দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৪ মে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হবে। আর গত ২২ সেপ্টেম্বর এর প্রয়োগ শুরু হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার ও বিরোধী দল, সাবেক এবং বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যদের ওপর এটি কার্যকর করা হচ্ছে। এতে তাদের পরিবারের সদস্যরাও থাকতে পারেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে দেশের সর্বস্তরে এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি গণমাধ্যমের ওপরও এ ভিসানীতি কার্যকর করার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বা দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এখনো জানানো হয়নি নির্দিষ্টভাবে ঠিক কারা আসছেন এ ভিসানীতির আওতায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে নানা কথা চলছে। কেউ কেউ নিজের আইডিতে পোস্ট দিয়ে জানতে চাচ্ছেনÑতিনি এ নীতির আওতায় আসছেন কি না। আবার কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকায় তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, সে কারণে এ ভিসানীতি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে রাজনৈতিক দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও শঙ্কা।
এ অবস্থায় থমকে গেছে ভোটের প্রচারণা রাজনীতি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এত দিনে নির্বাচন নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত থাকার কথা থাকলেও তারা আছে স্নায়ুচাপে। পাশাপাশি নির্বাচনে সহায়তাকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আছেন চাপা আতঙ্কে। সামনে কী হবে! নির্বাচনের পরিবেশ কেমন হবে, কার কার নাম ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে, তা নিয়ে খোদ প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যেসব সচিব-অতিরিক্ত সচিবদের সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন, তারা আছেন চরম আতঙ্কে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। আমেরিকার ভিসানীতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের ওপর আরোপ করা হয়েছে, তবে তারা কারা তা জানি না। যদি ভিসানীতি আসে, তারা হয়তো দেশটিতে যেতে পারবেন না। তবে ভিসানীতির কারণে দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এলিট ফোর্স র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের ওপর নতুন করে ভিসানীতি প্রয়োগের বিষয়টি অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিচার বিভাগের বর্তমান ও সাবেক বিচারপতিরা প্রথম তালিকায় রয়েছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন রয়েছেন। স্বল্প তালিকায় রয়েছেন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও। তবে এখনই কারা তালিকায় রয়েছেন, জনসম্মুখে তা প্রকাশ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতির প্রয়োগ করেছে। তাদের মতে, অবাধ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ এখনো রয়েছে। ভোট সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হতে পারে এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোটের পথ বের হয়ে আসতে পারে।
গেল কয়েক মাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল একাধিকবার বলেছেন, বিএনপির মতো একটি বড় দল অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে তারা। রাজনীতিতে চলছে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। একসঙ্গে বসে সংকট সমাধানেরও কোনো আশা নেই। দৃশ্যত সংঘাতের পথেই রাজনীতি।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের নেতারা এ ভিসানীতি নিয়ে সরব রয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, এই ভিসানীতি শুধু সরকারি দলের জন্য কার্যকর তা কিন্তু নয়, এ নীতি বিরোধী দলের জন্যও কার্যকর হবে। ফলে এতে শুধু একটি দলের বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো মনে করছে, এই ভিসানীতির ফলে কার লাভ কার ক্ষতি তা ভাবার আগে ভাবতে হবেÑএটি জাতির জন্য লজ্জাজনক। এটি কখনোই কাম্য হতে পারে না। সরকারের নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই দেশ এখন এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে।
তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিসানীতিকে জয়-পরাজয় হিসেবে প্রচার করে এলেও ভেতরে ভীতি সবারই রয়েছে। কারণ পশ্চিমা দেশে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। ফলে রাজনীতির বাইরেও ব্যক্তিজীবনের প্রয়োজনে ভিসানীতি তাদের ওপর যদি প্রভাব ফেলে, সে আশঙ্কা তো আছেই। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমেরিকার ভিসানীতি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমেরিকা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিসানীতি করেছে। এই ভিসানীতিতে আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভিসানীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে বিধিনিষেধ এসেছে, এটি আমাদের দেশের জন্য প্রাপ্য নয়, এটি পুরো দেশের জন্য লজ্জার। এর জন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায় নেই, এককভাবে আওয়ামী লীগই দায়ী। সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগকে সতর্ক করছে, রেড সিগন্যাল দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা আমরা করি না। আমরা পরোয়া করি বাংলাদেশের জনগণকে। বাংলাদেশের জনগণ ছাড়া কোনো ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা মানি না, মানব না। আমাদের নির্বাচন আমরা করব। সংবিধান বলে দিয়েছে কীভাবে নির্বাচন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে, আটলান্টিকের ওপার থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার তুমি কে?
গবেষক ও সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল বলেন, এটি আমাদের ব্যর্থতা। আমরা সবকিছু ঠিকমতো চালাতে পারলে তো আমেরিকার আমাদের ওপর মোড়লগিরি করার কথা নয়। যেকোনো মোড়লগিরি কোনো দেশের জন্য, জাতির জন্য অসম্মানজনক। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা ছোট হলাম। অপমানিত হলাম। এটি থেকে মুক্তির পথ হলো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা। এর সমাধান হলো নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা।
 
 
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 নূরুল ইসলাম
 নূরুল ইসলাম  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
