দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আড়াই মাস বাকি। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে তফসিল এবং জানুয়ারির প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হবে ভোট। বিএনপির একসময়কার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন-পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ রাজপথ দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও ঢাকায় সমাবেশ করেছে। ওইদিন সমাবেশের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পুলিশের অনুমতি পেলেও পায়নি জামায়াত। অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও শাপলা চত্বরে সমাবেশ করতে অনড় ছিল তারা। তবে পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে শাপলা চত্বরে যেতে পারেননি দলটির নেতাকর্মীরা। ওইদিন দুপুরে নটর ডেম কলেজের সামনে সমাবেশ করে তারা। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর মুক্ত আকাশে সমাবেশ করছে জামায়াতে ইসলামী। আজ সেই ২৮ অক্টোবর, যেদিন লগি-বৈঠা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছিল। আমরা প্রতিশোধ নিতে চাই, তবে হত্যার বদলে হত্যা নয়। কোরআন ও সুন্নাহর আইন চালু করে প্রতিশোধ নেব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোনো নির্বাচন হবে না জানিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, জীবন দিয়ে হলেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাবেশে আসার পথে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি জামায়াতের আমিরসহ গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তাদের বেশ কিছু নেতাকর্মী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে নিহত হন। দিনটি উপলক্ষে প্রতিবছরই রাজপথে ঝটিকা কর্মসূচি পালন করছে রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত জামায়াত। এবার সরকার পতনে নতুন যাত্রা হিসেবে ঢাকায় তারা প্রকাশ্যে রাজপথে অবস্থান করে। ২৮ অক্টোবর সমাবেশ করার পর বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচিও পালন করছে তারা। এখন থেকে রাজপথে শক্ত কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় পর্যন্ত সিরিজ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে।
জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, গত প্রায় তিন মাস আগে পল্টন ট্র্যাজেডিকে সামনে রেখে ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচি চূড়ান্ত করে তারা। ঢাকাসহ সব বিভাগীয় অঞ্চলেও তাদের সিরিজ প্রস্তুতি মিটিং হয়। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই তারা ঢাকায় আসে। কীভাবে তারা ঢাকায় আসবে, কোথায় কীভাবে অবস্থান করবে, প্রশাসনের ধরপাকড় কীভাবে মোকাবিলা করবেÑএসব কৌশল আগেই নেতাকর্মীদের বলে দেওয়া হয়। দলের নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে কয়েক স্তরে কৌশল নির্ধারণ করা হয়। সারা দেশ থেকে জনবল ঢাকায় আসতে কোটা দেওয়া হয়।
এদিকে মহাসমাবেশের তিন দিন আগে থেকেই সরকারের পদত্যাগ, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণসহ সাত দফা দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে শক্তির জানান দেয় জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। গত ২৬ অক্টোবর তারা নোয়াখালী, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, চাঁদপুর, পঞ্চগড়, ফরিদপুর, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফেনী, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাইবান্ধা, যশোর, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ ও ঝিনাইদহ জেলায় শোডাউন করে। মিছিলোত্তর সমাবেশে শিবিরের নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ যদি আগামীতে আবারও অবৈধ পন্থায় রাতের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, এবার আর সেই সুযোগ দেওয়া হবে না। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তা মোকাবিলা করা হবে।
রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক কৌশলে নির্বাচন-প্রক্রিয়ার বহু কিছু পর্দার আড়ালে হয়ে গেছে। এর অধিকাংশ বিষয়ের সঙ্গে জামায়াত যুক্ত ছিল না। এখন রহস্যাবৃত জামায়াতকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি রাজপথে নামিয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে কি না, এটা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপি চরমোনাই, খেলাফত মজলিসের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে তাদের ছাত্র-যুব সমাবেশ, শ্রমিক সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে। জামায়াতের বিকল্প হিসেবে বিএনপি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। কিন্তু বিএনপি যে জামায়াতকে মাঠে নামাবে, তা অনেকেই মনে করছেন না। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল কিংবা অন্য কারও ইশারায় যে জামায়াত মাঠে নামছে না, তা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অনেকে আশঙ্কা করে বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে পর্দার আড়ালে অনেক পথ এগিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল সবকিছুতে আগ্রহী নয়। তারা জামায়াতকে মাঠে নামার সিগন্যাল দিয়ে পছন্দমতো কোনো পথ তৈরি করবে, তাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ ধারণা করছেন, বিএনপি যদি শেষ সময়ে এসে নির্বাচনে না যায়, তাহলে সরকারবিরোধী অবস্থানের বার্তা দিয়ে জামায়াতকে মাঠেও নামাতে পারে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির শামসুল ইসলাম বলেন, ভোটবিহীন সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে। আজ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই সরকারের বিদায় না হওয়া এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না। সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। দেশে দুর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।