Thikana News
৩০ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫


টেক্সাস টু ঢাকা 

টেক্সাস টু ঢাকা 



 
রোমিনা লোদী জয়িতা 

আমি প্রতিবছরই একবার বাংলাদেশে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং দেশে যাওয়ার আগ দিয়ে সাধারণত খুব খুশি থাকি। মা-বোনদের সঙ্গে দেখা হবে, আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে দেখা হবে, মজার মজার রান্না খাব, অনেক জায়গায় ঘুরতে যাব, দেশীয় জিনিসপত্র কিনব, কত কিছুর সম্ভাবনায় মনটা আনচান করতে থাকে। ২০২২ এর শেষ দিকে হঠাৎ করেই আমার একমাত্র ভাগনির বিয়ে ঠিক হলো। আমি খুবই আনন্দিত, বিয়েতে অ্যাটেন্ড করতে দেশে যাব। বাংলাদেশে বসে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া একেবারেই অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা। আর তা যদি হয় আপন কারোর, তাহলে তো কথাই নেই।

ডিসেম্বর মাস শুরু হতেই আনন্দময় সম্ভাবনাগুলো পাল্টাতে লাগল। আমার রওনা হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমার শরীর খুব খারাপ করল। প্রথমে জ্বর, গলাব্যথা, কানে ব্যথা, তারপর শুরু হলো প্রচণ্ড রকমের কাশি। সেই কাশি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল যে আর সারলই না। দেশে যাওয়ার দিন প্রচণ্ড কাশি নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হলাম। একদিকে দেশে আসার প্রবল উত্তেজনা, অন্যদিকে সাংঘাতিক অসুস্থতার ধকল, একেবারে দুই পরস্পরবিরোধী শক্তি আমার শরীরে কাজ করতে লাগল।

অস্টিন এয়ারপোর্টে চেক-ইন করার সময় প্রথম দুঃসংবাদটা পেলাম। আমার দীর্ঘ যাত্রাপথের প্রথম ফ্লাইটটি যা কিনা অস্টিন থেকে  ডালাস পর্যন্ত যাবে, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত। কাজেই আমার জন্য ডালাসে পৌঁছে কাতার এয়ারলাইন্সের দোহাগামী ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট ধরার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। আমি যখন ডালাসে গিয়ে পৌঁছাব, ইতিমধ্যে কাতার এয়ারলাইন্স ছেড়ে দিয়ে থাকবে। তাই আমাকে চয়েস দেওয়া হলো যে আমি ডালাসের পরিবর্তে অন্য কোনো শহর, যেমন নিউইয়র্ক হয়ে যেতে পারি। তবে সে ক্ষেত্রেও দ্বিতীয় ফ্লাইটটির কোনো গ্যারান্টি নেই।
আমেরিকান এয়ারলাইন্সের চেক-ইন ক্লার্ক খুব হাসি হাসি মুখ করে আমাকে জানালেন, এই পরিস্থিতিতে আমার জন্য শ্রেয়, আজকের মতো যাত্রা মুলতবি করে আগামীকাল রওনা হওয়া। কাজেই বাধ্য হয়ে আমার যাত্রাবিরতি ঘটালাম এবং পরের দিনের ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ছেলেরা এই অপ্রত্যাশিত সংবাদে অতীব খুশি হয়ে গেল এবং খুব খুশিমনে আমাকে নিয়ে তারা বাড়ি ফেরত এল।

বাড়ি এসে প্রথমে দেশে ফোন করে জানালাম যে অবস্থা খুবই বেগতিক। আমি এক দিন পরে রওনা হব এবং এক দিন পরে ঢাকায় পৌঁছাব। বড় আপা হায় হায় করে উঠলেন। ঢাকায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে, বরের হলুদের অনুষ্ঠানে শামিল হওয়ার জন্য। কিন্তু কী আর করা। মনে মনে ভাবলাম, দেরি করে পৌঁছালেও আমার স্যুটকেসগুলো যেন আমার সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছায়। না হলে বিয়েতে পরার কোনো কাপড়ই থাকবে না।
৩১ ডিসেম্বর রাতে প্লেনের সিটে বসে আধশোয়া হয়ে ঘুম দেওয়ার পরিবর্তে, ৩১ ডিসেম্বর রাতে আমি আমার বাড়ির ড্রয়িংরুমে ছেলেদের সঙ্গে বসে টিভিতে, নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে বলড্রপ আর লন্ডন, অস্ট্রেলিয়ার আকাশে আতশবাজি দেখলাম। আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিল ২০২২ সাল। আমরা সবাই হ্যাপি নিউ ইয়ারসের আমেজে অভিভূত হলাম।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি সকালে, প্রথম ঘুম থেকে উঠলাম কাশির দমকে। কাশি কমার কোনো লক্ষণই নেই। সারা সকাল ও সারা দুপুর কাটল একটু পরপর ফ্লাইট স্ট্যাটাস চেক করতে। অস্টিন থেকে ডালাসগামী ফ্লাইট বিলম্ব হলো কি না এই ভয়ে। দিনের শেষে বিকেলবেলা আমার ফ্লাইট এবার সময়মতো ছাড়ল। বছরের প্রথম দিনে আমার দুই পুত্র ও তাদের বাবাকে ছেড়ে আমি ঢাকার উদ্দেশে প্লেনে চড়ে বসলাম।

আমার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন যাত্রায় যোগ দিলÑকাশি। কাশি আমার সঙ্গ ছাড়ল না। কাশি নিয়েই প্লেনে উঠতে হলো। সারাটা রাস্তা যক্ষ্মার রোগীর মতো খুকখুক করে কাশতে লাগলাম। প্রতিবার কাশি দিতেই আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রমহিলাটি নড়েচড়ে বসে এবং তার আর আমার মাঝখানের সীমিত দূরত্বটা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু বিধি বাম। বর্তমান সময়ে উড়োজাহাজের আয়তন-দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় ক্রমাগত কমেই চলেছে। দুটো সিটের মাঝখানে এতই কম ব্যবধান যে কাঁধের সঙ্গে কাঁধ না মিলিয়ে দুজন যাত্রীর পাশাপাশি বসা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আমি মনে মনে আকাশ-পাতাল ভাবলাম।
ডালাস থেকে দোহা-কাতার এবং দোহা থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট ঠিক সময়মতোই ছাড়ল। তবে ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে শুরু হলো আরেক মজার ঘটনা। দোহা থেকে ঢাকা ফ্লাইটে আমার পাশে একজন অতীব বিনয়ী ও মিশুক ভদ্রলোক বসেছিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তিনি ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বস্টন শহরে থাকেন এবং বহু বছর পরে দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের বর্তমান হালচাল সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। পেশায় একজন ডাক্তার। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু বাবা-মা, ভাইবোন বেশির ভাগই আমেরিকায় থাকায় আর দেশে যাওয়ার টান অনুভব করেননি। হঠাৎ করেই খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধুর কাছ থেকে বন্ধুদের রি-ইউনিয়নের আমন্ত্রণ পেয়ে আর দেশে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি। ঢাকায় পৌঁছে তিনি চিটাগাংয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন।

বাঙালি হিসেবে আমি ভদ্রলোকটিকে আমাদের দেশ সম্পর্কে কিছু আপডেট দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করলাম। তিনি শুনে খুব অবাক হলেন যে ঢাকা শহর আর আগের মতো নেই। বহুতলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, শপিং মল, ভিন্ন দেশীয় কুজিন রেস্তোরাঁ, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, বিদেশি ধাঁচের ক্যাফে, ফিটনেস জিম, বিউটি পার্লার অ্যান্ড স্পা, হাই অ্যান্ড সোশ্যালাইজিং ক্লাবÑকী নেই এখন ঢাকা শহরে। এই নয়া নগরে সবাই সারা দিন ছুটে চলে। জীবিকা উপার্জন, ভ্রমণ, কর্মসংস্থান, বিনোদন, সময় যাপন, রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান-মিছিল, সবকিছুই চলে পাশাপাশি এক কাতারে। প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম, অসহনীয় যানজট, মানুষের নিত্যদিনের সাথি। রাস্তায় নামলে মনে হবে মানুষের তুলনায় যানবাহন বেশি, সময়ের তুলনায় মানুষের তাড়া বেশি। সবাই পাল্লাপাল্লি করছে আগে যাওয়ার জন্য। যে পথচারী সেও যেতে চায় গাড়ির আগে, হাঁটা দেয় চলন্ত গাড়ির সামনে।
তিনি খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিলেন আর বললেন, ওনার স্ত্রীও আসার আগে এমন ধারণা দিয়েছেন। কারণ প্রতিবছর তিনি দেশে যান। তবে ওনার স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল। ছোটবেলায় ফেলে আসা ঢাকা শহরের চিত্রটাই ওনার মনে গেঁথে আছে। আমি ওনাকে বললাম, আমি আমার মাকে দেখতে প্রায়ই দেশে যাই। কাজেই ঢাকার এই পরিবর্তন আমার জন্য নতুন কিছু নয়। এই ডিজিটাল যুগে, ডিজিটাল বাংলাদেশ যেন প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের দুনিয়াকে একেবারে একই ঘরে বন্দী করে ফেলেছে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ছিল একটা ‘ধারণা’ মাত্র। হয়তো ছিল অনেকের ‘স্বপ্ন’, ওখানে পাড়ি জমানোর। বর্তমান সময়ে দেশের নাগরিকেরা পাশ্চাত্যের দুনিয়া সম্পর্কে প্রায় সবই অবগত। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এখন সব ধারণাকেই করে দিচ্ছে বাস্তবের মতো পরিষ্কার। তারা আমেরিকার জীবনযাত্রা এবং আমেরিকান রীতিনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অনেক অবস্থাপন্ন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা আমেরিকায় প্রতিবছর ছুটি কাটাতে আসে। অনেকের আছে আমেরিকার কোনো স্টেট ভ্যাকেশন হোম। আমেরিকায় থাকা বাঙালিরা অনেক বছরের সাধনা আর পরিশ্রমে যা অর্জন করে থাকে, তা ঢাকায় থাকা একশ্রেণির বাঙালির জন্য করা খুবই সহজ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে অনেক ব্যাপারেই আমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হচ্ছিলেন। আর ভাবছিলেন, বন্ধুদের পার্টিতে তার জন্য কী কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে। উনি ওনার স্ত্রীর কাছ থেকে জেনেছেন, দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শ্রেণি এখন ঢাকা শহরে সহাবস্থান করে। অতি রক্ষণশীল এবং অতি আধুনিক। তারা যে যার অবস্থান থেকে তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ করে চলে নিয়মিতভাবে। আর তা হতে পারে খাওয়াদাওয়া, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, পরিবার গঠন, সন্তানসন্ততি পালন, বন্ধু নির্বাচন অথবা সবার সঙ্গে সামাজিকতায়।

এই পর্যায়ে আমি আর না বলে থাকতে পারলাম না যে আমার চোখে কিন্তু আরও একটি তৃতীয় শ্রেণি ধরা পড়েছে। আরও একটি দল, যারা এই দুই দলের মাঝখানে পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে এবং বুঝে উঠতে সক্ষম হয় না যে কোন দিকে যাওয়া ঠিক হবে। হয়তো তারা কোনো একটা চরম দিকে যাওয়াটা বাঞ্ছনীয় মনে করে না, তারা মাঝামাঝিই থাকতে চায়।
আমি ভাবলাম, তাদের অবস্থা যা-ই হোক, আমরা যারা আমেরিকা বা বিদেশের কোনো দেশ থেকে আসি, আমাদের অবস্থা তো আরও বেগতিক। না ঘারকা, না ঘাটকা। আমরা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা একদিকে পুরোপুরি আমেরিকান মনোভাবাপন্ন হতে পারি না, অন্যদিকে নিজের দেশের সংস্কৃতি, রীতিনীতি পুরোপুরি ভুলতে পারি না। যার ফলে আমরা কোনো দলেই নিজেদের ভেড়াতে পারি না। ভাবতে খুব অবাক লাগে, একই ভাষা বলে, একই খাওয়া খেয়ে, গায়ের রং একই হয়েও আমরা দেশে ফিরে নিজেদের খাঁটি বাঙালি ভাবতে পারি না। আমরা চিরকালই হয়ে থাকি প্রবাসী বাঙালি। যেদিন স্বদেশ ছাড়ি, সেদিন থেকেই হয়ে যাই প্রবাসী। আর যে দেশে আবাস গড়ি, সে দেশে আসার পর থেকে হয়ে যাই ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্র্যান্ট। আমাদের আসল জায়গাটা তাহলে কোথায়?

হঠাৎ মাইক্রোফোনে ক্যাপ্টেনের গলার আওয়াজ ভেসে এল। আমরা ঢাকা শহর থেকে আধা ঘণ্টা দূরে অবস্থান করছি। আর তিরিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা অবতরণ করব। একটা চাপা উত্তেজনায় মনটা ভরে গেল। হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করার পর শেষ আধা ঘণ্টা আর মন মানে না। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল নয়টা। আরও টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে মনে হলো আমরা অনেকক্ষণ ধরে আকাশে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। কিছুদূর নামার পর কই আর নিচে তো নামছি না। ঘড়িতে আবার সময় দেখলাম। সকাল নয়টা পঞ্চাশ। সর্বনাশ, আমরা কেন অবতরণ করছি না?

পাশের ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি আকাশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি? আমি বললাম, আমারও তো তা-ই মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? আমি ওনাকে বললাম, চলুন, আমাদের ফ্লাইটের লোকেশন ম্যাপটা ফলো করি। এই হাইটেকের যুগে আমরা সবাই জানি। এখনকার সব ফ্লাইটেই প্লেনের যাত্রাপথ, সময় এবং ফাইনাল ডেস্টিনেশনসহ একটা ম্যাপ সিটের পেছনে বা সামনের স্ক্রিনে দেখতে পাওয়া যায়। লোকেশন ম্যাপ অন করতেই লক্ষ করলাম, আমাদের প্লেনের রুটটি ঢাকার কাছাকাছি এসে ঘুরে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে এবং ফাইনাল গন্তব্যস্থল দেখাচ্ছে ‘ম্যান্ডালে’। বুকের মধ্যে ধপাস করে একটা বাড়ি পড়ল। ম্যান্ডালে কোথায়? আমরা ঢাকায় যাচ্ছি না কেন?

সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়ালাম। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে জিজ্ঞেস করা দরকার আমরা কোথায় যাচ্ছি। পর্দা সরিয়ে ওদের কেবিনে ঢুকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যান্ডালে কোথায়? আমরা কি ঢাকায় যাচ্ছি না? যে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম সে কম বয়সী, খুব মিষ্টি চেহারার একজন মধ্যপ্রাচ্যের মহিলা। হাসি হাসি মুখ করে সে বলল, ম্যান্ডালে খুব সম্ভবত ঢাকা থেকে দূরে, চিটাগাংয়ের কাছাকাছি একটি শহর।

আমি হেসে বললাম, হতেই পারে না। ম্যান্ডালে কোনো বাংলা শব্দ নয়। ম্যান্ডালে নামে কোনো শহর চিটাগাংয়ের কাছে নেই। সে খুব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বাঙালি? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তুমি কি একটু ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করবে, এখন কী হচ্ছে? এরই মধ্যে কেবিন থেকে যাত্রীদের একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। সবাই বুঝতে পেরেছে আমরা ঢাকায় অবতরণ না করে আবার ঘুরে চলেছি। সিটে এসে বসলাম। অসহায় মনে ভাবলাম, এই যাত্রা কবে শেষ হবে? আদৌ কি ঢাকায় পৌঁছাব?

একটু পরই ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ আবার ভেসে এল। তিনি যা বললেন তা সারমর্ম করলে দাঁড়ায়, অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে আমাদের প্লেনটি ঢাকায় অবতরণ করার পারমিশন পায়নি। অনেকক্ষণ ধরে আকাশে চক্কর দিতে দিতে জ্বালানিও শেষ হয়ে আসছিল। ক্যাপ্টেনের হাতে অপশন ছিল দুটিÑকলকাতা ও ম্যান্ডালে। ম্যান্ডালে মিয়ানমারে অবস্থিত একটি শহর। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে যখন কলকাতা থেকেও ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স মেলেনি, তখন বাধ্য হয়েই মিয়ানমারের দিকে রওনা হতে হয়েছে। ম্যান্ডালে গিয়ে জ্বালানি নিয়ে ঢাকায় ফেরত আসতে আরও দুই ঘণ্টা সময় লাগবে।

হায় আল্লাহ‌, বলে কী? তার মানে আমাদের ল্যান্ডিং টু ঢাকা আরও দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরে হবে। ভাবলাম, আমি কি ভাগনির হলুদের অনুষ্ঠান ধরতে পারব? তার ওপর আবার কাশির যন্ত্রণা। যতদূর মনে পড়ে, আকাশপথে ম্যান্ডালের দিকে আমাদের যাত্রার প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমাদের প্লেনটি আবার ঘুরতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন এবার আমাদের জানালেন, ঢাকা থেকে অবশেষে ক্লিয়ারেন্স মিলেছে। অর্থাৎ কুয়াশা হটে গিয়েছে। অর্থাৎ আমরা এখন মিয়ানমারে না গিয়ে ইউটার্ন মেরে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। যাক বাঁচা গেল।

আকাশে ভেসে এই সাপলুডু খেলা খেলতে খেলতে ফাইনালি আমাদের ঢাকায় অবতরণ করা হলো, যা পুরোনো সময় ছিল তার দুই ঘণ্টা পর, অর্থাৎ সকাল সাড়ে ১১টায়।  এয়ারপোর্টে নেমে বিশাল লম্বা ইমিগ্রেশনের লাইন, ঘণ্টা ধরে লাগেজের অপেক্ষা, মোবাইলের সিম কার্ড অ্যাকটিভেট করা, রাস্তায় নেমে ট্রাফিক জ্যামে আটকানোÑসব মিলিয়ে বাড়ি পৌঁছালাম দুপুর দুইটায়। আমার আপনজনদের অসংখ্য বার ফোন করে আমার খোঁজ নেওয়া, তাদের দীর্ঘ অপেক্ষা ও আমার অপরিসীম ধৈর্য্যরে শেষ সীমা অতিক্রম করে ৩২ ঘণ্টার যাত্রা শেষে কাশতে কাশতে মায়ের বাড়ির দরজায় এসে হাজির হলাম। কী আনন্দ, কী আনন্দ! বিয়েবাড়িতে সাজ সাজ রব। আজ পাত্রের হলুদের অনুষ্ঠান। তাই কনেবাড়িতে ডালা, কুলা সাজানো হচ্ছে। তাতে আছে পাত্রের জন্য কেনা স্যুট, পাঞ্জাবি, শাল, জুতো, ঘড়ি, প্রসাধনী। সেই সঙ্গে হাতের রাখি, ফুল, হরেক রকম মিষ্টান্ন, নকশি করা পিঠা। আমি সঙ্গে করে আনা বিদেশি কাশির ওষুধ আর মায়ের কাছ থেকে নেওয়া দেশি কাশির ওষুধ, সবগুলো খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। ছোট একটা ঘুম দিয়ে উঠে জেট ল্যাগের সঙ্গে যুদ্ধ করে আবার হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য সাজগোজ করে রেডি হতে হবে...

এক আজব শহর ঢাকা। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। যারা নিত্যদিনের বাসিন্দা, তারা নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে নিত্যদিন যুদ্ধ করে। যারা অতিথি হয়ে বেড়াতে আসে, তারা মনে রাখার মতো অনেক কিছু সঙ্গে নিয়ে ফেরত যায়। সেবার দেশে ঢাকায় দুই মাস থাকা হয়েছিল। তার মধ্যে বিয়ে ছাড়া আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল। হয়েছিল হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনার সময় যাপন। ওসবের কথা নাহয় আরেকদিন লিখব।

লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার, টেক্সাস

কমেন্ট বক্স