Thikana News
২২ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশি মিষ্টি মেয়ে রুমানার গল্প

বাংলাদেশি মিষ্টি মেয়ে রুমানার গল্প
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজর মিজান রহমানের কন্যা রুমানা। তিনি একজন প্রোগ্রাম স্কলারশিপ ইত্যাদিসহ গ্র্যাজুয়েশন করেছিল। রুমানা বেশ কয়েকটি নামকরা কলেজ/ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বাড়ির কাছে, বিশেষত তার মায়ের কাছে থাকার নিমিত্তে সে নিউইয়র্ক স্টেট কলেজ, এই লং আইল্যান্ডেরই সুবিখ্যাত স্টোনিব্রুক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। সে কৃতিত্বের সঙ্গে যথাসময়েই কলেজ সমাপ্ত করে। কলেজে থাকাকালীন সে শেষের দুই বছর রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে রেসিডেন্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট (আরএ) হিসেবেও কাজ করে সুনাম অর্জন করে। রুমানা আমার সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশি আমেরিকান ডাক্তারদের বিভিন্ন সম্মেলন ও অনুষ্ঠানাদিতে যায় এবং অনুপ্রাণিত হয় যে সে ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হবে, এমনকি একজন নিউরোলজিস্ট বা নিউরো-সার্জন হবে- এ রকম উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে তার কলেজ পাঠ্যসূচি হিসেবে মেজর সাবজেক্টগুলো নির্বাচন করে পড়াশোনা করে। তার সেই উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখেই সে কলেজে থাকাকালীন লং আইল্যান্ডের একটি নামকরা হাসপাতাল, নর্থ-ওয়েল হেলথে দুই সামারে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে সে বাংলাদেশি আমেরিকান একজন নামকরা ডাক্তারের মেডিকেল প্র্যাকটিসে নিয়মিত পার্ট-টাইম জব হিসেবে ‘শ্যাডোওইং’ করার মাধ্যমে একজন মেডিকেল অ্যাডমিন হিসেবে কাজের ট্রেনিং নেয়। কলেজ শেষ করার পর রুমানা বছর দুয়েকের জন্য গ্যাপ নিয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা ইউএসএমএলইর জন্য প্রস্তুতি নেয়। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ প্যান্ডামিকের সময় থেকে শুরু করে সে নিউইয়র্কের একজন নামকরা প্লাস্টিক সার্জনের বড় একটি প্র্যাকটিসে একজন মেডিকেল অ্যাডমিন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বছর দেড়েক ফুল-টাইম কাজ করে। এর তিনটি ডিফারেন্ট লোকেশনÑলং আইল্যান্ড, ব্রুকলিন ও ম্যানহাটনে সে নিয়মিত কাজ করার জন্য যাতায়াত করে। মিষ্টি মেয়ে এবং অতি পরিশ্রমী রুমানা ছোটবেলা থেকেই তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে লং আইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের দ্বারা নির্মিত ও প্রতিষ্ঠিত লিমস মুসলিম সেন্টারে গিয়ে অ্যারাবিক ক্লাসে কোরআন ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে। একই সময়ে তারা নিউইয়র্কে কুইন্সে উদীচীর উইকেন্ড স্কুলে গিয়ে বাংলা পড়তে, লিখতে ও গান গাইতে শেখে। যদিও তার ভাই এ বিষয়ে তেমন মনোযোগী ছিল না। আমার বড় ছেলে মঞ্চ অভিনয়ে বা কৌতুক পরিবেশন করে দর্শকদের কিছুটা আনন্দ দিয়েছিল, কিন্তু রুমানা নিয়মিত হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাংলা গানের চর্চা করেছিল। রুমানা উপস্থিত বক্তৃতায় তার মিডল স্কুলে ইংরেজি ভাষায় যেমন, তেমনি করে উদীচীর বাংলা স্কুলেও বাংলা ভাষায় সে সমান পারদর্শী ছিল। তবে হাইস্কুল যাওয়া থেকে শুরু করে কলেজ অবধি সে বাংলা চর্চা বা বাংলায় গান গাওয়া তেমন আর চালিয়ে যেতে পারেনি। আমার মতে, তার দুটি কারণ ছিল। একটি হলো সময় ম্যানেজ না করতে পারা এবং দ্বিতীয়টি হলো রুমানা অনেকটা ধর্মীয় অনুশীলনে আরও বেশি মনোনিবেশ করে। সে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় এটা বুঝতে পেরেছে এবং গ্রহণ করেছে যে এই আমেরিকাতেও সে একটি মুসলিম মেয়ে বা নারী এবং তাকে অনেক কিছুই বাছবিচার করে চলতে হবে। রুমানা যদিও ছোটবেলা থেকেই পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত পোশাক পরিধান করায় অভ্যস্ত ছিল, এমনকি নিয়মিত সালোয়ার-কামিজ এবং মাঝে মাঝে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে শখ করে শাড়ি পরত। কিন্তু গত রোজার পর রুমানা সিদ্ধান্ত নিল, সে সার্বক্ষণিক বা নিয়মিত হিজাব পরবে। রোজার ঈদের পর পরই সে আমাকে বলল, ‘বাবা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এখন থেকে হিজাব পরব।’ আমি বললাম, ‘যা কিছু তোমাকে সুখী করবে, তুমি তা করতে পারো। তুমি সুখী থাকলে আমিও সুখী হব। তবে এটা একটা বিরাট দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একবার সিদ্ধান্ত নিলে তা পরিবর্তন করা কঠিন হতে পারে বা তোমার পক্ষে সে বিষয়ে খাপ খাইয়ে চলাটা অধিকতর কঠিন হতে পারে।’ তার জবাবে রুমানা আমাকে বলল, ‘বাবা, আমি বিগত কয়েক বছর ধরেই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে আসছি এবং প্রতি রমজান মাসেই এ বিষয়টা আমাকে দ্বিধান্বিত করে আসছিল। অবশেষে এই রমজানে আমি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি এখন থেকে হিজাব পরব। বিশেষত মেডিকেল স্কুল শুরুর আগেই আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাই।’ মেয়ের মধ্যে সেই দৃঢ় প্রত্যয় দেখে এবং তার চারিত্রিক বলিষ্ঠতার কথা জেনে আমি তাকে সম্মতি দিলাম এবং তাকে উৎসাহিত করলাম।
রুমানার শখ বা হবির মধ্যে সে নিয়মিত জিমে গিয়ে শরীরচর্চা করা, বইপড়া, তার বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, যেমন শপিং করা, মুভি দেখা বা ডাইনিং আউট ইত্যাদিসহ মাঝে মাঝে পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি বা গেট টুগেদারে যোগদান করত। সে ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সঙ্গে এই আমেরিকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে এবং দেশের বাইরে বেড়াতে যেতে পছন্দ করে। অতি সম্প্রতি সে তার দুই ভাই, এক বান্ধবী ও বান্ধবীর ভাই এবং তাদের আরেক বাল্য-বান্ধবীকে নিয়ে গ্রিসে ঘুরে এসেছে। কিশোরী বয়সে সে তার বড় ভাইকে নিয়ে লন্ডন ও প্যারিস ঘুরে এসেছে। সে আমার সঙ্গে বিভিন্ন করপোরেট স্পন্সরড ডেস্টিনেশনেও বেড়াতে যেতে পছন্দ করে। এ বছর বাপ-বেটি মিলে ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডের এক দেশ থেকে ঘুরে এসেছি। রুমানা যদিও ফ্যাশনসচেতন কিন্তু তা করতে গিয়ে সে যে একজন মুসলিম নারী, তা মনে রেখেই নিজের ফ্যাশন-শখ মেটাবে। অতি সম্প্রতি লং আইল্যান্ডে ‘বাংলাদেশি-আমেরিকান নাইট’ উদযাপিত হয় এবং সেখানে প্রথমবারের মতো ‘ফ্যাশন শো বাই নিউ জেনারেশন অব বাংলাদেশি-আমেরিকানস’ নামে একটি পর্ব ছিল, যা বাংলাদেশি-আমেরিকান এক স্বনামধন্য ফ্যাশন-কাপল, যারা গত বছর প্রথমবারের মতো নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে (এনওয়াইএফডব্লিউ) বাংলাদেশি ফ্যাশন শো উপস্থাপনা করে, তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। সেখানে যখন রুমানাকে আমন্ত্রণ করা হয় ফ্যাশন-রান-এ যোগদান করার জন্য, তখন রুমানা সম্মত হয়। তবে তার শর্ত ছিল, তাকে একজন মুসলিম নারী হিসেবে সেই ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। তারা সবাই মিলে প্রায় চার মাস যাবৎ সেই ফ্যাশন শোর জন্য প্র্যাকটিস-রান করে। অবশেষে বাংলাদেশ নাইট অনুষ্ঠানটি গত ১১ আগস্ট লং আইল্যান্ডের বিখ্যাত এআইজেনহাওয়ার পার্কে গ্রীষ্মের এক রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে ও সন্ধ্যায় লেকের পাড়ে হ্যারি চ্যাপিন লেক সাইড থিয়েটারের সেই উন্মুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। তখন আমাদের নতুন প্রজন্মের সকল অংশগ্রহণকারীই উপস্থিত দর্শকদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং রুমানার পোশাক (শাড়ি) ও তা পরিধানের যে সংযোগটা সে দেখিয়েছিল, তা নিয়ে প্রচুর আনন্দ-গুঞ্জন ও তারিফ শুরু হয়।
ওই অনুষ্ঠানের পর সোশ্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় কিছু পত্রিকায় যখন সেই বাংলাদেশ নাইট ও ফ্যাশন শোর খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমি নিউইয়র্কের বেশ কয়েকটি স্থানীয় বাংলা টিভি, নিউজ চ্যানেল ও মুসলিম সংগঠন থেকে রুমানার ব্যাপারে জানার জন্য এবং তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য প্রস্তাব পায়। তবে রুমানা সেসব মিডিয়া কভারেজের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। বরং সে তার পড়াশোনার বিষয়েই মনোযোগী থাকতে পছন্দ করে। মূলকথা হলো ফ্যাশন শো মানে যে নারীদের শরীর দেখানো নয়, এই মেসেজটা রুমানা তার স্বল্প একটা প্রয়াসে অতি সার্থকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে, যা কিনা অনেকেরই নজর কেড়েছে।
সবার দোয়ায় রুমানা তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে নিউইয়র্কের নামকরা এনওয়াইআইটি ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ওসথেওপ্যাথিক মেডিসিনে তার মেডিকেল স্কুলের পড়াশোনা শুরু করে। গত ১৬ আগস্ট তাদের ‘হোয়াইট কোট সিরিমনি’র মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাস অব ২০২৭-এর দীর্ঘ যাত্রা শুরু হয়। এ দেশে একজন চিকিৎসক বা ডাক্তারের পেশাগত জীবনে অনেক সম্মান, কর্মক্ষেত্রে পরিতৃপ্তি ও আর্থিকভাবে সচ্ছলতার নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও এর যাত্রাপথ দীর্ঘতম এবং অনেকটা অনিশ্চিত। পর্যাপ্ত পরিমাণ টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচের দায় থাকা সত্ত্বেও অনেক কঠিন পরিশ্রমী হওয়া, একাগ্রতা, শৃঙ্খলা মেনে চলা এবং মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে। চার-পাঁচ বছরের মেডিকেল স্কুল শেষ করার পর তাদেরকে আরও তিন-চার বছরের জন্য ট্রেনিং (রেসিডেন্সি) করতে হয়। তারপর আরও দুই থেকে চার বছরের জন্য কাক্সিক্ষত কোনো স্পেশাল্টিতে ফেলোশিপ করতে হয়। সুতরাং এ দেশে মেডিকেল কলেজের যাত্রাপথের ‘টানেল’টা অনেক লম্বা এবং দুর্বিষহ হতে পারে, তবে টানেলের শেষে রয়েছে কাক্সিক্ষত পুরস্কার ও আলোর বন্যা। পাঠকদের কাছে আন্তরিকভাবে আমার মেয়ে রুমানার জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করছি এবং সেই সঙ্গে এ দেশে আমাদের নতুন প্রজন্মের সকল ছেলেমেয়ের জন্য উত্তরোত্তর তাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য কামনা করছি।

কমেন্ট বক্স