মোহাম্মদ এন মজুমদার 
আমার জন্ম বাংলাদেশের একটি গ্রামে, নাম দক্ষিণ আনন্দপুর। এটি ফেনী জেলার তৎকালীন ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্গত বর্তমানে ফুলগাজী থানায়। একটি সুন্দর গ্রাম। শৈশবে আনন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আনন্দপুর উচ্চবিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা করি। ১৯৬৩ সালের ৩০ অক্টোবর আমার জন্ম, যদিও এটি এসএসসি পরীক্ষার সময় নিবন্ধিত। স্কুলের শিক্ষকদের অনুমান করে দেওয়া। ধর্মীয়, প্রথাগত বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আমি কখনো জন্মদিন পালন করিনি বা কেউ পালন করেননি। জীবনের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক বন্ধুর গিরিপথ পেরিয়ে মনে হয় যেন খুব দ্রুতই ৬০ বছর পূর্ণ করলাম। মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট এর জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ, কৃতজ্ঞ আমার স্নেহময়ী মা-বাবা, ভাইবোন যাদের স্নেহ, মায়া ও মমতায় আমি বড় হয়েছি। সুযোগ্য স্বামী, পিতা, আইনজীবী, সমাজকর্মী, পাবলিক সার্ভেট, লেখক, টিভি ব্যক্তিত্ব, মফস্বল সাংবাদিক, কমিউনিটি লিডার হিসেবে একই ব্যক্তি বহু পদে পদাসীন হতে পেরেছি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর অহর্নিশ জেগে অধ্যয়নের পড়াশোনা, কর্মজীবনে নিউইয়র্কে একসঙ্গে চাকরি, সমাজকর্ম ও ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছি এবং একই মাথায় বহু টুপি পরে যাচ্ছি। এসবের কর্তৃত্ব অংশীদার আমার স্ত্রী রেক্সোনাও।
শৈশবের স্মৃতির মধ্যে মধুর স্মৃতি হচ্ছে রোজ গ্রামের মধ্যে মাঠে হাডুডু খেলা, হাইস্কুল ক্লাসমেটদের সঙ্গে রাতারাতি আড্ডা। মায়ের বানানো পিঠা আর মাছ-ভাত খাওয়া। কষ্টের স্মৃতি হচ্ছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন মা-বাবার হাত ধরে ছোট ছোট বোনদের নিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে মৃত্যুভয় ও ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ানো, অনেককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেখে দৌড়েছি। পাক হানাদারদের তাণ্ডবলীলা, হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতনের বিভীষিকাময় স্মৃতি আজও হৃদয় ও মনকে শিহরিত করে তোলে। আনন্দপুর উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় রাত জেগে পড়াশোনা, সর্বোপরি এসএসসিতে সেকেন্ড গ্রেডে পাস করার স্মৃতি আমাকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করেছে।
ফেনী সরকারি কলেজে অধ্যয়ন, কলেজে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা, ছাত্রলীগ (জাসদ) ফেনী কলেজ শাখার ১৯৮০-১৯৮২ সালের কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন আমাকে দেশের রাজনীতি, সমাজকর্ম ও বহু জনহিতকর কাজে উৎসাহিত করেছে। ফেনীর কদলগাজী রোডে আমার এবং বেলাল হোসেন গঠিত বিজলী সংসদ ছিল ওই সময়কার আমার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আমার সম্পাদিত বিনজী প্রবাহ ছিল ছাত্রজীবনের আরেকটি অর্জন। ফেনীতে থাকাকালীন সাপ্তাহিক পথ পত্রিকায় খুদে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আমার জীবনের অনেক কিছু শিখতে সাহায্য করেছে। বিরিঞ্চিতে মুকবুল মিয়া কোম্পানির বাড়িতে লজিং থেকে ফেনী কলেজে পড়াশোনা ও রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছি। আমি মিয়া ভাই, তার মা ও ভাইবোনদের নিকট কৃতজ্ঞ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকালীন মুক্তি, কষ্ট, ক্লান্তি ও পরিশ্রমে এসএসসিতে সেকেন্ড গ্রেডে মেরিট নিয়ে পাস করার স্মৃতি আমাকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করেছে। ফেনী কলেজ থেকে সেকেন্ড গ্রেড বৃত্তি পেয়ে বিএ পাস করায় এমএ পড়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রকার টিউশন ফি ছিল না, যেমনটি ছিল না বিএ পড়ার জন্যও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যোশিওলজিতে এমএ পড়ার সময় শুরুতেই মনে পড়ল, এমএ পাস করার পর আমার এলএলবি পড়তে সময় লাগবে দ্বিগুণ। তাই সাহস করে এমএ পড়াকালেই রাতে এলএলবিতে ভর্তি হলাম। তার ওপর লজিং বাস। এ ছিল আমার ওপর অসাধারণ প্রেশার। কী নিদারুণ কষ্ট। একসঙ্গে দুটি উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছি। আমার খাওয়া ও থাকার বিনিময়ে অন্যের ছেলেমেয়েদের পড়ানো আমার জন্য বরাবর কষ্টই ছিল। একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যেন প্রতিটি মুহূর্তই আমাকে শঙ্কিত করতÑকীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব, কীভাবে অর্থনৈতিক মুক্তির উন্নয়ন ও উন্নতির দিকে নিজেকে, ভাইবোনদের এগিয়ে নেব, নিজ সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেব। এটাই সব সময় মাথায় ঘুরপাক খেত। আমার মা, বাবা ও ভাইবোন আমাকে চোখের মণি, হৃদয়ের টুকরো ভাবত, না খেয়ে খাওয়াত, আমার সুখ-শান্তি ও সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিত। তাদের ত্যাগ ও প্রত্যাশা আমাকে দায়িত্বশীল হতে, বিবেকবান হতে, সবার মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিতে বাধ্য করে। ফলে প্রতিটি সময়ই চিন্তা-চেতনায় প্রিয়জনদের উন্নতি আমার অনুপ্রেরণার অংশ হয়ে আছে।
লজিং বাড়িতে থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি এবং এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম ও ফেনী কোর্টে নবীন আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতাও অনেক মধুর ছিল না। শিক্ষাজীবনে শঙ্কা ছিল চাকরি না পেলে ওকালতি করে জীবিকা নির্বাহ করব। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে আইনজীবী হিসেবে জয়েন্ট করে আইনজীবীদের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা, দলাদলি, মামলা নিয়ে টানাটানি ও ঘোষখোরদের দৌরাত্ম্য, দুর্নীতি আমাকে হতভম্ব করেছে। দুই বছরের আইনজীবী-জীবনের স্মৃতি ছিল আরেক উদ্বেগ ও চিন্তার। তবে অন্য আইনজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি আয় করলেও সেই আয় আর উন্নয়নের কোনো ভবিষ্যৎ দেখছিলাম না। আইনজীবী-জীবনে আমি প্রয়াত অ্যাডভোকেট ছালাহ উদ্দিন মোহাম্মদ ইকবাল, অ্যাডভোকেট বদরেদ্দোজা এবং অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন এবং ফেনীর অ্যাডভোকেট আক্তারুজ্জামানের নিকট কৃতজ্ঞ। জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই আমি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম, উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে নিজেকে তৈরি করা, পরিবার-সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার সংকল্প ও প্রত্যয় নিয়ে কাজ করেছি।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার বাসনা, যুক্তরাষ্ট্রের সৌন্দর্য গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতায় (Individual Freedom) আমি গর্বিত, আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ যে পৃথিবীর সেরা দেশের একজন নাগরিক আমি। আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি প্রয়াত আমার নেতা, আমার বড় ভাইতুল্য অধ্যক্ষ এম ওয়াজীউল্যা ভূইয়াকে, যার ওকালতি ও বদান্যতায় আমার শ্বশুর প্রয়াত হাজী নুরুজ্জামান ভূইয়া ও রোকেয়া ভূইয়ার বদান্যতায় আমার বিয়ে হয় আমার স্ত্রী রেক্সোনা মজুমদারের সঙ্গে। যার ফলে আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। আমরা দুজন ১২-১৬ ঘণ্টা Retail Store-এ কাজ করেছি। ২০ বছর টানা চারটি কাজ করেছি। সম্পদ, বাড়ি, গাড়ি করেছি, পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। তবে আমাদের সংসারে বড় সাফল্য হচ্ছে আমাদের দুই সন্তানই পিএইচডি ডিগ্রি তথা জেডি ডিগ্রিধারী এবং দুজনই অ্যাটর্নি অ্যাট ল’ হিসেবে কাজ করছেন। আজ ৬০ বছর বয়সে বর্তমানে আমি দুটি বোর্ডের সদস্য, তিনটি ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তিনটি ল’ ফার্মের সঙ্গে কাজ করছি। কাজ আর কাজ আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে। আমি কাজের মধ্যে আনন্দ পাই, কাজে থাকতে চাই। সকালে হাঁটা, এরপর অফিস করা আবার সন্ধ্যায় আড্ডা, বোর্ড মিটিং, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক চলমান আমার রুটিন।
জীবনের ৬০তম জন্মদিনে আমি মহান আল্লাহর নিকট সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ। এ সুদীর্ঘ জীবনের জন্য আমার পিতামাতা, ভাইবোনের আদর, পাড়া-প্রতিবেশীর স্নেহ-আদর ও উৎসাহ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যারাই সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন, সবার নিকট কৃতজ্ঞ। পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবার মায়া আমাকে বিস্মিত করেছে। সন্তানদের যত দেখি, ততই দেখতে মন চায়। দোয়া করি, আশা করি, তোমরা আরও বড় হও, আরও প্রতিষ্ঠিত হও। আরও শুদ্ধাভরে স্মরণ করি শ্রদ্ধেয় বড় ভাই প্রয়াত অধ্যক্ষ এম ওয়াজীউল্যাহকে, যিনি জীবনসংগ্রামে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন। 
Barry Silberizweing আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ল’ ডিগ্রি নিতে সাহায্য করেছিলেন। Attorny BRUCE FISCHER John Garzon একেকজন ভালো বন্ধু। নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসে বসবাসকালীন আমার প্রিয় বন্ধু মৌলভীবাজারের কাসেম ভাই, নজরুল হক, সাখাওয়াত আলী, বাদশা ভাই, মনজুর চৌধুরী, জগলুল, এ ইসলাম, মামুন, ফখরুল ইসলাম, দেলোয়ার, নূহেল চৌধুরী, বিলাল চৌধুরী, শাহ আলম, তানিম, ইসমাইল, আবদুল গাফফার চৌধুরী, খসরু আব্দুর রকিব মন্টু, ড. বশির আহাম্মদ, বাংলাদেশে জাকির হোসেন, সিরাজ মাস্টার, আব্দুল কালাম, বরায়েত উল্লাহ, জাকির মিজি, লিটন, ইসহাক, তালতো ভাই নজরুল ইসলাম, গ্রামের বাড়ির মিলন, মাম্মান, হোনা ভাই, চালামত উল্লাহ ভাই, শাহদাত, এমরান হুজুর, মীর হোসেন, সাজু, জয়নাল (মৃত) আমার নিকট স্মরণীয় ও বরণীয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমার উপদেশ, লক্ষ্য স্থির করো, লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করো, মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করো, জীবন উপভোগ্য হবে।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
