বাহারুল আলম
গত ২৩ আগস্ট উইসকনসিন রাজ্যের মিলওয়াকি শহরে রিপাবলিকান পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনের প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মার্কিন রাজনীতির নতুন সিজন শুরু হয়। বিতর্কে দলের ১৪জন প্রার্থীর আটজন অংশ নেন। দলের জাতীয় কমিটির শর্ত পালনে সক্ষম হওয়ায় তারা বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরপর কয়েকটি জনমত জরিপে প্রার্থীর প্রতি কমপক্ষে ৩ ভাগ জনসমর্থন, কমপক্ষে ৪০ হাজার ভোটারের চাঁদাদানের অঙ্গীকার এবং পার্টির টিকেট যিনি পাবেন, তাকে সমর্থনের অঙ্গীকার ইত্যাদি। আটজন বাদে বাকিরা এসব শর্ত পালনে সক্ষম না হওয়ায় তারা বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
জনমত জরিপে বিপুলভাবে এগিয়ে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বেচ্ছায় বিতর্কে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। ট্রাম্প অবশ্য বিতর্কে অংশ না নেয়ার কারণ হিসাবে জানান যে, তিনি মার্কিন জনগণের কাছে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব এবং তিনি প্রেসিডেন্ট হিসাবে কতোটা সফল ছিলেন, সে বিষয়ে তারা সম্যক অবগত। যেসব প্রার্থীর জনসমর্থন প্রায় শূন্যের কোঠায়, তাদের সঙ্গে রাতভর বিতর্কে অংশ নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তার ভাষায়, The public knows who I am, and how successful was my Presidency.
আগামী বছরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় প্রাইমারি নির্বাচনের পূর্বে রিপাবলিকান পার্টি তিনটি বিতর্ক অনুষ্ঠান করবে। দ্বিতীয় বিতর্ক আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার সিমি ভ্যালির রেগান লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় বিতর্কের দিন, তারিখ ও স্থান এখনো নির্ধারিত হয়নি। তবে তা অক্টোবর মাসের শেষদিকে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যায়।
আগামী বছরের ২৭ জুলাই মিলওয়াকিতে অনুষ্ঠেয় রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কনভেনশনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে। ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়নের জন্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছাড়া আরো দু’জন প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেনÑ রবার্ট এক কেনেডি জুনিয়র এবং মেরি অ্যান উইলিয়ামসন।
প্রাইমারি নির্বাচনের পূর্বে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে কোন বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে না। আগামী বছরের আগস্ট মাসে শিকাগো শহরে দলের জাতীয় কনভেনশনে মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে।
প্রাইমারি নির্বাচনের পূর্বে উভয় দলের প্রার্থীরা জোর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত হবেন, যেটা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে একাধিক জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। বাইডেনও হোয়াইট হাউজের চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে এসে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন, যদিও তার নির্বাচনী কর্মকাণ্ড খুব জোরেশোরে শুরু হযেছে, সেটা বলা যাবে না।
সম্প্রতি বাইডেন একাধিক অনুষ্ঠানে মার্কিন অর্থনীতি জোরদারের লক্ষ্যে তার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিপুলভাবে সফল হয়েছে দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন। এই বিষয়টিকে তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণার মূল প্রতিপাদ্য করেছেন।
অবশ্য সাম্প্রতিক একাধিক জনমত জরিপে (নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজ পরিচলিত জরিপ ইত্যাদি) অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার এহেন দাবিকে ৫৪ ভাগ মার্কিন জনগণ অনুমোদন দেন না বলে দেখা যায়। ৩৯ ভাগ জনগণ তার দাবির প্রতি সমর্থন দেন। প্রধানত মুদ্রাস্ফীতি, গ্যাসসহ গ্রোসারি সামগ্রীর উচ্চমূল্য বাইডেনের জন্য নেতিবাচক হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে ট্রাম্প সম্প্রতি আইওয়া স্টেট ফেয়ারে গিয়ে নির্বাচনী জনসংযোগ করেন। সেখানে তার উপস্থিতি বিপুল সংখ্যক মানুষের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। দলে ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিসসহ আরো কয়েকজন প্রার্থী সেখানে উপস্থিত থাকলেও তারা তেমনভাবে মানুষের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হননি। রন ডিস্যান্টিস ফ্লোরিডা রাজ্যের গভর্নর হলেও দু’জন বাদে তার রাজ্যের সব রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক অধিকাংশ মানুষ ও দলের নির্বাচিত অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিও ট্রাম্পকে সমর্থন করেন।
অপরদিকে বাইডেনের প্রতি অধিকাংশ ডেমোক্র্যাটের সমর্থন রয়েছে।
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি ট্রাম্পের আইনী বিড়ম্বনা অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ আগস্ট ট্রাম্প চতুর্থবারের মতো অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হন। ২০২০ সালে জর্জিয়া রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল সংক্রান্ত কর্মকান্ডে অভিযুক্ত হয়ে তিনি সে রাজ্যের ফুলটন কাউন্টি জেলে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে গ্রেফতার হন। সেখানে অন্যান্য অপরাধীদের মতো তার মুখের ছবি (Mugshoot) এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়। পরে ২ লাখ ডলারের ১০ ভাগ অর্থ বণ্ড দিয়ে তিনি জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। জর্জিয়া ছাড়াও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি ও মায়ামীতে আরো তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে মোট ৯১টি অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধমূলক (Felony)। এসব মামলায় আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্তির সমূহ সম্ভাবনা থাকায় তার জেলে যাওয়া অসম্ভব নয় বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন ইতিহাসে কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টের এভাবে অভিযুক্ত হয়ে অপরাধী হিসেবে মুখের ছবি নেয়ার ঘটনা এই প্রথম। ছবি তোলার সময় তিনি নেভি ব্লু সু্যুট, লাল টাই এবং সাদা শার্ট পরিহিত ছিলেন।
ছবি তোলার সময় তিনি ক্যামেরার দিকে যেভাবে তাকান, তা দেখে মনে হয়েছে যেনো তিনি তার কোনো শত্রুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রয়েছেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতারের ঘটনায় তিনি মোটেই বিচলিত নন. কারণ তার ভাষায়, I did nothing wrong. মুখের ছবি তোলার প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, It is not a comfortable feeling, especially when you have done nothing wrong.
অন্য এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের মাগশট বিষয়ে কৌতুক করে বাইডেন বলেন, Handsome Guy!
পূর্বে ট্রাম্পের গ্রেফতারের পর যেমনটি তার জনপ্রিযতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়, এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ৫৭ ভাগ থেকে ৬১ ভাগে বৃদ্ধি পায় এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। জর্জিয়ায় গ্রেফতারের দিনে তার নির্বাচনী ফান্ডে ৪ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ জমা পড়ে।
বর্ণিত আইনী বিড়ম্বনার জেরে ট্রাম্পকে জেলে যেতে হলেও প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সেটা কোন বাধা হবে না বলে জানা যায়। সাজাপ্রাপ্তির পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, তিনি কীভাবে সাজা ভোগ করবেন এবং জেলে থেকে দেশের শাসনভার কীভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে- তা নিয়ে বহুমহলে প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া নির্বাচনী ক্যাম্পেন ও কোর্টরুমÑ এ দু’টি বিষয়কে ট্রাম্প একই সাথে কিভাবে সামাল দেন- তা নিয়েও বহু মহলে কৌতূহলের কমতি নেই।
ট্রাম্পবিরোধী কোন কোন মহল তার অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তাকে চিরদিনের জন্য যেকোনো সরকারি পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণার আওয়াজ তুলেছেন।
এক্ষেত্রে এসব মহল মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর তিন নম্বর ধারা প্রয়োগের কথা বলেছেন। এই ধারাটি নিম্নরূপ : A public official is not eligible to assume public office, if they engaged in insurrection or rebellion against the United States, or had giving aid or comfort to the enemies thereof unless he is granted amnesty by a two thirds vote of Congress. অর্থাৎ. যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব বা বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত হন, তিনি যেকোন ফেডারেল পদে নিয়োগের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের গত জুলাই মাসে করা জনমত জরিপে ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস দেয়া হয়েছে। বাইডেন যেমন অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তেমনি ট্রাম্প অর্থনীতি ছাড়াও বর্ডার, ক্রাইম, ইমিগ্রেশন ও বাইডেন পরিবারের কথিত দুর্নীতিকে ফোকাস করেছেন।
মার্কিন জনগণের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে অর্থনীতি। সেই প্রেক্ষিতে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উপদেষ্টা জেমস কারভেল বলেছিলেন,It’s Economy, stupid. জনমত জরিপের ফলাফল সব সময় সঠিক হয় না। সে কারণে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত, কয়েকবার গ্রেফতার হওয়া ট্রাম্পকে ভোটদানের ক্ষেত্রে মার্কিন ভোটারদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব নির্বাচনে বাইডেনের জন্য সহায়ক হতে পাওে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
লেখক : কলামিস্ট।