মুহম্মদ শামসুল হক
মদিনায় অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের সুরা নেছার ১৫০, ১৫১ ও ১৫২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলগণের সঙ্গে কুফর করে এবং এরূপ ইচ্ছা পোষণ করে যে আল্লাহ এবং রাসুলগণের মধ্যে (ইমান আনয়নের ব্যাপারে) পার্থক্য করে; এবং বলে (পয়গম্বরদের) কিছুসংখ্যকের ওপর ইমান রাখি এবং কিছুসংখ্যককে অবিশ্বাস করি; আর এর মাঝামাঝি একটি পথ উদ্ভাবনের ইচ্ছা পোষণ করে [অর্থাৎ মুসলমানদের মতো সকল নবীর ওপর ইমান আনে না; আবার কাফেরদের ন্যায় সকল নবীকে অবিশ্বাসও করে না। কাজেই তারা ইমান ও কুফরের মাঝামাঝি একটি নতুন ধর্ম আবিষ্কারের পাঁয়তারা করে। মূলত শরিয়তে মোহাম্মদির পরিপূর্ণ অনুসরণ ছাড়া আল্লাহর পথ পাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।], এ শ্রেণির লোকেরা সুনিশ্চিতভাবে কাফের। আর যারা আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর রাসুলগণের প্রতিও ইমান আনেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে তাদের কর্মের বিনিময় দেবেন; আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।’ আর আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগে বলেছিলেন, মুসলিম ধর্মীয় আলেমদের বিদ্বেষ-বিভক্তি, প্রতিহিংসা এবং পাণ্ডিত্য জাহিরের অমূলক প্রতিযোগিতা বিশ্ব মুসলিমকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। বর্তমানে বিশ্ববাসীর শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ এবং ঈদে মিলাদুন্নবী, নিসফেমিন সাবান ইত্যাদি ধর্মীয় দিবস উদ্্যাপনকে কেন্দ্র করে আমাদের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের বিদ্বেষ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব চরমে উঠেছে। তাই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বিশেষ আরাধনা : হে রাব্বুল আলামিন, আমাদের জানা-অজানা ভুলত্রুটি ক্ষমা করো এবং পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আমাদের আলেম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিদ্বেষ-বিভক্তির অবসান ঘটাও। আমিন!
মূলত স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত এবং বিভক্তির বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত বিশ্ব মুসলিমদের জন্য আত্মশুদ্ধি এবং আত্মোপলব্ধির বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আবারও হাজির হয়েছে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর ধরাধামে আগমন উপলক্ষে মুসলমানগণ, বিশেষত পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, বিশেষ সালাত আদায়, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে দিবসটি উদ্্যাপন করে আসছেন সেই স্মরণাতীত কাল থেকেই। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সুন্নি মুসলমানগণ এবং ১ অক্টোবর রোববার দিবাগত রাতে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়।
পটভূমি : ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, হজরত ঈসা (আ.) এর তিরোধানের পর প্রায় ৫০০ বছর আরবসহ সারা বিশ্বে পৌত্তলিকতা, অগ্নিপূজা, দেব-দেবীর আরাধনার একচ্ছত্র প্রভুত্ব কায়েম হওয়ায় তাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তৎকালে পবিত্র কাবাগৃহে স্থান পেয়েছিল ৩৬০টি মূর্তি এবং যুদ্ধলিপ্সু পৌত্তলিক আরব গোত্রগুলো অকারণে বছরের পর বছর অহেতুক যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, অভাব-অনটন এবং দায়গ্রস্ততার অজুহাত ও আশঙ্কায় কন্যা সন্ততিদের জীবন্ত কবর দিত। একই মহিলার নিকট একাধিক পুরুষের গমনের সামাজিক প্রথাও প্রচলিত ছিল। জুয়া, মদ্যপান, চুরি-ডাকাতি-লুণ্ঠন সামাজিক ব্যভিচার, পৌত্তলিকতা, অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায় দশা পুরো আরবকে গ্রাস করেছিল। সেই চরম যুগসন্ধিক্ষণে ইসলামি ইতিহাসের হস্তীর বছর, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার পবিত্র মক্কা নগরীর ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ পরিবারের হাসেমি বংশে লোকান্তরিত পিতা আবদুল্লাহ এবং মা আমিনার গৃহে জন্মগ্রহণ করেন অনাথ-এতিম মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। নশ্বর পৃথিবীতে মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর আগমনকে আখেরি নবী (সা.) স্বয়ং বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম পিতা হজরত ইবরাহিম (আ) এর দোয়া; হজরত ঈসা (আ.) এর সুসংবাদ এবং তাঁর জননী আমিনার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাহোক, তৎকালীন সামাজিক প্রথানুযায়ী অসহায়-এতিম মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়েছিল দুধমা হালিমার জরাজীর্ণ কুটিরে। জগতের কোনো ওস্তাদ বা গুরুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক অক্ষরজ্ঞান বা শিক্ষার্জনের সুযোগ না ঘটায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) কে উম্মি বা নিরক্ষর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা স্বয়ংই আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) এর জ্ঞানভান্ডারকে ঐহিক-পারত্রিক এবং পারলৌকিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা-রাষ্ট্রনায়কসুলভ দূরদর্শিতা-গতিশীল নেতৃত্ব-উদ্ভাবনী শক্তি এবং সর্ববিধ দূরদর্শিতায় টইটম্বুর করে দিয়েছিলেন। অনবদ্য কারণে পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল মোহাম্মদ (সা.) কে তাঁর পক্ষ থেকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য বিশেষ রহমত বা আশীর্বাদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
কৈশোরে অন্যান্য রাখাল বালকের সঙ্গে মাঠে বকরি চারণকালে কিশোর মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা, হাসি-তামাশায় মত্ত না হয়ে নির্জনে চারদিকের প্রকৃতি এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন আরববাসীর পাপপঙ্কিল জীবনব্যবস্থা নিয়ে চিন্তায় মশগুল থাকতেন। সেই যুগের অধঃপতিত পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিশোর মোহাম্মদ (সা.) এর হৃদয়ে অহর্নিশ রক্তক্ষরণ হতো। আজীবন সত্যবাদিতার সুবাদে শত্রু-মিত্র, আপন-পর, আরব-অনারব নির্বিশেষে সবার কাছ থেকে তিনি আল আমিন (পরম সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। যৌবনে আরবের ঐশ্বর্যশালিনী বিধবা মহিলা বিবি খাদিজার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অসামান্য দক্ষতা, পারঙ্গমতা ও সততার বিলক্ষণ নজির স্থাপন করেছিলেন মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। তাঁর গুণাবলিতে বিমুগ্ধা ৪০ বছর বয়স্কা বিবি খাদিজা ২৫ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ (সা.) কে পাণি গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে উভয় পরিবারের সম্মতিতে তাঁরা সামাজিক রীতি অনুসারে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিবি খাদিজার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর মোহাম্মদ (সা.) এর আর্থিক সংকটের অবসান ঘটায় তিনি নির্জন হেরা গুহায় আল্লাহর ধ্যানে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার অঢেল সুযোগ পেলেন।
এদিকে ৪০ বছর ৬ মাস বয়সে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাকুল শিরোমণি হজরত জিবরাইল (আ.) কে ধ্যানমগ্ন মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর নিকট হেরা গুহায় প্রেরণ করলেন। হজরত জিবরাইল ধ্যানমগ্ন মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে পবিত্র কোরআনের ‘ইকরা বিসমি রাব্বুকাল খালাক’ পাঠ করে শোনান এবং তাঁকে রাসুলুল্লাহ বা আল্লাহ প্রেরিত পুরুষের মর্যাদায় ভূষিত করলেন। নবুয়ত লাভের পর মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.) যাবতীয় নিগ্রহ-অত্যাচার, নিষ্ঠুর নির্যাতন ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নীরবে সহ্য করে যুদ্ধলিপ্সু পৌত্তলিক আরবদের নিকট আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার শুরু করেন। এদিকে নিজেদের সনাতনী আভিজাত্য খর্ব, চিরায়ত আয়ের উৎস বিনষ্টসহ সামাজিক ও ধর্মীয় নানা কারণে আরবের প্রবল প্রতাপান্বিত পৌত্তলিক সম্প্রদায় দিনে দিনে মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি খড়গহস্ত হয়ে উঠল। ইসলাম প্রচার থেকে হজরত মোহাম্মদ (সা.) কে নিবৃত্ত রাখার কৌশল হিসেবে পৌত্তলিকরা নানা লোভনীয় ও মনোমুগ্ধকর প্রস্তাব করেছিল ও ফন্দি এঁটেছিল। মোহাম্মদ (সা.) পৌত্তলিকদের সকল প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘কেউ আমার এক হাতে চন্দ্র ও অপর হাতে সূর্য এনে দিলেও আমি ইসলাম প্রচার থেকে বিরত হব না।’ এতে ব্যর্থকাম পৌত্তলিক সরদাররা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হলো এবং মোহাম্মদ (সা.) কে হত্যা করার বজ্রকঠোর সংকল্প গ্রহণ করল। এ পর্যায়ে জীবনসঙ্গিনী বিবি খাদিজা এবং পিতৃব্য আবু তালেবের মৃত্যুর পর নবীজী (সা.) যথেষ্ট শোকাহত এবং অনেকটা ভেঙে পড়লেন। সেই মুহূর্তে পরম করুণাময় আল্লাহর নির্দেশে মোহাম্মদ (সা.) মাতৃভূমি মক্কার মায়া ত্যাগ করে ইয়াসরিব বা মদিনায় হিজরত করেন। পরিশেষে সকল ধরনের অমানুষিক ত্যাগ স্বীকার ও যুদ্ধবিগ্রহ মোকাবিলা ও জয়লাভের পর বিশ্বপ্রতিপালকের অপরিসীম রহমতে মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নেতৃত্বে নবদীক্ষিত মুসলমানগণ অষ্টম হিজরিতে বিনা যুদ্ধে মক্কা জয় করেন। বস্তুত, পাপসাগরে নিমজ্জিত পৌত্তলিক আরববাসীকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দান, পৌত্তলিকতার সমূল উৎপাটন এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবসহ আশপাশের বিশ্বকে আল্লাহর একত্ববাদের আলোকে উদ্ভাসিত করার পর ৬৩ বছর বয়সে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার হজরত মোহাম্মদ (সা.) ইহলোক ত্যাগ করেন।
দুঃখীর দুর্দশা লাঘবে মহানবী (সা.) : বিবি খাদিজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর অঢেল ধনসম্পদের মালিক মোহাম্মদ (সা.) বিশাল বিত্ত-বৈভবের কানাকড়িও ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে ব্যয় করেননি।
মিতাচারী-মিতাহারী এবং স্বল্পে পরিতুষ্ট শ্রেষ্ঠ নবী মোহাম্মদ (সা.) বিবি খাদিজার সম্মতিক্রমে রাশি রাশি অর্থ দুঃখীদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে অকাতরে বিলি করে পরার্থপরতার বিলক্ষণ নজির স্থাপন করলেন। সাম্যবাদের প্রবক্তা এবং আদর্শ সমাজ সংস্কারক হজরত মোহাম্মদ (সা.) অনাথ-এতিম ও অপরের সহায়-সম্পদ রক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ, পরার্থে জীবন উৎসর্গের মহান দীক্ষা ও জীবনের সর্বস্তরে ও ক্ষেত্রে সদ্ব্যবহার এবং সদাচরণ অনুশীলনের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন স্বীয় অনুসারীদের। ছোটকে স্নেহ, বড়কে শ্রদ্ধা, অসহায়কে সাহায্য, পরস্পরের সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় নবী (সা.)। শান্তির ধর্ম ইসলাম মহিলাদের সম্মান, স্বার্থ এবং সম্ভ্রম রক্ষায় দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করছে এবং পিতার ও স্বামীর সম্পত্তিতে মহিলাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করেছে। সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-ব্যভিচার ইসলাম ধর্মে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হলেও বর্তমান মুসলিম সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা বিস্তার লাভ করছে। অন্যের প্রতি অমূলক বিদ্বেষভাব পোষণ, বাগাড়ম্বরিতা বা অতিকথন, অপরের হক তছরুপ, আমানতের খিয়ানত, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে।
দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ (সা.) : সকল মানবিক-অতিমানবিক-অলৌকিক গুণে গুণান্বিত হজরত মোহাম্মদ (সা.) অন্যায়-অনাচার-ব্যভিচার, শোষণ-নির্যাতন-লুণ্ঠন মুক্ত পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীকে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে হজরত মোহাম্মদ (সা.) ঐতিহাসিক মদিনা সনদ প্রণয়ন করে কল্যাণকর রাষ্ট্র পরিচালনার যে যুগান্তকারী ইতিহাস রচনা করেছিলেন, তা অদ্যাবধি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় ম্যাগনাকাটা বা দিগ্্দর্শন যন্ত্র হিসেবে অনুসৃত হয়ে থাকে। অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের পরিবর্তে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়া চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বিনা যুদ্ধে মক্কাজয়ের যে পথ মহানবী (সা.) রচনা করেছিলেন, তা বিশ্ববরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক ও সমরবিশারদদের সকল প্রজ্ঞা-দূরদর্শিতা-রণকৌশলকে হার মানিয়ে দিয়েছে।
সমরনায়ক মোহাম্মদ (সা.) : আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার ছাড়াও দুর্ধর্ষ পৌত্তলিকদের চাপিয়ে দেওয়া বদর-উহুদ-খন্দক-তাবুকসহ বিভিন্ন যুদ্ধে সুদক্ষ সমরবিশারদ হিসেবে মোহাম্মদ (সা.) যে অসামান্য রণকৌশল প্রদর্শন করেন, তার নিকট বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার ও অন্যদের কৌশলও হার মানতে বাধ্য।
ক্ষমার মূূর্ত প্রতীক : ক্ষমা ও ঔদার্যের অদ্বিতীয় মহাপুরুষ হজরত মোহাম্মদ (সা.) বিনা রক্তপাত এবং যুদ্ধে মক্কা বিজয়ের পর আজন্মের শত্রু মক্কাবাসীকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়ে পরম ঔদার্য এবং মহত্ত্বের যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, মানব ইতিহাসে তার প্রমাণ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ভবিষ্যৎ হুঁশিয়ারি ও ঐতিহাসিক বিদায় হজ : বিদায় হজের ভাষণে আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) আরাফাত ময়দানে সমবেত ১ লাখ ২৫ সহস্রাধিক হজ পালনকারীর সম্মুখে বিশ্ব মুসলিমের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ এবং পার্থিব জীবনবিধান বা কমপ্লিট কড অব লাইফ হিসেবে পবিত্র কোরআন ও হাদিস গ্রন্থাবলির কথা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মর্মবাণী অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য সমবেতদের প্রতি জোর তাগিদও দিয়েছিলেন মহানবী (সা.)। সেই অবিনশ্বর ভাষণে মহানবী (সা.) সমষ্টিগতভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আরব-অনারব, আশরাফ-আফতার, ধনী-নির্ধন, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণদাসের ভেদাভেদ না থাকার; মহিলাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে; জীবনের সর্বস্তরে ন্যায়-নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করার; বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন এবং একের অপরাধে অন্যের প্রতি দোষারোপ না করার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণাও দিয়েছিলেন। সেই পবিত্র দিবসেই আল্লাহর পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ আয়াত ‘আল ইয়ামো মা আকমালতো লাকুম দ্বিনুকুম, ওয়া আতমামতো আলাইকুম নেমাতি ওয়া রাজিতু লাকুমাল ইসলামো দ্বীনান’ অবতীর্ণ হয়েছিল। তারপর সমবেতদের সমভিব্যাহারে দুহাত ঊর্ধ্বাকাশে তুলে ধরে হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘হে রাব্বুল আলামিন, আমি হয়তো-বা আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। তুমি দয়া করে আমার অক্ষমতাজনিত অপরাধ ও ভুলত্রুটি মার্জনা করিয়ো।’ অশ্রুসিক্ত নয়নে ও জলদগম্ভীর কণ্ঠে সোয়া লাখ হাজি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ঘোষণা করলেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন। আখেরি নবী মোহাম্মদ (সা.) এর নশ্বর পৃথিবী ত্যাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত সংবলিত উপরিউক্ত আয়াতটি শ্রবণের পর ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) নিতান্ত শিশুর মতো হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলে উপস্থিত জনতাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। মোদ্দাকথা, পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় আঙ্গিকে এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক, ন্যায়বিচার এবং মানবতাবোধের বিচারে মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সমকক্ষ কোনো সৃষ্টি নশ্বর পৃথিবীতে জন্মেনি বললে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। অনবদ্য কারণে বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবন বলেছেন, মোহাম্মদ ইজ দ্য অনলি অ্যাকমপ্লিসড পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (Mohammad [sm.] is the only accomplished person in the world. একমাত্র ষোলকলা পুরো শশী)। আর প্রথিতযশা গ্রন্থকার মাইকেল এইচ হার্ট তার অনবদ্য সৃষ্টি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনীগ্রন্থের শুরুতেই মোহাম্মদ (সা.) কে স্থান দিয়েছেন।
স্মর্তব্য, স্বল্প সংখ্যক মোনাফেক ছাড়া আখেরি নবী (সা.) এর জীবদ্দশায় বিশ্ব মুসলিম ঐক্য এবং সংহতির ডোরে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ ছিল। পক্ষান্তরে মহানবী (সা.) এর তিরোধানের অব্যবহিত পরপরই নবগঠিত মুসলিম সাম্রাজ্যে ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আনসার-মোহাজের, শিয়া-সুন্নি-খারেজি এবং পরবর্তীতে এর রেশ ধরে আলেম-ওলামা এবং ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের বিভেদ-বিভক্তি চরম আকার ধারণ করে। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মতগণ ৭২/৭৩ কাতারে বিভক্ত হবে এবং একটিমাত্র কাতার ছাড়া বাকিরা জাহান্নামি হবে। নবীজি (সা.) আরও বলেছিলেন, আখেরি জমানায় প্রজ্বলিত আগুনের কণিকা হাতে ধরে রাখার চেয়েও ইমান নিয়ে টিকে থাকা অধিকতর কষ্টসাধ্য হবে। সম্ভবত, সেই অনাকাক্সিক্ষত দিনগুলো বেশি দূরে নয় এবং দিনে দিনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মহাধ্বংসের লক্ষণগুলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। চুন থেকে পান খসে পড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিংবা শয়তানের প্ররোচনায় ও ব্যক্তিস্বার্থে আধুনিক অতিশিক্ষিত ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণের অনেকেই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন এবং মহানবী (সা.) এর হাদিসের ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। তাদের অভিনব ব্যাখ্যা ও বক্তব্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টিতে নিত্যনতুন ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং কাফের ফতোয়ার জোয়ারে বর্তমান মুসলিম বিশ্ব সয়লাব। যাহোক, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) এর মতো দিবসগুলোতে বিদগ্ধ আলেমগণের ধর্মীয় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমাদের মরচে ধরা ইমান ও আমলকে শাণিত করে। তাই এবারের পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ইসলামের মৌলিক আদর্শচ্যুত এবং স্বার্থান্ধ বিশ্ব মুসলিমের ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনয়ন করুক-এ কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩