করে পড়াশোনা শেষে বিদেশে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ পায় বলে দেশে ফিরে আসে না তারা। এভাবেই দেশের মেধা দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে বিদেশে।
কিন্তু দেশের উন্নয়নকে গতিশীল করতে হলে বিদেশে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের দেশমুখী করার জন্য সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাভিত্তিক বৃত্তি ও লোন প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাপনায় কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতে ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাজ করে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগসহ নানাবিধ ব্যবস্থা করে দেয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে দেশের ছাত্রদের বিদেশে পড়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না।
বিদেশের স্কলারশিপের ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাদের নীতিমালা অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারও বিদেশে অধ্যয়নে ইচ্ছুক বা অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য অন্যান্য দেশের মতো নীতিমালাকে বিবেচনা করতে পারে। এখানে তারা যেভাবে স্কলারশিপ প্রদান করে, তাদের সঙ্গে একইভাবে সংযুক্ত হতে পারে।
অন্যদিকে দেশে অধ্যয়নরত ছেলেমেয়েদেরকে তাদের পরীক্ষার ভালো ফলাফলের জন্য বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা এককালীন বৃত্তি দেয় পুরস্কার হিসেবে, যা পড়াশোনার ব্যয়ে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু এ বৃত্তির ক্ষেত্রে যদি একজন ছাত্রের পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত টিউশন ফিকে মানদণ্ড ধরে প্রদান করা হয়, তবে তা তার কাজে লাগবে অনেকাংশে।
বলা হয়ে থাকে, দেশের মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের শিক্ষাব্যবস্থাপনা কি বলতে পারবে দেশের কতজন মেধাবী ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করছে, কিংবা তাদের সার্বিক অবস্থা কী? নাকি এ বিষয়গুলোকে জানার কোনো প্রক্রিয়া দেশে আছে?
দেশের মেধাকে কাজে লাগাতে হলে মেধাবী ছাত্রদের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এ জন্য তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে হবে। পাশাপাশি তাদেরকে অবশ্যই পড়াশোনা শেষে দেশে এসে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। এ দায়বদ্ধতা অবশ্যই থাকতে হবে বৃত্তি বা আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে। যে যে ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করবে, তার জন্য সে ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
বিদেশে যে স্কলারশিপ দিয়ে থাকে, তা সরাসরি ছাত্রের টিউশন ফি খাতে জমা হয়ে যায় ইউনিভার্সিটিতে। দেশ থেকে প্রাপ্ত স্কলারশিপও একইভাবে প্রদান করা হলে নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্টুডেন্টদের যেভাবে ব্যাংকঋণ দিয়ে থাকে, দেশের ব্যাংকগুলোও একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে। সাধারণত বিদেশে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের স্টুডেন্ট ফাইল করতে হয় ব্যাংকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফিসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর একটি হিসাব ব্যাংকে প্রদান করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সে হিসাব অনুসরণ করে যেসব ব্যাংক স্টুডেন্ট ফাইলের কাজ করে, তারা ছাত্রদের লোন সুবিধা দিতে পারে। কারণ সেসব ব্যাংক তাদের শিক্ষার সকল সনদপত্র গ্রহণ করে নিয়ম অনুসারে। একইভাবে এখানে অঙ্গীকারনামা থাকবে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর। অবশ্যই এর মনিটরিং করতে হবে যথাযথভাবে ব্যাংককে।
এ প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা হয়তো-বা রয়েছে ব্যাংক সেক্টরে। এর পেছনে রয়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। কিন্তু আগামী প্রজন্মকে আমরা যদি সততা আর নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি দেখাতে পারি, তবে তারা অসততা শিখবে না। কারণ বিদেশে পড়া ছেলেমেয়েরা দেশ থেকে গিয়ে যে জীবন দেখে, তা তাদের চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করে দেয় অনেকভাবে। যার কারণে দেশে এসে অনেক কিছুতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পেরে হতাশ হয়ে বিদেশে চলে যেতে চায়।
সরকারি-বেসরকারি খাতে মেধার বিকাশে আরও বেশি সুচিন্তিতভাবে কাজ করতে হবে। পাঁচ হাজার টাকা করে গড় হারে বৃত্তি দিয়ে শিক্ষা খাতে সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলা হলেও ভাবা প্রয়োজন আসলে কী হচ্ছে।
অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে শুধু অর্থের কারণে নিজেকে আগামী দিনের জন্য তৈরি করতে পারছে না। এ খাতে আলাদা একটি সেল গঠন করা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা এবং বৈদেশিক মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করে।
বিদেশে সরকারিভাবে শুধু শ্রমবাজার নিয়ে বৈঠক করার পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারের আলোচনা এবং প্রস্তাবনা রাখা যেতে পারে উন্নত দেশগুলোর সরকার ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
সরকারিভাবে চিকিৎসা ও নানা কারণে যেমন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, তেমনি বিদেশে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সহায়তা দিলে তারাই হবে উন্নয়নের বাংলাদেশের অগ্রপথিক। কারণ তথাকথিত রাজনীতির বাইরে তারা কাজ করবে তাদের মেধা আর অগ্রগামী চিন্তা-চেতনা দিয়ে। ভুলে গেলে চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি না হলে এ স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে না। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দেশের মেধাকে বিদেশমুখী হতে দেওয়া যাবে না। বরং দেশে এনে ব্যবহার করতে হবে শতভাগ।
লেখক : কলামিস্ট