Thikana News
১৯ অক্টোবর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪


 

পাচারে টালমাটাল দেশের অর্থনীতি

পাচারে টালমাটাল দেশের অর্থনীতি


অভিনব নানা পন্থায় দেশের টাকা বিদেশে পাচার হতে থাকায় অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থপাচারের উল্লেখযোগ্য পন্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, গেমিং, বেটিং, এমএলএম, ই-কমার্স প্রভৃতি। কার্যকর উদ্যোগের অভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না পাচার। ফলে পতন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, উত্তপ্ত হচ্ছে ডলার মার্কেট। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার কারসাজিতে জড়াচ্ছে। পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে আমদানিতে লাগাম টেনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে। জ্বালানিসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে যাতায়াতসহ জীবনধারণের সব খাতে ব্যয়ও বেড়েছে।
এত দিন পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছিল। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি এলসি পরীক্ষা শুরু করে। এতে দেখা যায়, ২০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার করছিল একাধিক চক্র। এর লাগাম টানতে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়নি। এরপর বেরিয়ে আসে রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে (আন্ডার ইনভয়েসিং) অর্থপাচারের তথ্য। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ। গেমিং, বেটিং, এমএলএম ও ই-কমার্সের মাধ্যমেও অর্থপাচার অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে অর্থপাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারক চক্র। তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (সিআইআইডি) কর্মকর্তারা।
সিআইআইডি সূত্রে জানা গেছে, ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এসেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে প্রতারক চক্র। সংস্থাটির তদন্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব পণ্য রপ্তানি করতে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ কম মূল্য দেখানোর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যকে ‘নমুনা’ পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। নমুনা পণ্য হিসেবে দেখানোর কারণে এসব পণ্যের বিপরীতে দেশে কোনো টাকা প্রবেশের সুযোগ নেই। সিআইআইডি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তিন ধাপে ছয় মাস তদন্তের পর এ জালিয়াতি উদ্্ঘাটন করেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থপাচারের জন্য প্রতারকেরা এনবিআর সার্ভারে কোড-২০ ব্যবহার করে, যা প্রকৃত রপ্তানির আগে আমদানিকারকদের কাছে ‘নমুনা’ প্রেরণের নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের প্রশ্নই আসে না। এ ছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং বা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো বা পণ্যের পরিমাণ কম দেখানোর মাধ্যমে ২৯টি প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচার করেছে। পাচারের কারণে ডলার বাজারে যে অস্থিরতা চলছে, তার সুযোগ নিয়ে ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। কারসাজির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি সাতটি মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। বেশি দামে ডলার বিক্রি করায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযোগ, এসব ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রানীতি ও মুদ্রানীতি পরিপন্থী কার্যকলাপ করছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে ব্যাংকগুলো বলছে, সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের আমদানি দায় পরিশোধ করতে বাধ্য হয়ে তাদেরকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। কারণ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাবদ পর্যাপ্ত ডলার সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, বাজারে ঘোষিত দামে ডলার পাওয়া যায় না। তাই বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। এ জন্য বিক্রির ক্ষেত্রেও বেশি দাম নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক সময়মতো আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে না। আবার ব্যাংক প্রতি ডলারে চার-পাঁচ টাকা লোকসানও করতে পারে না।
এদিকে বর্তমানে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার চক্র অধিক সক্রিয়। এর প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সে। কাক্সিক্ষত রেমিট্যান্স তো আসছেই না, বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে দেশে রেমিট্যান্স কম এসেছে জুলাই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ। আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। পরিমাণের দিক থেকে এক মাসের ব্যবধানে দেশে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। রেমিট্যান্স নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের একই মাস অর্থাৎ আগস্টের তুলনায় রেমিট্যান্স কমছে আরও বেশি হারে। যেমন এবারের আগস্টে রেমিট্যান্স ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ কোটি ডলার কম এসেছে। গত বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। গত ছয় মাসের মধ্যে এই আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছে সবচেয়ে কম।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, বেশি দামের পণ্য কম দামে এলসি খুলে বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা হচ্ছে। বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস হয়েছে।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকগুলো অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত দুদকের এখতিয়ার থেকে সরিয়ে নেওয়ার ফলে অর্থপাচারের ক্ষেত্রে দুদক তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ সংশোধন করে দুদকের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
 

কমেন্ট বক্স