শামসাদ হুসাম
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতির ময়দান বেশ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, তিনি কোনো অবস্থাতেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেবেন না।
যদিও তার বলা এ ধরনের কথাবার্তা এবারই প্রথম নয়, এর আগেও তিনি বিতর্কিত কিছু কথাবার্তা দিয়ে রাজনীতির মাঠকে শুধু উত্তপ্ত করতেই চাননি, দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতিও হুমকি ছুড়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেছিলেন।
তবে মির্জা ফখরুল তার রাজনীতির অংশ হিসেবে একটা সংক্ষিপ্ত সফরে যখন ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিলেন, ঠিক সেই সময়ে শেখ তাপস কথাটা বলেন। তার ভাষায়, ‘আজ থেকে ঢাকা দখলে রাখা হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে তবেই ঘরে ফিরে যাব আমরা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আর তো মুখ নাই তার, লজ্জায় এখন ঢাকা ছাইড়া ঠাকুরগাঁওয়ে গেছেন। এবার আর তাকে ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।’
বক্তব্যের ধরনে মনে হচ্ছে যেন পুরো ঢাকা মহানগরীটি তার দখলের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। মির্জা ফখরুল ইসলামও বলেন কথাটা, ‘ঢাকা কি তার জমিদারির অংশ?’
মেয়রের বেহিসাবি কথাবার্তা নিয়ে দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে একটা ধূমায়িত অসন্তোষ দানা বেঁধে আছে। এসব লাগামহীন কথাবার্তার জবাবে বিএনপির আরও একজন নেতা হুঁশিয়ার করার ইচ্ছা নিয়েই মেয়র তাপসকে সংযত হয়ে কথা বলার উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমার পিতার সাথে রাজনীতি করেছি আমরা, অতএব কথা বলার সময় বিষয়টা মাথায় রাখলে তোমারও উপকার হয়।’
এসব উপদেশ কিংবা অনুরোধ কোনোটাই তার কাছে কোনো ধরনের আবেদন সৃষ্টি করে না, যে কারণে দুর্বিনীত উচ্চারণে তিনি আরও বেশি বেহিসাবি হয়ে ওঠার ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরে যখন বলেন, ‘যেই সব সুশীল আমাদের বুদ্ধি দিতে যাবেন, সেই সব সুশীলকে আমরা বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীর কালো পানিতে ছেড়ে দেব।’
সম্প্রতি মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালও প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে কথা বলেছিলাম বলে মেয়র তাপস বলেন, যে বেশি কথা বলবে, তাকে ধোলাইখালে নিয়ে গিয়ে চোবাব। কথা বলারও তো একটা মাত্রাজ্ঞান থাকে, মেয়র তাপস সেই জ্ঞান-গরিমায় অনেক ঊর্ধ্বে এখন।
আর তাই যখন গত মে মাসের একুশ তারিখ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার একপর্যায়ে দেশের বিচার বিভাগ সম্পর্কে এক অশালীন ও অসম্মানজনক উক্তি করে বলে বসলেন, ‘একজন চিফ জাস্টিসকে পর্যন্ত নামিয়ে দিয়েছিলাম।’ তখন উপস্থিত আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে কারও না কারও একটা অন্য মাত্রার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। হয়েছিল কি নাÑসেটা অবশ্য দেশের মানুষ জানতে পারেনি। তবে ইতিমধ্যে মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটা মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
মেয়র তাপসের এসব অশ্রাব্য বাতচিত প্রদর্শনের পেছনের শক্তির উৎস যে কোথায়Ñমানুষ যে বিষয়টা একেবারে জানে না, সেটা ঠিক নয়। কারণ তিনি এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা শেখ ফজলুল হক মণি বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগনে ছিলেন। সেই ক্ষমতার সূত্র ধরে তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার বলে বিশ্বাস করতেন। শুধু তা-ই নয়, সেই ক্ষমতার জোরে নিজেকে এক দুর্বিনীত সাহসের কেন্দ্রবিন্দুতে এনে একইভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন। তার মতের বিপরীতে অন্য কোনো অভিমতকে একইভাবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার সাহসও দেখাতেন শেখ মণি!
সেই পিতার সন্তান তিনি। ‘রক্ত কথা বলে’ প্রচলিত একটি প্রবাদ রয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের রক্ত তাই দুর্বিনীত সাহসের খেলা দেখায়। এবং এমন একটা সময়ে, যখন তার মেয়র হিসেবে ‘সেবক’ হয়ে ওঠার কথা ছিল। তিনি তখন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ এক প্রশাসকের ভূমিকায়। ঢাকা এখন নানা কারণে মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। যদিও অবকাঠামোর দিক দিয়ে শেখ হাসিনার নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইতিহাসের আলোকে অবশ্যই মূল্যায়ন হবে একদিন। কিন্তু বাদবাকি বিষয় সম্পর্কে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ক্ষমারও অযোগ্য এখন। এ ছাড়া দেশের বিচারহীনতার কালচার ও দেশব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার যেন এক মহামারি আকার ধারণ করেছে। ব্যাংক-বিমা লুটেপুটে শেষ করার মহোৎসবে সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকেই এক অসৎ গোষ্ঠীর লাগামহীন কাজ-কারবার, তারপর রয়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট নামক আরেক দানব শক্তির অপতৎপরতা। সবকিছু মিলে সাধারণ মানুষের এখন ত্রাহি মধুসূদন দশা।
বাজারে মাছ-মাংস, শাক-সবজি সবই আছে, পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে, শুধু ক্রয়ক্ষমতা নেই মানুষের। ঢাকার বাজারে শিম নামক সবজির বিক্রয় মূল্য ২০০ টাকা! এক হালি ডিমের দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা, পুঁটি মাছের কেজি সাড়ে পাঁচশ টাকা। আর ইলিশ মাছ তো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এক কেজি ওজনের ছোট একটা মাছের দাম ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। আর বড় আকারের ইলিশের দাম শুনলে হার্টফেল করার দশা হয় কারও কারও! অবশ্য যে ইলিশ ঢাকা বা ঢাকার বাইরের বাজারে যে দরে বিক্রির কথা উচ্চারণ করে থাকেন মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা, তারাই শেষ পর্যন্ত ভারতের বাজারে পাচার করে থাকেন অর্ধেক দরে। সামনে শারদীয় পুজোর সময়কাল, আর ওই সময়ে আড়তদাররা ইলিশের চালান পাঠাবেন পার্শ্ববর্তী দেশে। বিষয়টা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। জানেন সবাই। শুধু না জানার ভান করে চুপ করে কমিশনে ভাগ বসাবে সুবিধাভোগী এক অসৎ গোষ্ঠী। ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি মাঝে মাঝে বাজারে অভিযান পরিচালনা করে থাকে, তারাও অনেকটা অসহায় এই অসৎ সিন্ডিকেটের হাতে।
মেয়র তাপসের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘গত ৩০ বছরে দেশের যে উন্নয়ন হয়নি, আমরা মাত্র দুই বছরে সেই উন্নয়ন করে দেখিয়েছি।’ আর এসব অসংলগ্ন কথাবার্তাকে আরও জোরালো শক্তি জুগিয়েছে যত্রতত্র ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা।
বিশেষ করে বিগত বছরসমূহে ব্যাংক ডাকাতির যে ইতিহাস, তার সামান্য নমুনা হলো ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার কোটি টাকার লোকসান। ওই একই সময়ে সংঘটিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে (সোনালী ব্যাংক) ৩,৫০০ কোটি টাকার নাই হওয়ার ঘটনা ছাড়াও পরের বছর বেসিক ব্যাংক লুটেরাদের হাতে ৪,৫০০ কোটি টাকা তুলে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে জনতা ব্যাংক বিসমিল্লাহ গ্রুপের হাতে ১,২০০ কোটি টাকা, পরের বছর সেই একই ব্যাংক ক্রিসেন্ট গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছিল ৩,৪৪৩ কোটি টাকা। পরের বছর এসে আবারও জনতা ব্যাংক ৫,৫০৪ কোটি টাকা তুলে দিয়েছিল এনটেক্স গ্রুপের হাতে!
ওই একই কায়দায় ফার্মার্স ব্যাংক হারিয়েছে ১,৮০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় থেকেই লুটেরা দলের হাতে ইসলামী ব্যাংক হারিয়েছে ২,৬০৪ কোটি টাকার মতো। ড. আতিউর রহমানের মতো ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন, তার আমলে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটল। ৮৬৬ কোটি টাকা হারানোর খবরে মানুষ হতবাক হয়ে পড়লেও সেই গভর্নরের কোনো জবাবদিহিমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারল না কেউ। বরং তিনিই এখন সুধী সমাজের কাছে নীতি বিক্রির বয়ান দিয়ে চলেন! একইভাবে ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩৩০ কোটি টাকার সোনা চুরিরও ঘটনা ঘটল। তারপর রয়েছে পিকে হালদারের ৩,৫০০ কোটি টাকা লোপাটের ইতিহাস!
তার পরও মেয়র তাপসের মতো অর্বাচীনরা মন্তব্য করেন, ‘আগামী একশ বছরেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না।’
মানুষ তো ভুলে যায়নি ওই সরকারের আমলে, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত হয়েছিলেন মোট ৭৪ জন। যাদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীকে কার্যত একটা মেসেজ দিতে চেয়েছিল অদৃশ্য দুর্বিনীতরা, যে দায় থেকেও আওয়ামী সরকারের মুক্তির কোনো উপায় নেই। স্বাধীনতার চেতনা রক্ষা করার দোহাই দিয়ে এই সরকারের আমলে সংঘটিত প্রতিটি কর্মকাণ্ডের বিচার নিশ্চয় জনতার আদালতে অনুষ্ঠিত হবে একদিন। আজ ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে রয়েছে সামান্য এক এডিস মশার হাতে। ডেঙ্গু রোগ নামের ভয়াবহ রোগটি মশাবাহিত। এটি কোভিড বা করোনা রোগের মতো বাতাসে ভর করে বিস্তার লাভ করে না, বরং মশার কামড় থেকেই রোগটির উৎপত্তি। আর এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়তা করে পানি। ‘পানির অপর নাম জীবন’ এই কথাটিকে অসাড় প্রমাণিত করে দিয়ে এখন পানিই হয়ে পড়েছে মৃত্যুঝুঁকির অন্যতম কারণ। একসময়ে নালা-খালের ময়লা বা দূষিত পানিকে মশার বংশবিস্তারের অন্যতম উৎসস্থল বিবেচনা করা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে বাসাবাড়ির আশপাশে থাকা ভাঙা বাসন, ফুলের টব কিংবা ডাবের খোসা অথবা পরিত্যক্ত টায়ারের মধ্যে জমে থাকা পানিই হচ্ছে এডিস মশার বংশবিস্তারের অন্যতম উৎস। ফলে শুধু সিটি করপোরেশনসমূহের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ওপর দোষ না দিয়ে মানুষের সচেতনতার প্রতিও এখন অঙ্গুলি উঠছে। তার পরও চেতনায় ঘা পড়ে না কারোরই। যার কারণে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন ভয়াল আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন ওই এক কারণে মারা যাচ্ছেন কুড়ি থেকে পঁচিশ জনের মতো। আর বছরে মারা যাচ্ছে হাজারের মতো মানুষ। সারা দুনিয়াজুড়ে এই রোগ এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০০০ সাল থেকে এই রোগের প্রকোপ বাড়ার ফলে এখন সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক রয়েছেন সরাসরি ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে। সংস্থাটির অভিমত অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৩০টি দেশ এই তালিকায় রয়েছে।
মশাবাহিত এই রোগটিকে তারা জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করে ডেঙ্গুকে উষ্ণমণ্ডলীয় দেশের জন্য অশনিসংকেত বলেও উল্লেখ করেছেন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি, ময়লা আবর্জনার ভাগাড়, নালা-খালসমূহের মধ্যে জমে থাকা ময়লা পানি, শাক-সবজি ছাড়াও মাছ-মাংসে বিষাক্ত ফরমাালিন প্রয়োগ ছাড়াও রয়েছে হোটেল ও রেস্টুরেন্টসমূহে ভেজাল খাবার পরিবেশনের রেকর্ড। এই সবকিছু
বাংলাদেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে। তার ভেতরে ঢাকায় রয়েছে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের ব্যবসায়িক লোভের মহোৎসব। যে কারণে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার স্থান এখন ১৩৮ নম্বরে।
সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একটি জরিপের তথ্যমতে এই তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে। এই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ শুধু ঢাকায় বেড়েছে এমনটা নয়, সারা দেশে এই রোগ এখন চরম এক আতঙ্কের নাম। বলা হচ্ছে, গত ২৪ বছরের ইতিহাসে চলতি বছর আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার দুটিই সর্বোচ্চ উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবমতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় বেশি। আর ডেঙ্গুতে মৃত্যুশূন্য নগর হলো সিলেট।
বাংলাদেশে প্রথম ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর প্রকাশ্যে এসেছিল। সেই সময় সারা দেশে ৫২ হাজার ৫৫১ জনকে আক্রান্তের তালিকায় আনা হয়েছিল। তখন মারা গিয়েছিলেন ৯৩ জন। পরের বছর এই হার বাড়ার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনে। আর ওই সময়ে মারা গিয়েছিলেন ২৮১ জন। এই হার এখন ক্রমাগত বাড়ছেই। বিশেষ করে, চলতি বছরের ৯ মাসেই এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে সহস্রাধিক মানুষের।
শুধু ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে তা-ই নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভাষ্যমতে, দেশে আবারও করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়া শুরু হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুধু ঢাকায় মোট ১১ জনের শরীরে এই রোগের ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। যদি এই রোগ আবারও মহামারি আকার ধারণ করে, তবে দেশের পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। শুধু ওই করোনা রোগে সারা দেশে বিগত কয়েক বছরে মারা গিয়েছিলেন ২৯ হাজার ৪৭৭ জন। আর শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৮ জনের মতো।
সবকিছু মিলে ঢাকাসহ সারা দেশের অবস্থা ভয়াবহ। দু’ভাগে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর নাতি। শেখ মণির পুত্র। তার নেতৃত্বাধীন ওই সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ইতিমধ্যে চারটি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর রেড জোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও মাননীয় মেয়র মহোদয়ের দাবি অনুযায়ী মশক নিধনের ওষুধ নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা সত্যি নয়। যদি সত্যি হতো, তাহলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতো। অর্থাৎ তার কাছে বর্তমানে যে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহার, সেটিকে বেশি বলে মনে হচ্ছে না!
দেশের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অধিকাংশ হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যাও অপ্রতুল। তারপর রয়েছে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য অপ্রতুল অ্যান্টিজেন কিট বরাদ্দের বিষয়টি। অধিকাংশ হাসপাতালে প্লাটিলেট টেস্টের মেশিনসংখ্যা পর্যাপ্ত না থাকায় মৃত্যুহার বাড়ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে না নেওয়ায় দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের জন্ম হচ্ছে। তবে সত্য আরেকটি ঘটনা হলো, সরকারের পক্ষ থেকে মশক নিধনে বাজেট বরাদ্দের হার কমিয়ে দেওয়ায় সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করছে। যেমন যেখানে গত বছর বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা, চলতি বছরে সেই বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। অথচ ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
স্বাস্থ্য দফতরের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে পুরুষ। আর নারী হচ্ছে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আক্রান্ত পুরুষ বেশি হলেও নারীর মৃত্যুহার বেশি। এই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যেসব কন্যাসহ মহিলারা মারা গেলেন বিগত কয়েক মাসে, সেই মৃত্যুর তালিকায় আমার ছোট বোনটার নামও অন্তর্ভুক্ত হলো। আমাদের সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল সে। মায়ের শেষের দিকের সন্তান হওয়ায় আমরা বড় বোনেরাই মাতৃস্নেহ দিয়ে তাকে লালন-পালন করেছিলাম। বয়সে আমার প্রায় পনেরো বছরের ছোট ছিল। ১৯৭২ সালে যখন মেট্রিক পরীক্ষা দিলাম, ওই সময়ে তার জন্ম। পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে উজ্জ্বলতম এক সদস্য ছিল। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটাও নিয়েছিল আমার বোনটি। গত কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটালেও একসময় সবার অমতেই দেশে ফিরে গিয়েছিল। তাও যদি সিলেটে থাকত। এখন পর্যন্ত সিলেট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য। কিন্তু ঢাকাতেই থাকত সপরিবারে। গত ৩ আগস্ট সেই বোনটি চলে গেল একেবারে নীরবে। বাদবাকি ভাইবোন আমরা সবাই এই বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকি বলে শেষ দেখাটাও হলো না আমাদের। বাস্তবতা মানুষকে কঠিন করে তোলে। একসময় হয়তো তার কথা ভুলে যাব। স্মৃতিকাতর কোনো মুহূর্তে তার নামটি মনে পড়লেও সেভাবে কি আর মনে করব সন্তানসম প্রিয় বোনটির মুখ? কিন্তু তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সী তার রেখে যাওয়া একমাত্র পুত্রসন্তানটি নিশুতি রাতের অন্ধকার গৃহকোণে থেকে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেবল সেই জানবে, কী হারাল সে?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, নারীনেত্রী