জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হলো গত ৭ এপ্রিল। সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ঢাকার তেজগাঁওয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদ ভবনে। সেই হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছে। তবে ৫০ বছরে এসেও সংসদীয় রাজনীতির সুফল এখনো অধরা বলেই মনে করা হচ্ছে। ১১টি সংসদে অর্ধেকের বেশি সময় বিরোধী দল ছিল নামে মাত্র। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই বিরোধী দলে ছিল, তখনই রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। এ ছাড়া ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর মতো ত্যাগী রাজনীতিকের সংখ্যাও কমে গেছে। সম্পদশালী ব্যক্তিরা সংসদে প্রাধান্য পেতে শুরু করেন।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫। অর্থাৎ প্রথম জাতীয় সংসদে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৫। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় তেজগাঁওয়ে জাতীয় সংসদ ভবনে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। প্রথম জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন মুহম্মদুল্লাহ এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন মো. বয়তুল্লাহ। পরে মুহম্মদুল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আবদুল মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন।
জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৬ এপ্রিল বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ওইদিন বেলা ১১টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অধিবেশন বসে। এদিন ‘সংসদে বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুজিববর্ষ বিশেষ অধিবেশন’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়। জাতির পিতা ছিলেন প্রথম সংসদের সংসদ নেতা। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একাদশ জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ৭ এপ্রিল স্মারক বক্তব্য প্রদান করেন। জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা কর্তৃক কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় আনীত প্রস্তাবের (সাধারণ) ওপর ৬৩ জন সংসদ সদস্য মোট ১০ ঘণ্টা ২৭ মিনিট আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এ সময় স্পিকার বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য উপহার। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বনন্দিত ও অনন্য সংবিধান প্রণয়ন ও সফলভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এদিকে জাতীয় সংসদ অর্ধশত বছর পার করলেও সংসদীয় রাজনীতির সুফল এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিগত ১১টি সংসদে অর্ধেকের বেশি সময় বিরোধী দল ছিল নামকাওয়াস্তে। বাকি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই বিরোধী দলে ছিল, তখনই তারা সংসদ বর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে জনগণের মনোযোগ হারিয়ে গেছে সংসদের কার্যক্রম থেকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসাবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সংসদে পেশায় সরাসরি ব্যবসায়ী এমন এমপি ছিলেন ১৭ দশমিক শূন্য ৫ ভাগ। বর্তমান সংসদে পেশাদার ব্যবসায়ী এমপি হলেন ৬১ দশমিক ৭৩ ভাগ।
এ বিষয়ে প্রথম সংসদের সদস্য ও প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সংসদীয় রাজনীতির সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সংসদের যে গুরুত্ব ছিল, প্রাণ ছিল, তা ধীরে ধীরে কিছুটা কমেছে। সংসদীয় রাজনীতির সৌন্দর্য হলো বিতর্ক। কিন্তু সংসদে এখন আর বিতর্ক হতে দেখা যায় না। তবে আশা করছি অতীতের সৌন্দর্য আবার ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন আইনসভা ভবনের একটি। রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার আয়তন ২১৫ একর। দৃষ্টিনন্দন এ ভবনের নকশা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত স্থপতি লুই আই কান। সংসদ ভবন এলাকাকে প্রধান ভবন, দক্ষিণ প্লাজা ও প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা এই তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। সংসদের পেছন দিকে ক্রিসেন্ট লেক নামে একটি নান্দনিক জলাধার রয়েছে। সংসদের মূল ভবনের পাশাপাশি রয়েছে উন্মুক্ত সবুজ পরিসর, মনোরম জলাধার ও সংসদ সদস্যদের কার্যালয়। ১৯৬১ সালে নয়তলা এ ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এই ভবনের উদ্বোধন করা হয়।