বিশেষ প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাগে-ক্ষোভে বা বুঝেশুনেই মার্কিনবিরোধী অনেক কঠিন কথা জানিয়ে দিয়েছেন সংসদে। দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে রাগ ঝাড়তে গিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ড. ইউনূস ও বিএনপিকেও টেনে এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতায় ওলট-পালট করে দিতে পারে মন্তব্য করে বলেছেন, বাংলাদেশে একটি অগণতান্ত্রিক সরকার আনতে চায় দেশটি। ড. ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, স্বনামধন্য সুদখোরকে নিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। গত ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এসব ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন, তখন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সাক্ষাতের অপেক্ষমাণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। শেখ হাসিনার বক্তব্যের ঘণ্টা কয়েক পর যথাসময়ে বৈঠক হয় দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। কথা লম্বা না করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন-শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের চোখই এখন বাংলাদেশের দিকে। তারা অপেক্ষমাণ বাংলাদেশে একটি দৃষ্টান্তমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে। জবাবে ব্লিঙ্কেনকে ধন্যবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা করেন ড. মোমেন। ব্লিঙ্কেনের এমন শর্টকার্ট কথার বৈঠককে ফলপ্রসূ উল্লেখ করতে হয়েছে তাকে। বলতে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য বাংলাদেশ গর্ববোধ করে।
অবস্থা যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা শোনার জায়গা নেই। অথবা বাংলাদেশ সেই জায়গা অবশিষ্ট রাখেনি। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে অবিরাম আঘাত করেছেন। দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত দু-দুজন রাষ্ট্রদূতকে নাজেহাল হতে হয়েছে। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে ভারত-চীন-রাশিয়ার সঙ্গে মিতালিও গোপনে হয়নি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে ঘন ঘন সফর পর্ব চলেছে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকারের সমস্যার কথা উত্থাপন করেছে, তখন বাংলাদেশের কর্তারাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ আনতে দ্বিধা করেননি। আবার র্যাবের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তোলার চেষ্টাও করেছে। এর মাঝেই র্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু এবং গণমাধ্যমকে নাজেহালের অভিযোগ। যুক্তরাষ্ট্রও কম যাচ্ছে না। স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের প্রশংসা, প্রধানমন্ত্রীকে লেখা শুভেচ্ছাপত্রে ‘জয় বাংলা’ উল্লেখ করছে, আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদও ছাড়ছে না। মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশংসামূলক প্রস্তাবও রেখেছে, যা সরকারকে বেশ পুলক দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-নেতারা সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রচার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর মাঝে কাকতালীয়ভাবে বোমা ছোড়ার মতো ছেদ ফেলেছেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয়, তা কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। সে উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।’ বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি কেন, কার উদ্দেশে এমন একটি মন্তব্য করলেন, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। কিছু মহলের কাছে এটি রহস্যজনক। সরকারের বোঝাপড়ার বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদেরও টেনে এনেছেন উন্নয়ন প্রসঙ্গ। বলেছেন, উন্নয়ন কখনোই গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির দেওয়া ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে উন্নয়নের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টার সমালোচনা করেছেন। দেশ-বিদেশ দুদিকেই এই অস্থিরতা মোটাদাগে সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। কূটনীতির বিষয় এভাবে রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠা দেশকে ভেতরে ভেতরে টার্নিং পয়েন্টে নিয়ে যাচ্ছে। আর এই টার্নিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাও অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এবারের গণতন্ত্র সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বিশ্বের আরো কিছু দেশকেও টার্নিং পয়েন্টে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বিশাল তহবিল গঠন বাংলাদেশসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের জন্য হিডেন অ্যালার্মিং। দেশটির এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট- ইউএসএআইডি কাজ শুরু করেছে বিভিন্ন দেশকে কর্তৃত্ববাদের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের। জাতিসংঘও এতে একাত্ম। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে জাতিসংঘের ‘অ্যাডভাইজরি বোর্ড অব এমিনেন্ট পারসন্স অন জিরো ওয়েস্ট’-এর সদস্য নিযুক্ত করার সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজছেন অনেকে। উন্নয়নের নামে অপচয়-দুর্নীতি রোধ এই অ্যাডভাইজরি বোর্ডের দায়িত্ব।