কাকন রেজা
ইত্তেফাকের একটি খবর পড়ার পর থেকেই ‘আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে’ কথাটি মাথায় আটকে রয়েছে। একটু পরপর বেজে উঠছে বেসুরো গানের মতো করে। কেন এই অবস্থা হলো বলছি। দৈনিক ইত্তেফাকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে নিয়ে একটি খবর ছিল, যা প্রকাশিত হয় ২২ অক্টোবর ইত্তেফাক অনলাইনে। খবরের শিরোনামটি ছিল অনেকটা এ রকম : ‘বিএনপির কর্মসূচিতে রাস্তা বন্ধ হবে কি না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত’। এ ব্যাপারে মন্ত্রী স্বভাবতই বলেছেন, কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হলে তারা কিছু করবেন না। এসব কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। এই বক্তব্য যে রাজনৈতিক, তা সকলেই জানেন। এমনকি যার মুখে কেবল কথা ফুটেছে সেও জানতে চায়, বিএনপির প্রোগ্রাম থাকলে যান চলাচল বন্ধ হবে কি না। তারা একান্ত প্রয়োজনেও কোথাও যেতে পারবে কি না।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্য থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, পিটার ডি হাসের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিষয়ে। সেই প্রশ্নকে ইত্তেফাক উদ্ধৃত করেছে এভাবে, ‘একটি রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাওয়া কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ভেতরে পড়ে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এই প্রশ্ন আমি আপনাদের কাছে করতে চাই।’ যদিও রাস্তা বন্ধের ব্যাপারে পরে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ব্যাখ্যা ছিল ভিন্ন। তারা রাস্তা বন্ধ নিয়ে প্রশ্নের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবু এ প্রশ্ন কোনো গণমাধ্যমকর্মীর কাছ থেকে না এসে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে প্রথমে এলেই ভালো হতো। তার পরও প্রশ্নের বিপরীতে মন্ত্রী সে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীদের দিকেই। মন্ত্রীর এই প্রশ্নকে ঘিরে শিষ্টাচার বিষয়ে আরও অনেকগুলো প্রশ্ন এসে যায় এবং তা গণমাধ্যমকর্মীরা করতে পারতেন। করা উচিত ছিল। জানতে চাওয়া উচিত ছিল, এই যে গাড়ি বন্ধ করা, বালির ট্রাক দিয়ে রাস্তা আটকানো, নদী পারাপার বন্ধ করে দেওয়া, বিরোধী কর্মীদের কর্মসূচির অংশগ্রহণের প্রাক্কালে পিটিয়ে আহত করা-এগুলো কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে কি না। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা তা করেননি, কেন করেননি তা ব্যাখ্যা করা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবু একটু বলি, গণমাধ্যমকর্মীদের কারও কারও আচরণ রাজনৈতিক কর্মীর মতো বলেই এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না, হয়নি।
কূটনৈতিকদের শিষ্টাচার বর্জনের কথা বলতে গেলে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের একটা সংখ্যার প্রচ্ছদচিত্রটা তুলে দিতে হয়। সেখানে যে খবরকে হাইলাইট করা হয়েছে তা সম্ভবত এমন, ‘...পঞ্চান্ন অভিযোগ পঞ্চাশ কূটনৈতিকের কাছে।’ আর এভাবেই অনেক আগে থেকেই কূটনৈতিকদের শিষ্টাচার লঙ্ঘনে উসকে দেওয়া হয়েছে। বলতে পারেন শুরু হয়েছে। অন্য দেশের কূটনৈতিক এসে আমাদের রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য চাপ দেওয়া সেই শিষ্টাচার লঙ্ঘনেরই অংশ। এগুলোর এত উদাহরণ রয়েছে যে, তা দিতে গেলে এ লেখার পরিসর পুরো পত্রিকাতেই কুলোবে না এবং নিরাপদও নয়। সুতরাং না বলাই ভালো।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের পতনের আগে ২৪ দেশের কূটনৈতিকের দৌড়ঝাঁপ আমরা দেখেছি। সেই দৌড়ঝাঁপকে যারা উৎসাহিত করেছে, তারাই আজ শিষ্টাচারের প্রশ্ন তুলছেন, আজব না! আমরা জানি, বিদেশিরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া এক পা এগোনোর বান্দা নয়। তাদের স্বার্থ রয়েছে বলেই তারা দৌড়াচ্ছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ভূ-রাজনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনের ধারায় বিশেষ করে পশ্চিমারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের আগের রাজনীতি ভুল ছিল। শাসকদের আস্থায় এনে স্বার্থ আদায়ের বিপদ রয়েছে। কারণ এসব শাসক হয় প্রবল দুর্নীতিপরায়ণ। তাদের লোভের খেসারত দিতে হয় পুরো দেশকেই। সংগতই মানুষেরা তখন শাসকদের বিপক্ষে চলে যায়। আর জনসমর্থনহীন শাসকেরা নিজেদের টিকে থাকা নিয়ে আস্থার সংকটে ভোগে। তারা তখন বাধ্য হয়েই বন্ধুত্বের হাত বাড়ায় অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রতি। রতনে রতন চেনে অবস্থা। যেমন কিম হাত বাড়িয়েছে রাশিয়া আর চীনের প্রতি। দুটি দেশেই শাসকেরা অগণতান্ত্রিক। মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি রয়েছে কি না, তা প্রমাণের রাস্তাও বন্ধ করেছে তারা। উত্তর কোরিয়াতেও ভোট হয়। সেখানে মানুষের ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক, তাও ভালো পোশাক পরিধান করে। কিন্তু মজার ব্যাপার, ব্যালটে প্রার্থী থাকে একজনই। সেখানে কোনো সিলও দিতে হয় না, শুধু সেই ব্যালটটা বাক্সে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। এটুকুই কাজ ভোটের দিন ভোটারদের। তাদের প্রার্থী পছন্দের কোনো বালাই নেই। পুতুল হিসেবে ভোটের মহড়া দেওয়াই কাজ। মূলত কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট রেজিম নির্বাচনকে একটি প্রহসন তথা সার্কাসে পরিণত করে। তারা জানে, নির্বাচন সঠিক হলে তাদের ক্ষমতায় থাকা অসম্ভব।
আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের একটা অংশ ভূ-রাজনীতির ব্যাপার ভুলতে বসেছেন। কিংবা জানার আগ্রহ হারিয়েছেন। তারাও ক্রমে অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠছেন, হাত মেলাচ্ছেন সেই অগণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে। তাদের জন্য এতে নানা সুবিধাও রয়েছে। সেসব সুবিধার কথা আর না বলি, এগুলো আমাদের চোখের সম্মুখেই। আমরা সবাই জানি এবং দেখি। কিন্তু বলতে গেলেই গোলটা বাধে। সেই গোলের গোলমালে অনেকেই জান ও জবান হারান। সাগর-রুনি, কিংবা ফাগুন রেজাÑএ নামগুলো তখন উঠে আসে। যারা জীবন দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু তাদের চেষ্টা কি সফল হয়েছে? মগজের অন্ধত্ব কি এত সহজে দূর হয়? হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট