এবিএম সালেহ উদ্দীন
ফিলিস্তিনের গণহত্যা নিয়ে গত সংখ্যার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ এবং দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী সমাধান করতে পারে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ। ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ইসরায়েলকে তারাই থামাতে পারে। শুধু ফিলিস্তিনই নয়, সমগ্র বিশ্বের শান্তি-স্বস্তি ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মহাবিপর্যয় ও মহাবিপদ থেকে মুক্তির ব্যাপারে বিশ্ব মোড়লদের একযোগে নীরবতা পৃথিবীর সমাজ ও রাষ্ট্রপুঞ্জকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে, সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।
গত ৭০ বছরের দীর্ঘ নির্মমতার পর ইসরায়েলে হামাস কর্তৃক অতর্কিত হামলা এবং প্রায় ২০০ ইসরাইলি বেসামরিক নাগরিককে (যাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে) অপহরণের ঘটনায় সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। সেদিনের হামাস-কাণ্ডকে ইস্যু করে ইসরায়েলকে লেলিয়ে দিয়ে বিশ্ব মোড়লেরা তামাশা দেখছেন। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামাসের ড্রোন হামলা, তির ছোড়া ও হাইজ্যাকিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিবারাত্রি বোমাবর্ষণের মাধ্যমে গাজাবাসীকে চিরতরে বিলীন করে দেওয়ার উন্মত্ততায় বিরামহীনভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের সকল শান্তিকামী ও মুক্তিকামী মানুষের সকল দাবি উপেক্ষা করা হচ্ছে। যেখানে ব্রিটেন ও আমেরিকা ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলকে চাপ সৃষ্টি করবে, শান্তির পরিবেশ তৈরি করে দেবে; সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আগ বাড়িয়ে যুদ্ধজাহাজ, অস্ত্র-গোলা এবং ফিলিস্তিনের ধ্বংসযজ্ঞে ব্যাপক উসকানি দিচ্ছে।
বিশ্বের বিক্ষুব্ধ মানুষের আর্তচিৎকার ও জাতিসংঘের আহাজারিকে উপেক্ষা করে ইসরায়েল ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনে জুলুম-নিপীড়ন ও মানববিধ্বংস চালিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠস্বর, সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, খোদ মার্কিন জনতা এবং ব্রিটেনের জনতার বৃহৎ অংশ ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। সকলের দাবি যুদ্ধ বন্ধ করো। সর্বত্র ভাগ্যহত ফিলিস্তিনবাসীকে রক্ষা করার আকুতি।
সমগ্র পৃথিবীর আর্তনাদ ও দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনকে ইসরায়েল কেয়ার করে না।
জাতিসংঘের কোনো নীতি ইসরায়েল কখনো মানেনি এবং মানবে না। কেননা তার খুঁটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছেন। তিনি যখন ইসরায়েল সফরে গেলেন, তার সামনেই ইসরায়েল গাজা এবং সেখানকার জনবহুল একটি হাসপাতালে বোমা হামলা করে চিকিৎসারত আহত নারী-শিশু এবং কমপক্ষে ৫০০ রোগীসহ সহস্রাধিক নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মি. বাইডেন যখন ট্রাম্পকে হারিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাকে উদ্দেশ করে একটি লেখায় স্বাগত জানিয়ে উল্লেখ করেছিলাম, দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাইডেন যে ইতিহাস রচনা করেছেন, সেটি অনেকের বেলায় ঘটেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচণ্ড দাপটের মুখে বাইডেন বৃদ্ধ বয়সেও তেজি ঘোড়ার মতো আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও মানুষের কল্যাণের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারিকে তিনি যেভাবে মোকাবিলা করেছেন, তা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই বাইডেনের নির্দেশনায় বর্তমানে গাজাবাসী বিতাড়িত ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার। তার উপস্থিতিতে (অনেকের মতে, তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে) যেভাবে ফিলিস্তিনের ভুখা-নাঙ্গা নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের (যেখানে অধিকাংশ নারী ও শিশু) ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হলো (!), পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। তিনি ফিলিস্তিনি অসহায় মানুষের প্রতি ইসরায়েলের নির্দয় আচরণ ও মানববিধ্বংসী নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুধু সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রাশিয়ার সঙ্গে হামাসকে মিলিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রামী সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানান। ইসরায়েলি অপশাসনের দীর্ঘকালীন পৈশাচিকতার সমর্থন জানিয়ে দুটি রণতরী/যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করেন এবং ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। হামাসের হামলাকে ইস্যু করে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো অবস্থা। হামলা করেছে হামাস, আর ইসরায়েলি নির্দয় আগ্রাসনে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। ইসরায়েলি আগ্রাসন, হামলা ও নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছেন অসহায় নারী-শিশুসহ ফিলিস্তিনের নিরীহ জনতা।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দীর্ঘদিন যাবৎ ফিলিস্তিনকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অশান্ত দেশ হিসেবে পরিগণিত করে রেখেছে ইসরায়েল। শুধু তা-ই নয়, নিজ দেশে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন এবং ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ইসরায়েলি পাষণ্ড শাসক ও সামরিক জান্তার অত্যাচার-নিপীড়নে জেরুজালেম, গাজার পূর্ব ও পশ্চিম তীরসহ গোটা ফিলিস্তিন কয়েক যুগ ধরেই অবরুদ্ধ।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন, অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা নতুন কিছু নয়। গত সাত দশক ধরেই এটা চলছে। কিন্তু সম্প্রতি হামাস ইস্যুকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল বহুবার গাজায় বোমা হামলা চালিয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাকে নতুন মাত্রায় যোগ দিয়ে ইসরায়েল গাজার বহুতল বিল্ডিং এবং জন-অধ্যুষিত গাজাবাসীকে নির্মূল করছে। সব ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুল, মানবাধিকার কার্যালয়, মসজিদ, গির্জা, উপাসনালয়সহ সমস্ত দালান ও ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আহ! নিদারুণ পরিণতি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রতিটি এলাকায়, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে নিরীহ ও নিরস্ত্র নাগরিকদের। কোনো রকম উসকানি ছাড়াই আটক করে জেলে ভরছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, সম্পদ নষ্ট করছে।
কিন্তু আসলে কি ইসরায়েল কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র? কেমন করে পৃথিবীর পারমাণবিক বোমা এবং দ্বিতীয় বৃহৎ মারণাস্ত্র মজুতকারী রাষ্ট্ররূপে পরিণত হলো? কোন নীতিমালার ভিত্তিতে ৭০ বছর ধরে একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ফিলিস্তিনকে জোরপূর্বক দখল করে চলেছে। সে কি জাতিসংঘ এবং বিশ্ব রাষ্ট্রনীতির বিধিবিধান মেনে চলে? আরব ও মুসলিম দেশগুলো কি ইসরায়েলকে স্বীকার করে? এ ধরনের কোনো নিয়ম-নীতির ধার ধারে না ইসরায়েল! বিশ্বের কোনো দিক থেকেই ইসরায়েল শঙ্কিত নয়।
বিগত ৭০ বছরের ঘটনাবলির মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, ইসরায়েল নামক দেশটি বিশ্ব রাষ্ট্রসংঘের কোনো নিয়ম-নীতি কখনো মানেনি, মানবে না এবং জাতিসংঘসহ কাউকে তারা পরোয়া করে না। কেননা ইসরায়েলের পেছনে আছে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পৃথিবীর কয়েকটি শক্তিশালী দেশ। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মদদ ও সাহায্যের ওপরই ইসরায়েল নামের একটি রাষ্ট্র শক্তিধর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বসেছে। কথায় আছে, খুঁটির জোরে ছাগল কোদে। ইসরায়েল মূলত খুঁটির জোরেই চলে। তার কোনো মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি নেই। তারা অন্ধ। মানবসভ্যতার ন্যূনতম আলোর পরশটুকুও তাদের চোখে পড়ে না। সে শুধু গড়তে পারে না, ভাঙতে জানে। ধ্বংস দিয়েই তার উৎপত্তি।
আর এটাও সত্যি, মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির জন্য দায়ী আরব দেশসমূহের অনৈক্য, স্বেচ্ছাচারিতা। আর এই সুযোগটি ইসরায়েল পুরোপুরিভাবেই গ্রহণ করেছে। এটা প্রমাণিত যে দস্যুপনা, আগ্রাসন ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ক্রমাগত ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে এককভাবে সুপার পাওয়ার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ চলে আসছে ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর ক্রমাগত নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি নাগরিকদের তাড়িয়ে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েই আরব বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, বিশ্বের বিত্তবান দেশগুলো চায় না, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে শান্তি বিরাজ করুক। এ কথাটি খোদ জাতিসংঘ বলে আসছে। সংঘাতকে স্থায়ী করার মধ্য দিয়ে অশান্তির সবক নিয়েই ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র এতটা নাচানাচি করে। আর এটা সর্বজনস্বীকৃত, আরব ও মুসলিম দেশসমূহের অনৈক্যের ফলে ইসরায়েল ফিলিস্তিন দখলপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারছে। শুধু আরব দেশগুলো এক থাকলে আমেরিকাসহ উন্নত দেশসমূহকে ঐকমত্য করার মধ্য দিয়ে বহু আগেই ইসরায়েলি আগ্রাসন দমানো সম্ভব এবং এত দিনে ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়ে যেত।
আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন নামের যে দেশ, সেটি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইতিহাস সাক্ষী, অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা অবস্থায় এবং তারও আগে জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিনের অধিকাংশ নাগরিক ছিলেন আরব ও মুসলিম। ১৯১৫-১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ৯০ ভাগ মুসলিম ছাড়াও ৭ ভাগ খ্রিষ্টান ও ৩ ভাগ ইহুদি, যারা তখন সবার সঙ্গে ধর্মীয় শান্তি-সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মধ্যেই বসবাস করতেন। তখন কারও মাঝে ইসরায়েল নামে কোনো ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার চিন্তা ছিল না। এটি ছিল কল্পনার বাইরে।
১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন এমনকি হিটলার যখন ইউরোপ ও জার্মানি থেকে ইহুদি হত্যাকাণ্ডের উন্মাদনায় লিপ্ত ছিল, তখনো কারও মাথায় ইহুদি রাষ্ট্রচিন্তা ছিল না।
হিটলার ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছিল। নিরীহ ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যা করেও হিটলার পার পেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলার আত্মহত্যা করেন। যেহেতু ইহুদিরা জার্মানি এবং ওইসব এলাকায় অবস্থান করত, সে হিসেবে যদি তখন কোনো ইহুদি রাষ্ট্র করার চিন্তা থেকেও থাকে, তা হওয়ার কথা পশ্চিম জার্মানি অথবা অন্য কোনো ইউরোপীয় ভূখণ্ডে।
এমন করুণ অবস্থায় ফিলিস্তিনের জনগণ জার্মানি ও ইউরোপ থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের আশ্রয় প্রদান করে। ফিলিস্তিনিদের এই উদারতাই আজ তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিদের এমন মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি পৃথিবীতে আর নেই।
অনেক বছর আগে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক আরিয়ান ফালাসি কর্তৃক ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এক প্রশ্নের উত্তরে আরাফাত বলেছিলেন, ‘শিশুকালে তিনি ইহুদিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লেখাপড়া এবং খেলাধুলা করতেন। সেই বন্ধুরা কখনো তাকে পিঠ দেখাননি। তারা অকৃত্রিম বন্ধুই ছিলেন। কিন্তু মেনাকেন বিগান, আইজ্যাক রবিন ও শ্যারনরা উড়ে এসে কথিত রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করে নেয়।’
ইতিহাসের নির্মম সাক্ষ্য এই যে, ইহুদিদের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি ও ফিলিস্তিনিদের বিবাদের মধ্যে ফেলেছে ব্রিটিশ। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের সময় আরবদের পবিত্রতম জেরুজালেম, বেথলেহাম তথা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের পুনর্বাসন এবং ইহুদি রাষ্ট্র পত্তনের সুযোগ করে দিয়ে ব্রিটিশরা পালিয়ে যায়।
শুধু তা-ই নয়, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদায়লগ্নে পাকিস্তান ও ভারতের কথিত স্বাধীনতা প্রদান করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বিশাল রাজ্যের বাঙালিদের বিভিন্ন এলাকা, আসাম, মেঘালয় ও মুর্শিদাবাদ, কেরালা, তামিল, পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়ে যায়। সেসব এলাকায় স্বাধীনতার বিষয়টিকে স্থায়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। ফিলিস্তিনের মতো এখনো ভারতের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাসংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং ভারতীয় সামরিক জান্তার দমন-প্রক্রিয়ায় সেসব রাজ্যে মর্মান্তিকভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যায়।
প্রকাশ থাকে যে, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে দুটি পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা হয়, জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু এ রকম অন্যায় আপসরফা আরবের মুসলিম নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। জাতিসংঘের সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
এমন অমীমাংসিত ও সংঘাতময় অবস্থার মধ্য দিয়েই ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জর্ডান দখল করেছিল একটি অঞ্চল, যেটি এখন পশ্চিম তীর বলে পরিচিত। আর মিসর দখল করেছিল গাজা। পরে সেসব হাতছাড়া হয়ে যায়।
মধ্যপ্রাচের আরব দেশসমূহের অনৈক্য ও গণতন্ত্রহীনতা, রাষ্ট্রপুঞ্জের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইসরায়েলি দখল-প্রক্রিয়া মসৃণ হয়। আরব ও মুসলিম দেশসমূহের অনৈক্যের কারণে ইসরায়েলের পক্ষে ফিলিস্তিনে আধিপত্য বিস্তার করা সহজতর হয়েছে।
বলাবাহুল্য, শত বছর পূর্বে ফিলিস্তিনে যারা থাকত, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, একই সঙ্গে কিছু ইহুদি ছিল সংখ্যালঘু। ব্রিটেনের ষড়যন্ত্রের বীজকে পুঁজি করেই ইসরায়েল সেখানে ইহুদিদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলে ২০ শতাংশ আরব আর বাকি সবই ইহুদি। ইসরায়েল সমগ্র বিশ্বের সামনে কোনো প্রকার মানবিক নৈতিকতা দিয়ে নয়, উগ্র শক্তির আস্ফালনেই ফিলিস্তিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে আছে।
৭০ বছর যাবৎ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলছে। ইসরায়েলি আগ্রাসী হামলায় ফিলিস্তিনে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। শহীদ হয়েছেন অসংখ্য ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তবু যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে ক্রমবর্ধমান হত্যাযজ্ঞের পরও ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতার জন্য এবং তাদের ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। কোনো রকম অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম ছাড়াই তারা তাদের সীমিত রসদ গোলা নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এমনকি ইন্তেফাদায় আত্মাহুতি ও শত্রুসৈন্যদের কামানগোলার সামনে পাথর ছুড়ে হলেও প্রতিবাদ করে প্রাণ উৎসর্গ করছেন।
নিজের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার ও স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনিদের সাহস দেখে বিশ্ববাসী অবাক হয়, চমকিত হয়। নিজ দেশে অবরুদ্ধ থেকেও ফিলিস্তিনি শিশুরা কেমন করে এত সাহসী হয় এবং এত মৃত্যুর মাঝেও মনোবল না হারিয়ে সুদৃঢ় থাকে। আসলে নিজের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে তারা সাহসী হওয়ার শক্তি সষ্ণয় করে। এভাবেই অবরুদ্ধ জন্মভূমিতে বড় হতে হতে তারা শিখে নেয় কীভাবে যুদ্ধ ও জীবনের সমন্বয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
যারা নিজ ভূখণ্ডে কঠিন ও মানবেতর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে দেশের জন্য, মাটি, মানুষ ও মাতৃকার জন্য যুদ্ধ করে। তারা মৃত্যুকে ভয় পায় না। জীবন বিলিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়েই জীবনের পথ খোঁজে।
আসলে ‘অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি’, যেখানে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় শক্তি ও সাহসের ফল্গুধারায় মানববিধ্বংসী কামানের সামনে দাঁড়িয়েও ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরায়েলি সৈন্যদের লাল কার্ড দেখাতে পারে। মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসার জোরেই শত্রুদের বোমা হামলা, আগ্রাসন, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও ফিলিস্তিনি শিশু ও জনগণ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অবলীলায় আত্মত্যাগ করতে পারে।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে স্বাধীনতাসংগ্রামের এমন নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ফিলিস্তিনি জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ দখল ও নির্বাসনের যন্ত্রণা নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় ফিলিস্তিনি নিপীড়িত মানুষের অনুভূতি, দুঃখবোধ ও প্রতিরোধের কথা আছে। স্বদেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসার কথা আছে। তিনি বলেন :
We have triumphed over the plan to expel us from history..
‘আমাদের ইতিহাস থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করার পরও আমরা বিজয়ী হয়েছি..।’
অর্থাৎ নিজের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ও নিপীড়িত হয়েও স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা আমরণ জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক




