Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা!

কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা!
মুহম্মদ শামসুল হক : অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার অন্তর্গত দেবানন্দপুর গ্রামে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। নিয়তিলাঞ্ছিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয় বর্ণনাতীত অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। এফএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বে আর্থিক সংকট তুঙ্গে ওঠায় শরৎচন্দ্রের পক্ষে ফাইনাল পরীক্ষার ফি জোগানো সম্ভব হয়নি। অগত্যা তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয় এবং তার ছাত্রজীবনের ইতি ঘটে। আচারনিষ্ঠ ও উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুরতা, নানাবিধ অনাচার, কুসংস্কার এবং ধর্মের নামে কপটচারিতার প্রতি চরম বিদ্বেষী শরৎচন্দ্র এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সময় সন্ন্যাসীবেশে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। অবশেষে ভাগ্যলক্ষ্মীর অন্বেষণে তিনি ১৯০৩ সালে মিয়ানমারে গমন করেন এবং রেঙ্গুনে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দপ্তরে করনিক পদে নিয়োগ লাভ করেন।

রেঙ্গুনে অবস্থানকালেই বিধাতাপ্রদত্ত সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী শরৎচন্দ্র সাহিত্যসাধনায় মনোনিবেশ করেন এবং অল্প দিনেই পরিচিতি ও খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। ১৯১৬ সালে সাড়াজাগানো কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সাহিত্যসাধনায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে পড়েন। গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবেও সর্বমহলে শরৎচন্দ্রের ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পরাধীনতার জিঞ্জিরাবদ্ধ ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের শৃঙ্খলমুক্তির লক্ষ্যে শরৎচন্দ্র কিছুকাল সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনীতি ত্যাগ করলেও আমৃত্যু ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন শরৎচন্দ্র। বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রীতিমতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং তার জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। ব্রিটিশ বেনিয়াদের পাশবিক প্রবৃত্তি ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি নিপুণ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আচারনিষ্ঠ হিন্দুসমাজে পুরোহিতদের দৌরাত্ম্য এবং জমিদারদের বর্বরতার নিখুঁত ভাষাচিত্রও অঙ্কিত করেছেন বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। হিন্দু পুরোহিত সম্প্রদায় এবং জমিদারগোষ্ঠী চরম প্রতিবাদী শরৎচন্দ্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল বলেও জানা যায়। শরৎচন্দ্রের অমর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাঁকে ডি’লিট উপাধিতে ভূষিত করে। শরৎচন্দ্রের বড়দিদি, মেজদিদি, বিরাজ বৌ, বিন্দুর ছেলে, সধবার একাদশী, পণ্ডিতমশাই, পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, বিপ্রদাস, গৃহদাহ, দত্তা, শেষ প্রশ্ন, ছবি, পথের দাবী, দেনা-পাওনা ইত্যাদি কালোত্তীর্ণ গ্রন্থে তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সংগতি-অসংগতির দৃষ্টিগ্রাহ্য ভাষাচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ১৯৩৮ সালের ২৬ জানুয়ারি বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র জীবনবৃত্তের কক্ষচ্যুত হন।

স্মর্তব্য, আদিম অরণ্যচারী ও গুহাবাসী মানবগোষ্ঠী অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার করে কর্দমাক্ত জলাভূমি ও শ্বাপদসংকুল বন-বাদাড় উজাড় করে মানব সমাজ ও সভ্যতার ভিত রচনা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্ববাসী আদিম মানবগোষ্ঠীর শ্রম ও ঘামের অবদান ঘৃণাভরে অস্বীকার করেন। তদ্রƒপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের শ্রম-ঘাম, নিরবচ্ছিন্ন সাধনা এবং মননশীল সাহিত্যকর্মের অবদানে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। অথচ নিয়তির নির্মম বিধানে এই প্রাতঃস্মরণীয় কবি-সাহিত্যিক-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-প্রবন্ধকারদের অনেকেই বর্তমানে চরমভাবে উপেক্ষিত এবং বহুলাংশে বিস্মৃতপ্রায়। তাই ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁরই ‘হরিলক্ষ্মী’ নামক গল্পগ্রন্থ থেকে ‘মহেশ’ গল্পের সংশোধিত ও সংক্ষিপ্ত অংশবিশেষ ঠিকানার পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

গ্রামের নাম কাশীপুর। বৈশাখের শেষ পর্যায়ে অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। সম্মুখের দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলে-পুড়ে ফুটিফাটা হয়ে আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়ে ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে। এরই সীমানায় পথের ধারে গফুর মিঞার বাড়ি। তার মাটির প্রাচীর পড়ে গিয়ে প্রাঙ্গণে এসে পথে মিশেছে এবং অন্তঃপুরের লজ্জা সম্ভ্রম পথিকের করুণায় আত্মসমর্পণ করে নিশ্চিত হয়েছে। গফুরের নিত্য অনটনের সংসারে আছে বছর দশেকের মা-মরা মেয়ে আমিনা এবং বলদ মহেশ। বিঘে চারেক জমি গফুর ভাগে চাষ করে। উপর্যুপরি দু সন অজন্মা-মাঠের ধান মাঠে শুকিয়ে যাওয়ায়, বাপ-বেটিতে দুবেলা দুটো পেটভরে খেতে পর্যন্ত পায় না। কাহনখানেক খড় এবার গফুর ভাগে পেয়েছিল, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বাবত কর্তামশায় সবে ধরে রাখায় বৃষ্টি-বাদলে খড়বিহীন চালের নিচে বাপ-বেটি ঘরের কোণে বসে রাত কাটায়। তদুপরি কয়েক দিন অনবরত জ্বরে গফুর শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় মহেশকে খেতে দিতে পারে না। আবার জমিদার শিবচরণ বাবু শ্মশানধারে গাঁয়ের যে গোচরটুকু ছিল, তাও পয়সার লোভে জমা-বিলি করে দিয়েছেন। তাই চরে বেড়ানো এবং ঘাসের অভাবে দিনে দিনে মহেশ অস্থিচর্মসার হয়ে ওঠে। একদা ক্ষুধার তাড়নায় মহেশ দড়ি ছিঁড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পীড়িত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গফুরকে কন্যা আমিনা জানায় যে গো-ব্রাহ্মণে ভক্ত মাণিক ঘোষের বাগানে ঢুকে মহেশ গাছপালা নষ্ট করায় মহেশকে দরিয়াপুরের খোয়াড়ে দেয়া হয়েছে। বিচলিত গফুরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। অনন্যোপায় গফুর রাতের অন্ধকারে নিজের পিতলের থালাটি বংশীর নিকট বন্ধক রেখে একটি টাকা ধার করে এবং মহেশকে বসতবাড়িতে ফিরিয়ে আনে। পরদিন ২ জন কসাই নগদ ১২ টাকা গফুরের হাতে গুঁজে দেয় মহেশের মূল্য বাবত। অপত্যস্নেহবশে গফুর মহেশকে কসাইর হাতে তুলে দিতে পারে না এবং কসাইর দেয়া টাকা ছুড়ে ফেলে দেয় এবং মহেশের গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রুবিসর্জন করে।

জ্যৈষ্ঠ প্রায় শেষ। জ্বর থামার ৪/৫ দিনের মাথায় গফুর কাজের সন্ধানে বের হয়। কাঠফাটা রোদের মাঝে দুর্বল শরীরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর ব্যর্থ- পিপাসার্ত ও ক্লান্ত গফুর বাড়ি ফিরে এবং প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই আমিনার কাছে ভাত চায়। রান্না না হওয়ায় গফুর রাগত স্বরে জল চায়। কিন্তু গৃহে তৃষ্ণার জল পর্যন্ত না থাকায় গফুর আত্মসংবরণে ব্যর্থ হয়ে আমিনার গালে একটি চড় কষিয়ে দেয়। আমিনা টুঁ শব্দও করে না। মাটির শূন্য কলসিটি তুলে নিয়ে সেই প্রচণ্ড রোদের মাঝেই চোখ মুছতে মুছতে মুছতে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। আমিনা চোখের আড়াল হতেই গফুরের বুকে শেল বিঁধে। গ্রামের পুকুরগুলো একেবারেই শুষ্ক। কোনো কোনো জলাশয়ের মাঝখানে দু-একটা গর্ত খুঁড়ে যা কিছু জল সঞ্চিত হয় তাতে যেমন কাড়াকাড়ি, তেমনি ভিড়। বিশেষত মুসলমান বলে এই ছোট মেয়েটা তো কাছেই ঘেঁষতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দূরে দাঁড়িয়ে বহু অনুনয়-বিনয়ে কেউ দয়া করে যদি তার পাত্রে একটু জল ঢেলে দেয়, সেইটুকুই ঘরে আনে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে গফুরের নিজের চোখও জলে ভরে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমিদারের পিয়াদা যমদূতের মতো এসে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকেÑগফুর ঘরে আছিস। ক্ষুধা-তৃষ্ণাজর্জরিত গফুর তিক্ত কণ্ঠে বলে, আছি, কেন? বাবু মশায় ডাকছেন, আয়। গফুর বলে, আমার খাওয়া-দাওয়া হয়নি, পরে যাব। পিয়াদা বলল, বাবুর হুকুম, মারতে মারতে টেনে নিয়ে যেতে। আত্মবিস্মৃত গফুর অকস্মাৎ রাগের মাথায় বলে, মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারও গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি, আমি যাব না। মহারাণীর দোহাই নিঃস্ব গফুরের ক্ষেত্রে শুধু বিফল নয়, বিপদেরও কারণ হয়। পিয়াদা গফুরকে অর্ধচন্দ্র দিতে দিতে জমিদারের বাড়ি নিয়ে যায় এবং লোকজন অসহায় গফুরকে রীতিমতো সাপমারা করে ছাড়ে। নির্বিবাদে অসহায় গফুর প্রহার এবং লাঞ্ছনা সহ্য করে। বাড়ি ফিরে চোখ-মুখ ফোলা গফুর ঘরে গিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা কাঠফাটা জ্যৈষ্ঠের মধ্যাহ্ন আকাশের মতোই জ্বলতে থাকে। উল্লেখ্য, দড়ি ছিঁড়ে মহেশ জমিদার শিবচরণবাবুর প্রাঙ্গণে ঢুকে ফুলগাছ খেয়েছে, শুকোতে দেয়া ধান ছড়িয়ে নষ্ট করেছে এবং বাবুর ছোট মেয়েকে ফেলে পলায়ন করেছে বিধায় গফুরকে এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়।

অকস্মাৎ প্রাঙ্গণ থেকে মেয়ের আর্তকণ্ঠ শোনামাত্রই গফুর সবেগে উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে বাইরে এসে দেখে, আমিনা মাটিতে পড়ে আছে এবং তার বিক্ষিপ্ত ভাঙা ঘট থেকে জল ঝরছে। আর মহেশ মাটিতে মুখ দিয়ে সেই জল মরুভূমির মতো যেন শুষে খাচ্ছে। চোখের পলক পড়ে না, গফুর দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। মেরামত করার জন্য সে আগের দিন লাঙলের মাথাটা খুলে রেখেছিল, তা দিয়ে মহেশের অবনত মাথার ওপর সজোরে আঘাত করে গফুর।

মাত্র একটিবার অস্থিচর্মসার মহেশ মাথা তোলার চেষ্টা করে, তারপর এর অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণ দেহ ভূমিতলে লুটিয়ে পড়ে। চোখের কোণ বেয়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু এবং কান বয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ে। বার দুয়েক তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে, তারপর সম্মুখ ও পশ্চাতে পা দুটি তার যত দূর যায় প্রসারিত করে দিয়ে মহেশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আমিনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, কী করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল। গফুর নড়ল না, জবাবও দিল না। শুধু নিমিষে চক্ষে আর একজোড়া নিমেষহীন গভীর কালো চক্ষের পানে চেয়ে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে রয়। সংবাদ পেয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গ্রামান্তের মুচির দল আসে এবং বাঁশে বেঁধে মহেশকে ভাগাড়ে নিয়ে যায়। গফুর সারাক্ষণ হাঁটুর ওপর মুখ রেখে ঠায় বসে থাকে।

অনেক রাতে গফুর মেয়েকে তুলে বলে, আমিনা, চল আমরা যাই। সে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ মুছে উঠে বসে বলে, কোথায় যাব? গফুর বলে, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে। মেয়ে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রয়। ইতোপূর্বে অনেক দুঃখেও তার পিতা কলে কাজ করতে রাজি হয়নি। সেখানে ধর্ম থাকে না, এ কথা সে বহুবার শুনেছে। গফুর বলে, দেরি করিস নে মা, অনেক পথ হাঁটতে হবে। আমিনা জল খাওয়ার ঘটি ও পিতার ভাত খাওয়ার পিতলের থালাটি সঙ্গে নিতে চায়। গফুর নিষেধ করে, ও সব থাক মা; ওতে আমার মহেশের প্রায়শ্চিত্ত হবে। অন্ধকার গভীর নিশীথে গফুর মেয়ের হাত ধরে বের হয়। এ গ্রামে তার আত্মীয় কেউ ছিল না। কাকেও বলার কিছুই নেই। আঙিনা পেরিয়ে পথের ধারে সেই বাবলাতলায় এসে গফুর থমকে দাঁড়িয়ে সহসা হু হু করে কেঁদে ওঠে। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলে বলে, আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিও। কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনও মাফ করো না।

স্মর্তব্য, আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গফুরের মতো প্রান্তিক চাষি সম্প্রদায়ের প্রতি তৎকালীন আচারনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ, জমিদার এবং শাসকদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার কাহিনি ‘মহেশ’ গল্পে নিপুণ শিল্পীর তুলিতে চিত্রিত করেছেন। সময়ের ব্যবধানে ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে; কিন্তু গফুর-জাতীয় প্রান্তিক চাষি এবং নিয়তিলাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তা মূল্যায়নের দায়িত্ব ঠিকানার সদ্বিবেচক পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করা হলো।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

কমেন্ট বক্স