নানা সুবিধা দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবে ধীরে ধীরে খাদের কিনারে চলে যাচ্ছে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড।
মার্চ-জুন সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর থেকে জুনে বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর এক বছরে (জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।
মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় ছিল। কম সুদে ঋণ নেওয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। চলতি বছরও ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রয়েছে বিশেষ ছাড়। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না গ্রাহক। যার কারণে নানা উদ্যোগ নিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঢালাও সুবিধার কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও বিপদে পড়বে।
১ অক্টোবর রোববার অনুমোদন হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
তিন মাস আগেও মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রথম তিন (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয়, তবে সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিল, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পায়। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণ নেওয়া হয়।
খেলাপিদের বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না বলে জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘খাতা কলমে দেখানো হচ্ছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমবে। ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা আমাদের কাম্য নয়।’
সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এখন সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেন আইনে গিয়ে বছরের পর বছর না ঝুলে থাকে। এ ছাড়া খেলাপিদের সম্পদ নিয়ে নিতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প উপায় নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
ডলার সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। বাকি ছয় কিস্তির মধ্যে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত আছে। ধাপে ধাপে ঋণ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
ঠিকানা/এনআই