ড. রফিকুল ইসলাম
কোনো একটি লক্ষ্য সাধনের জন্য যখন কোনো ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে পরিচালিত করেন, তখন তাকে নেতা এবং তার কাজকে নেতৃত্ব বলা হয়। ইংরেজিতে একে বলে Leadership. ভ্যান ফ্লিটের মতে, Leadership is an influence process directed at shaping the behavior of others. অর্থাৎ নেতৃত্ব হলো একটি প্রভাব-প্রক্রিয়া, যা অন্যদের আচরণ পরিবর্তনে ব্যবহৃত হয়। তাই বলা যায়, বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতিপয় ব্যক্তি বা দলের কর্মতৎপরতাকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়াই হলো নেতৃত্ব।
নেতারা নিরপেক্ষতা ও সততা দিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেন। শ্রেষ্ঠ নেতা সে-ই, যার অধীনে কোনো কিছু অর্জিত হলে তার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক মানুষই ভাবে, তারা সবাই মিলে কাজটি করেছে। নেতৃত্ব মানে তোমার উপস্থিতিতে অন্যরা উন্নতি করবে এবং তোমার অনুপস্থিতিতেও সেই উন্নতি বজায় থাকবে। যোগ্য ও শক্তিমান নেতা সবাইকে একেক আদর্শে নিয়ে আসে। জাহাজ বানাতে চাইলে তোমার লোকদের কাজ ভাগ করে দিয়ে নির্দেশ দিতে থাকার বদলে তাদের সমুদ্রের অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাও। নেতাদের উচিত তার লোকদের জ্ঞান ও চিন্তাশক্তি বাড়ানোর জন্য দিকনির্দেশনা দেওয়া। সব সিদ্ধান্ত নেতাদের একার নেওয়া উচিত নয়।
একজন নেতা হিসেবে আমি নিজে অতিরিক্ত কষ্ট করি, যাতে অন্যরাও তা দেখে নিজের সেরাটা দিতে উৎসাহিত হয়। নেতা হওয়ার চ্যালেঞ্জ হলো শক্তিমান কিন্তু অতি কাঠখোট্টা না হওয়া, দুর্বল না হয়েও দয়াশীল হওয়া, কঠোর হয়েও অত্যাচারী না হওয়া, চিন্তাশীল হয়েও অলস না হওয়া, বিনীত হয়েও নরম না হওয়া, গর্বিত হয়েও অহংকার না করা এবং হাসিখুশি হয়েও হাসির পাত্র না হওয়া। যদি তোমার কাজ অন্যদের স্বপ্ন দেখতে, শিখতে এবং বড় কিছু হতে উৎসাহিত করে, তবে তুমি দারুণ একজন নেতা। মানুষ সাহসীদের নেতা বানায়। তুমি যদি সাহস করে মানুষের অধিকারের কথা বলো, তাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করো, তারা নিজেরাই তোমাকে তাদের নেতা বানাবে। নেতারা জন্মায় না, কঠোর চেষ্টা ও ত্যাগের মাধ্যমে একজন মানুষ নেতায় পরিণত হয়। জীবনে যেকোনো বড় অর্জনের জন্যই এগুলো প্রয়োজন।
নেতৃত্ব মানে বলপ্রয়োগ ছাড়াই অন্যদের একটি নির্দিষ্ট পথে চালিত করার ক্ষমতা। যদি কেউ সবকিছু নিজে করতে চায় এবং সব কৃতিত্ব নিজে নিতে চায়, তাহলে সে কখনো বড় নেতা হতে পারবে না। নেতৃত্ব কোনো টাইটেল বা পদ নয়, নেতৃত্ব
হলো একজন মানুষের অন্যদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। নেতৃত্ব মানে কঠিন সময়েও তোমার টিমকে তাদের সেরা কাজটি দিয়ে কিছু অর্জন করার জন্য অনুপ্রাণিত রাখতে পারা। সত্যিকার নেতা হওয়া মানে অন্যদের সফল হওয়ার পথ করে দেওয়া এবং তাদের সফল হতে দেখা।
নেতা মানে যে অন্যদের মনে আশা জাগিয়ে রাখতে পারে। নেতৃত্ব মানে অন্যদের জীবনকে সুন্দর করার সুবর্ণ সুযোগ। এটা নিজের লালসা পূর্ণ করার সুযোগ নয়। একজন নেতার সাফল্যের ৯০ শতাংশ নির্ভর করে তার অনুসারীরা কী চায়, তা বোঝার ওপর। যেদিন তোমার লোকেরা তাদের সমস্যা নিয়ে তোমার কাছে আসা বন্ধ করে দেবে, সেদিনই বুঝবে তুমি নেতৃত্ব হারিয়েছ। বেশির ভাগ সময়েই সবচেয়ে জোরালো গলার লোকটি সবচেয়ে বাজে নেতা হয়, নিজের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ঢাকতেই সে চড়া গলায় কথা বলে। ঘৃণার কারণে মন অন্ধকার হয়ে যায়, স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি কাজ করে না। নেতা হতে হলে ঘৃণা করা যাবে না। ক্ষমতাবান সে-ই, যাকে অন্যরা ক্ষমতাবান বলে বিশ্বাস করে। এটা একটা বিভ্রম, দেয়ালের গায়ে ছায়ার মতো। একজন অতি ক্ষুদ্র মানুষের ছায়াও বিশাল হতে পারে। সত্যিকার নেতা আদর্শ খোঁজে না, সে আদর্শের জন্ম দেয়।
যারা জন্মভূমির সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আমি তাদের অনুসরণ করি না। পাহাড়চূড়া নেতাদের অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু সমতলেই তারা নেতায় পরিণত হয়। একজন সত্যিকার নেতা তার কথায় বিনীত কিন্তু কাজে আক্রমণাত্মক। একজন নেতা যদি সৎ হয়, তবে তার অনুসারীরা অসৎ হওয়ার সাহস পায় না। একজন নেতা ভালোবাসা পায়, একজন বসকে অন্যরা ভয় পায়। আমার কাছে নেতার সংজ্ঞা হলো, তার অবশ্যই একটি দর্শন থাকতে হবে এবং কোনো সমস্যাতেই সে ভয় পাবে না। তার বদলে সে তা সমাধানের জন্য কাজ করবে। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, তাকে সৎ হতে হবে।
কেবল পদেই নয়, একজন নেতার নেতা হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন কিছু গুণের। নেতৃত্বের গুণাবলি একজন নেতাকে সফল করে তোলে, করে তোলে নির্ভরযোগ্য। একজন আদর্শ নেতার কী কী গুণ থাকা উচিত, তা নিচে আলোচনা করা হলো :
নেতৃত্বদানে একজন নেতাকে সর্বপ্রথম হতে হবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ব্যক্তিত্ব একজন নেতার প্রধান গুণ। ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে একজন নেতা তার দলের অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনে একজন নেতাকে আবশ্যিকভাবে দূরদর্শী হতে হবে। এর ফলে বর্তমানের পরিকল্পনা ভবিষ্যতে পুরো দলকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে অনুযায়ী পরের কর্মপরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত, এই সবকিছু সম্পর্কে একজন আদর্শ নেতার ধারণা থাকা আবশ্যক। দক্ষ নেতৃত্ব দিতে চাই দক্ষ যোগাযোগের ধারণা। একজন নেতা তখনই কোনো কাজে পুরো দলকে সঙ্গে নিয়ে সাফল্য অর্জন করে, যখন তার মধ্যে অন্যের সঙ্গে এবং দলের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের দিক থেকে কোনো প্রকার কমতি না থাকে।




