আমাদের আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে মিশে থাকা সর্বাগ্রগণ্য নামগুলোর মাঝে হুমায়ূন আহমেদ একজন। লেখার জাদু দিয়ে একটি ভাষার প্রায় সমস্ত পাঠককে মোহিত ও আহিত করে রাখা এই মানুষটির আজ জন্মদিন। হুমায়ূন আহমেদকে বাংলার রোমান্টিক রিয়ালিস্টদের আওতাভুক্ত করা যায়।
উনিশ শতকে শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফুল হয়ে ইউরোপে ফুটেছিল যে রোমান্টিসিজমের ফুল, বাংলা ভাষায় হুমায়ূন আহমেদ প্রথম বাঁকে তার সৌরভ ফেরি করেছেন। দ্বিতীয় বাঁকে, রোমান্টিসিজমকে দিয়েছিলেন একুশ শতকীয় রিয়ালিজমের মাত্রা। রোমান্টিসিজমের অতীত কাতরতা, মূল্যবোধের প্রতি ঝোঁক, জাতীয়তাবাদ, মানুষমুখিতা তাঁর লেখায় ষোলোকলায় বিকশিত হয়েছে এবং প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই পেয়েছে একুশ শতকীয় বাস্তব আঙ্গিক। অসুস্থ উপায়ে বিকশিত পুঁজি তার বিকাশের নিয়মে যে অসমতা তৈরি করেছিল, যার ফলে মধ্যবিত্তের আবির্ভাব, সেই অসমতায় বিষাদগ্রস্ত মধ্যবিত্তের মানবিক সুখকাতরতা হুমায়ূন তাঁর লেখায় নিয়ে এসেছেন।
মধ্যবিত্তের দেয়ালে ঠেকে যাওয়া পিঠ, তাদের অশ্রুসজল চোখ আর নীরব প্রতিবাদ তাঁর লেখায় এত মন আকুল করা আনন্দি-ভাষায় বর্ণিত যে, বাংলাজুড়ে আনন্দাশ্রু চোখে মধ্যবিত্ত মানুষ তাঁকে নিবিড় ভালোবেসে এর ঋণ শোধ করেছে। মধ্যবিত্তের যে ভালোবাসা হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছেন, তার তুল্য ভালোবাসা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কোনো লেখকভাগ্যে দুর্লভ। যে রাজ-আসন ক্রিটিকরা তাঁকে দেননি, মানুষ তাঁকে তা দিয়েছে। আর মানুষের শক্তি যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তাঁর মতো ক্ষমতাবান আর কে হতে পেরেছে! রাজনীতিকদের মুখে অহরহ শোনা যায় তাদের কষ্টকল্পিত বাণী– মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। এই কল্পনা মানুষের সামষ্টিক শক্তির বিপুলতার কাছে তাদের অসহায়ত্বের প্রতীক। হুমায়ূন এই জায়গায় এতটাই সহায় যে, তাঁর হাতে এক অর্থে রাষ্ট্রক্ষমতাই ছিল।
দেশভাগ-পরবর্তী বাস্তবতায় আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি একটি নাগরিক রূপ পাওয়ার পর কিছু আলাদা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে। সেই বিবর্তনের ভেতর প্রগতিশীল বিবর্তন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে পেছনগামী বিবর্তন যা প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিনিধিত্ব করে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সময়ে কথাসাহিত্যিক হিসেবে এই দ্বিতীয় প্রতিনিধিত্বের বিরুদ্ধে একা লড়েননি। লড়েছেন সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, হুমায়ুন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসনাত আবদুল হাই, শহীদুল জহির, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইমদাদুল হক মিলনসহ আরও অনেকে।
যার যার ক্ষমতা ও বিশেষত্বের জায়গা থেকে এই লড়াইয়ে প্রত্যেকেই তাদের সবটুকু দিয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী নির্মাণ করেছেন যার যার নিবেদিত পাঠকদের ভাষা ও বোঝাপড়ার কাঠামো। এদের ভেতর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ-সক্ষমতার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে এগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন একান্তই এ দেশীয় নাগরিক মানুষের পালসের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সমসুর হয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই। এখানে লেখকের সক্ষমতার অংশ সামান্য, বড় অংশটা প্রকৃতির দৈবচয়ন। হুমায়ূন আহমেদ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আসা একটি স্বাধীন দেশের কোমল মানসিকতার প্রায়-বিকশিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সমাজে যেন ঠিক সময়ে ঠিক মানুষটি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কোনো কোনো শিল্পীর জীবনে প্রকৃতির এই দৈবচয়ন নায়কোচিত ইতিহাস তৈরি করে, আর কোনো কোনো শিল্পীর জীবনে তৈরি করে ট্র্যাজেডি। দিনের শেষে হুমায়ূন আহমেদ নায়কোচিত ইতিহাসের কুশীলব।
মানুষ জটিল ধরনের ভাষিক জীব। ভাষা তাকে অলক্ষ্যে লক্ষ্যের দিকে চালিত করে। একটি দেশে কোনো একজন লেখক বা চিত্রশিল্পী কখনও গোটা মানব সমাজের মানস-জগৎকে উন্নত বা অবনত করতে পারেন না। এখানে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজসংস্কারকসহ সমাজের প্রত্যেক প্রভাববিস্তারকারী চরিত্রের মিলিত অবদান থাকে। কে কার কাজটি সততা বা অসততার সঙ্গে করছেন তার ওপর নির্ভর করে গণমানুষের সম্যক আচরণ, রুচি, বাদ-প্রতিবাদের ভাষা ও দুঃখ-সুখের উপলক্ষ। মানুষের সাধ্যের সীমাবদ্ধতা আছে। তার মধ্য থেকেই হুমায়ূন আহমেদ যতটা পেরেছেন নিজ দায়িত্বটি সততার সঙ্গে পালন করেছেন।
স্বাধীনচেতা নারী, ত্যাগী নায়ক, যুক্তির মূর্ত প্রতীক শিক্ষক– কী পোশাকে, কী ভাবনায়, হুমায়ূন তাঁর সৃষ্ট জগতে নির্মাণ করে গেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। পৃথিবীর সমস্ত তত্ত্বের চেয়ে, পৃথিবীর সকল ধর্মের চেয়ে একজন মানুষের জীবন মূল্যবান। হুমায়ূন আহমেদ মানুষের সমাজে মানুষের মূল্য সর্বাগ্রে রাখা একজন আর্টিসান। তিনিই বোধহয় এ মুহূর্তে একমাত্র লেখক, যার প্রায় সৃষ্ট সাহিত্যের প্রায় সমস্তই এই সময়ের মধ্যতরুণ যারা, তাদের আত্মস্থ। খেয়ালি চরিত্রের ছদ্মবেশে প্রগতি ও ত্যাগী সমাজচেতনার যে বীজ তিনি ভালোবাসায় ভেজানো পাঠকের হৃদয় মাটিতে বপন করে গেছেন, যথাসময়ে, যথাস্থানে, তা একদিন বিপুলা বৃক্ষ হয়ে উঠবেই।
এমন একজন লেখকের ৭৬তম জন্মদিনে সমস্ত বাংলা ভাষী মানুষের পক্ষ থেকে তাঁকে অন্তস্ত ভালোবাসার সবটুকু জানাই।
ঠিকানা/এসআর