টানা প্রায় দুই মাস হাসপাতালে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। লিভার সিরোসিসের কারণে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন তিনি। বারবার সিসিইউতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, দেশে আর কিছুই করার নেই। এমন পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়। কিন্তু আইনগত বিষয়ে বাধা রয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যাখ্যার পর তার বিদেশ যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে আন্দোলন করছে বিএনপি। এই এক দফার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও আছে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পর থেকে তার মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিটি সামনে চলে আসে। এ দাবিতে সম্প্রতি সারা দেশে লিফলেট বিতরণ, দোয়া মাহফিল হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সব মহানগর ও জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। ২৫ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাঠানোর সুযোগ চেয়ে সরকারের কাছে নতুন করে আবেদন করে খালেদা জিয়ার পরিবার। সেই আবেদন পেয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তখন বিএনপিসহ অনেকেই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। তারা ভাবতে শুরু করেন, বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে হয়তো ইতিবাচক সিদ্ধান্তই দেওয়া হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে কোন দেশে চিকিৎসা নেওয়া ভালো হবে, সে খোঁজখবরও চলে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় মন্তব্য করেন, ‘চিকিৎসা নিতে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে হলে তাকে আবার জেলে যেতে হবে। তারপর আদালতের কাছ থেকে তাকে অনুমতি নিতে হবে।’ দৃশ্যত এর পরই আশার আলো কমে যেতে থাকে। পরে আইনমন্ত্রীও একইভাবে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেন। সর্বশেষ ২ অক্টোবর সোমবার লন্ডনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন, চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে খালেদা জিয়ার প্রতি কেন সহানুভূতি দেখাতে হবে? তিনি জানান, এখন তার আর কিছু করার নেই। আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে তিনি যেতে পারবেন না।
অবশ্য আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া অসম্ভব নয়। সরকার চাইলে সে সুযোগ করে দিতে পারে।
এর আগে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। বেঁধে দেওয়া সেই সময়ের ১০ দিন পার হলেও বিএনপির রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক দল ও জনমনে। সর্বশেষ আদালতের বারান্দা থেকেও বাধা আসায় এখন প্রশ্ন উঠেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপি এখন কোন পথে হাঁটবে? ৩ অক্টোবর মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শুধু খালেদা জিয়াকে এ অবস্থায় (অসুস্থ) রেখে নয়, হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার পতন হবে।
বিএনপির বিভিন্ন সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের সঙ্গে দলের নীতিনির্ধারকদের দুর্বলতা, অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন নেতাকর্মীরা। বন্দী খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে যাওয়া দলের চরম ভুল ছিল। এরপর মুক্তির বিষয়ে গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে নরম কর্মসূচি মিলাদ, দোয়া মাহফিল, মানববন্ধন ও কয়েকটি সমাবেশ করেই সময় পার করাকেও হাইকমান্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিএনপির হাইকমান্ড সরকারের প্রেসক্রিপশনে চলছে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। দলের প্রধান নেত্রীর মুক্তি ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক ভূমিকায় বিএনপি ব্যর্থ হচ্ছে বলেও অনেকের মত। তাদের প্রশ্ন, বিএনপি অক্টোবরের মধ্যেই যে সরকার পতনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, সেটা কীভাবে সফল হবে? বিএনপির চলমান নেতৃত্ব দিয়ে দলের নেতাকর্মীরাই ভরসা পাচ্ছেন না। ভুঁইফোড় ডজনে ডজনে দল নিয়ে সকাল-বিকাল বৈঠক করে দুর্বল কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি কী ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে, দলের বড় অংশের কাছেই তা এখন অজানা।
অন্যদিকে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এ জন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, দেশে আইনের শাসন নেই। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারত এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারত।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসলে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া বক্তব্যেরই বাস্তবায়ন। তার জীবন, বেঁচে থাকা এবং উন্নত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া সবকিছু প্রধানমন্ত্রী আর আইনমন্ত্রীর তামাশার হিংসার বৃত্তে আটকে রাখা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে মানবতাবিরোধী বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং একটি মাস্টারপ্ল্যানের অংশ।
বিএনপি এখন কী করবে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের মাধ্যমেই সুরাহার পথ বের করতে হবে। আর আমরা তো সরকার পতনের আন্দোলনেই আছি।