ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের শেষ বর্ষ চলছে আওয়ামী লীগের। ৮-৯ মাস পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সম্ভাব্য এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনে তৎপরতা দেখাচ্ছেন দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতারাও। স্বভাবতই নির্বাচন এলে দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং-তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারাও পছন্দের প্রার্থীর দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতে নিজস্ব অবস্থান থেকে তৎপরতা চালান।
আসনভিত্তিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে একই ব্যক্তিকে বারবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট আসনগুলোতে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। যদিও এখনই প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করছেন না তারা। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে দাগ পড়ার ভয়ে বিরোধিতা না করলেও বিভিন্ন ইস্যুতে গোপনে দলের মনোনীত সেসব সংসদ সদস্যের (এমপি) বিরুদ্ধে জনগণকে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। যেকোনো সময়ই এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে। ঘটতে পারে বিস্ফোরণ।
অন্যদিকে দল থেকে বারবার মনোনয়ন পাওয়া এমপিরা তোয়াক্কা করছেন না এসবের। উল্টো নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক এমপিই বিশেষ কারণ ছাড়া থাকছেন এলাকাবিমুখ। সংক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরাও এমপিদের এলাকাবিমুখিতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের পক্ষে গড়ে তুলছেন জনমত। রাজনীতির এই ধারায় যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি যেমন কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি দলের কঠিন সময়েও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আবির্ভাব ঘটতে পারে। যা দলকে সংকটময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং একটি গোছানো রাজনৈতিক দলকেও এলোমেলো করে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান জনপ্রতিনিধিদের জনবিচ্ছিন্নতা দেশের বেশির ভাগ আসনে এতটাই বিরূপ আকার ধারণ করেছে, যেখানে যেকোনো সময় ঘটতে পারে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনই জনবিচ্ছিন্নতার বিরূপ প্রভাব অনেকটাই প্রকাশ্য বিষয়। পাশাপাশি জোরালো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সংসদীয় অসংখ্য আসনে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক হালহকিকত প্রায় একই।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোনো কোনো নির্বাচনী আসনে একজন প্রার্থী টানা পাঁচ থেকে ছয়বারও দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া কোনো কোনো রাজনীতিক ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। হয়েছেন এমপিও। ফলে ওই সব এলাকায় আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। সুযোগ পাননি নতুনরা। দলটির তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। প্রতি আসনেই এমপি হওয়ার মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন, কিন্তু একই ব্যক্তি বারবার মনোনয়ন পাওয়ায় নতুন নেতৃত্ব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়নেও গতি হারাচ্ছে। তা ছাড়া মনোনয়ন পাওয়া অনেকেই এমপি হওয়ার পর এলাকার তৃণমূল মানুষের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান না। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কাছে পায় না তাদের। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের বিরক্তি তৈরি হচ্ছে এসব জনপ্রতিনিধির ওপর। এলাকাবাসীর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার নির্দেশ দেওয়ার পরও অনেকে তা মানছেন না। তৃণমূল নেতারা বলছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়ন করতে হলে বিকল্প নেতৃত্ব বা নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির বিকল্প নেই। নতুন ও বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণেরাই বেশি শক্তিশালী। তাদের সামনে আসার, নেতৃত্বে আসার সুযোগ দিতে হবে।
শুধু নেতৃত্ব নয়, দুর্নীতিসহ নানান অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে। আইন প্রণয়নই একজন এমপির কাজ হলেও তারা দূরে থেকেও নিজের পছন্দসই লোকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন এলাকার সব কাজ। সামাজিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কমিটিও এখন এমপিদের নিয়ন্ত্রণে। কাবিখা প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ, বাঁধ ও রাস্তা, নালা-নর্দমা খনন-সংস্কার, ধর্মীয়, শিক্ষা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান সংস্কার বা মেরামত, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, বাঁশের সাঁকো নির্মাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য এলাকাভিত্তিক গভীর নলকূপ স্থাপনও হচ্ছে না এমপিদের ইচ্ছার বাইরে। এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাও (উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য)।
এমপিদের প্রতি তৃণমূলের ক্ষোভের আরও একটি কারণ সরাসরি নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে কমিশনের ফলাফল বিশ্লেষণে জানা যায়, নৌকা প্রতীকের ৪৪ শতাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। এর নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় এমপিরা। দলের দেওয়া প্রতীকের বিরুদ্ধে এমপির কর্মী-সমর্থকেরা সক্রিয় তো ছিলেনই না, উল্টো এমপির আত্মীয় বা পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্যই প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। ফলে ওই সব এলাকায় এমপি জিতলেও হেরেছে নৌকা।
এসব বিষয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ বলেন, এখন দল-নির্বিশেষ আমরা দেখেছি, প্রতিবার নির্বাচনের আগে, বিশেষ করে বড় দলগুলোতে এই নমিনেশন নিয়ে রীতিমতো ডু অর ডাই একটা সিচুয়েশন তৈরি হয়ে যায়। এর একটা কারণ হচ্ছে, সমাজে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে জিরো থেকে হিরো হওয়ার, রাতারাতি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার। সেই অর্থ ও বিত্ত ধরে রাখার জন্য দরকার ক্ষমতা। বলা যায়, ডেসপারেট, অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে এ দায়িত্ব নিতে হবে এবং সে জন্য খুনখারাবি থেকে শুরু করে যত রকমের অপকৌশল আছে, তা অনেক সময় গ্রহণ করা হয়। অর্থের যে ছড়াছড়ি, সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ক্লিন পলিটিক্যাল লোক তো সবাই (জনগণ) চায়, তারা কি (রাজনৈতিক দল) দেয়? দেয় না। রাজনৈতিক দলগুলো যাকে ভালো মনে করে, তাকেই মনোনয়ন দেয়। যেভাবে আমাদের নমিনেশন সিস্টেম আছে, তাতে এর চাইতে বেশি কিছু আশা করা যায় না।