দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। গত ২ নভেম্বর একাদশ সংসদের সমাপনী অধিবেশন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ৯০ দিনের নির্বাচনী যাত্রা চলছে। তবে এখনো কোনো রাজনৈতিক সমঝোতায় আসা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সারা দেশে উন্নয়নের মহড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধসহ সিরিজ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপিসহ এক দফার আন্দোলনের সঙ্গীরা। ইসির কোনো আহ্বানেও সাড়া দিচ্ছে না বিরোধীরা।
এদিকে ১৫ নভেম্বর বুধবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল ঘোষণার লক্ষ্যে ওইদিন বিকেল পাঁচটায় কমিশন সভা আহ্বান করেছে ইসি। এবারই প্রথম সরাসরি জাতির উদ্দেশে ভাষণে এই তফসিল ঘোষণা করবেন সিইসি। বুধবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন তিনি। ১৪ নভেম্বর মঙ্গলবার কমিশনের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ভোটের সম্ভাব্য তারিখ রাখা হয়েছে ৭ জানুয়ারি।
অন্যদিকে এক দিন বিরতি দিয়ে পঞ্চম দফায় ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলের চতুর্থ দফায় ডাকা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হয় ১৪ নভেম্বর মঙ্গলবার সকাল ছয়টায়। ওইদিন বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, আগামী ১৫ নভেম্বর (বুধবার) সকাল ছয়টা থেকে ১৭ নভেম্বর (শুক্রবার) সকাল ছয়টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে হামলা, হত্যা, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৯ অক্টোবর হরতাল এবং ৩১ অক্টোবর, ১ ও ২ নভেম্বর মোট তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের শরিকরা। তারপর ৫ ও ৬ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায়, ৮ ও ৯ নভেম্বর তৃতীয় দফায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করে তারা। আর ১২ নভেম্বর সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয় চতুর্থ দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ, শেষ হয় ১৪ নভেম্বর সকাল ছয়টায়।
গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে টানা ১৭ দিন দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল তিনবার রাষ্ট্র নেতৃত্বে থাকা বিএনপির কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। দলটির সেকেন্ডম্যান বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে। দলের প্রায় কয়েক লাখ নেতাকর্মী হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘরছাড়া। বিএনপির মিডিয়া সেল নিয়মিত ছবি প্রকাশ করে জানাচ্ছে নেতাকর্মীরা পুলিশের ভয়ে ধানখেত, বন জঙ্গলে রাত্রিযাপন করছেন। গ্রেপ্তার এড়িয়ে তারা ঢাকাসহ সারা দেশেই কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যেই চলছে রাজনৈতিক সহিংসতা। দিনে এবং রাতে যানবাহনে সিরিজ আকারে দেওয়া হচ্ছে আগুন। বিরোধী দমনের চিত্রও দৃশ্যায়িত বলে অনেকে মনে করছেন। সরকারবিরোধীদের দায়ী করেছে ক্ষমতাসীন দল। বিরোধীরা এর পেছনে সরকারের ইন্ধন ও পরিকল্পনার কথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে চলছে কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তফসিল ঘোষণা হলেই চূড়ান্ত মুভমেন্টে যাবে বিএনপি। তখন যুপপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে এক ব্যানারে আসারও চিন্তা করা হচ্ছে। শক্তিশালী জোটগুলো থেকে এমন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নির্বাহী কমিটির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, তফসিল ঘোষণা করা হলে অসহযোগ আন্দোলনে যাবে বিএনপি। এটির রূপরেখা কিংবা ধরন কী হবে, তা আগেই যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের আটক করা হলেও এ নিয়ে বিএনপি চিন্তিত নয়। বিকল্প নেতৃত্ব কে দেবেন, তা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। আন্দোলন কঠিন থেকে কঠিন হবেÑসব ধরনের প্রস্তুতি নিতে ঢাকা থেকে সারা দেশে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন বিপরীতমুখী অবস্থানে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে দেশবাসীর মনে। নির্বাচন ঘিরে অজানা শঙ্কায় দিন পার করছে সাধারণ মানুষ।
এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শর্তহীন সংলাপ চায় যুক্তরাষ্ট্র। এই আহ্বান জানিয়ে দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এতে সব পক্ষকেই পূর্বশর্ত ছাড়া সংলাপে বসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। লুর চিঠির বিষয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, চিঠির বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানানো হয়েছে। তিনি দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। আওয়ামী লীগ এখনো কোনো চিঠি পায়নি বলে জানিয়েছে। তবে ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে লেখা মার্কিন সরকারের চিঠি তেমন আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীনরা।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন প্রায় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারত, চীন স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমীকরণ তৈরি হয়েছে। চাপ তৈরিতে দেওয়া হয়েছে র্যাব নিষেধাজ্ঞা। ভিসানীতির পর ভিসানীতির প্রয়োগও শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদেশগুলোও এর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে চাপ তৈরিতেও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তারা চোখ রাঙাচ্ছে। সামনে আরও নেতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত আসার শঙ্কা দেখছেন কূটনীতিকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক, কূটনৈতিক স্বার্থের মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসির দুর্বল ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণা না করতে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দল থেকে আহ্বান করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণা হলে সারা দেশে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। উদ্ভূত সব পরিস্থিতির জন্য কমিশন দায়ী থাকবে বলেও বলা হচ্ছে।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 নূরুল ইসলাম
 নূরুল ইসলাম  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
