মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার
জন্মের পর থেকে হাল সময়ে বিএনপি সব চেয়ে কঠিন সময় পার করছে বলে অভিমত দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। তার এ অভিমত ও মূল্যায়নের বাস্তবতা অবশ্যই রয়েছে। তাহলে করণীয় কী? কেবল ঘুরে দাঁড়ানো? ঘুরে দাঁড়িয়ে যেখানে ছিল বা আছে সেখানে থাকলে হবে? মোটেই না। ঘুরে দাঁড়িয়ে শিনা টান করে সামনে এগোনো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বিএনপির। নইলে বর্তমান দশায়ও থাকার সুযোগ পাবে না দলটি। বরণ করতে হবে আরো ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতি। যেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা-শক্তি-সাহস কোনোটাই দলটির কর্মীদের অনুভব করার বাস্তবতা আর থাকবে না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে অতীতের নানা ব্যর্থতা ও গ্লানি মুছে সামনে এগোবার প্রত্যয় এবার বেশি বিএনপিতে। সেই ক্ষেত্রে তাদের বিএনপির জন্ম এবং প্রয়োজনের পাঠপঠন বেশি জরুরি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপি। এর তিন বছর পার না হতেই নিহত হন দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান। এরপর একাধিকবার বড় ধরনের ভাঙনের মুখেও পড়ে দলটি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। চার দফায় রাষ্ট্রক্ষমতায়ও এসেছে। কিন্তু ১/১১ সরকার বিএনপিকে যে ধকল দিয়ে গেছে এর ফলোআপ চলছে এখনো। ওয়ান ইলেভেন সরকারের দু’বছর, বর্তমান সরকারের ১৫ বছর মিলিয়ে টানা ১৭ বছর অবিরাম আজাব ভোগ করে চলছে দলটি। এরপরও এখন পর্যন্ত সাফল্যের জায়গা একটিই, দলটি এখনো ভাঙেনি। ভাঙন ধরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের নিজস্ব ঐক্য ও একটি প্রত্যয়ের কারণে।
দলের অন্তপ্রাণ নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপিই এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রবর্তন করেছে। আর বিএনপির নেতৃত্বেই ছিনতাই হওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। দেশের আকাশ কালোমেঘ দূর হয়ে গণতন্ত্রের নতুন সূর্য উদয় হবে বলে বিশ্বাস তাদের। জিয়াউর রহমান নিহতের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপির বাঘা বাঘা অনেক নেতা এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। নেতৃত্বহীন বিএনপির হাল ধরেন প্রয়াত জিয়াউর রহমানের সহধর্মীনি বেগম খালেদা জিয়া। গৃহবধূ খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন রাজপথের নেত্রী। গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করলে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
১৯৯১ সালে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হোন খালেদা জিয়া। ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলেও সে সময়ের বিএনপির শাসনামল অনেকটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে। ২০০১ থেকে ২০০৬ শাসনামলে দলটি দুর্নীতিকে পাশ কাটাতে পারেনি দলটি। পারেনি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ইমেজকে সম্মান দিতে। ক্ষমতার উন্মাদনায় তারা আঁচও করতে পারেননি ওয়ান ইলেভেনের মতো একটি সর্বনাশা ভোগান্তির আয়োজন যে ধেয়ে আসছে। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতায় এসেই আটক করে খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপির শীর্ষনেতাদের। তখন দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে।
পরে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় ম্যারাথন ভোগান্তি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি দলটি। এমনকি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে নেওয়া হলেও রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি চারবার ক্ষমতায় থাকা দলটি। দণ্ড ঘোষণার পর রাজনীতি থেকে দূরে আছেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করছেন।
এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের মনে নানা শঙ্কা দানা বাধলেও বড় সাফল্য হচ্ছে- বিএনপিতে ভাঙন ধরেনি। এর মূলে জিয়াউর রহমানের কর্ম ও জীবনের কিছু চর্চা দলটির কারো কারো মধ্যে এখনো অবশিষ্ট আছে বলেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে কেবল তার নিজের দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন না। তাদের বিশ্লেষণে বিএনপির প্রতিপক্ষ দল আওয়ামী লীগের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতাও তিনি। এরকম ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল বা নেই বললেই চলে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ দলটির বিলুপ্তি ঘোষণা করে বাকশাল গঠন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করার পর জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্র ঘোষণা এবং তারই আলোকে ’৭৫-এ বিলুপ্ত ঘোষিত আওয়ামী লীগ চার বছর পর ১৯৭৯ সালে পুনঃজন্ম লাভ করে। শুধু তাই-ই নয়, পার্টির কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বর্তমান অফিসটিও আওয়ামী লীগের নামে বরাদ্দ দেন জিয়া ।
জিয়া বিএনপি গঠন না করলে দেশে তখন কারা থাকত? এলোমেলো সব কতগুলো রাজনৈতিক দল দাপিয়ে বেড়াত। আর বাকশাল তো এমনিতেই সব গণতন্ত্রকামী মানুষের আস্থা হারিয়েছিল। কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপির জন্ম? কেন এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছে দলটি অল্প সময়ের এতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে? Ñএসব জানতে হলে একটু পেছনে যাওয়া দরকার। জেনারেল জিয়া নিজে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি নিজে সেনাপ্রধান হননি যদিও তিনি প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর চেয়ে সিনিয়র ছিলেন, তার চেয়ে যোগ্যও ছিলেন, পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে টার্ম কমান্ডার ছিলেন।
একাত্তরে সর্বপ্রথম সেনা অফিসার যিনি জীবনের ও পরিবারের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষার জন্য যদি কেউ ব্যর্থ বলে বিবেচিত হন তবে তিনি জিয়া নন। তখন যিনি শীর্ষে ছিলেন তিনিই তার দায় বহন করেন। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর তিনি বন্দি ছিলেন। জাসদের তৈরি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও কর্নলে ফারুক-রশিদ-ডালিমদের তৈরি সেনা পরিষদ যে অফিসার হত্যাযজ্ঞ চালায় তার দায় জিয়ার নয়। কর্নেল তাহেরের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসুত ইউটোপিয়ান চিন্তা সেই ঘটনার জন্য দায়ী। জিয়াকে নৈরাজ্য বিরোধি সৈনিক ও অফিসাররা উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
সেদিন জেনারেল জিয়া মুক্ত না হলে বা সৈনিকদের মধ্যে না এলে ইতিহাস ভিন্ন হতো। বাকশাল থাকলে রক্ষী বাহিনীর সংখ্যা বাড়ত, বিরোধী মতে আরো হাজার হাজার কর্মী নিহত হতো। জিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বিএনপি বা কোনো জাতীয়তাবাদী শক্তি ভেঙ্গে দশটি কথিত জাতীয়তবাদী দল বানালেও এর অন্তর্নিহিত শক্তি ক্ষয় করা যাবে না। কেউ তা পারেনি। মন্ত্র ঠিক থাকলে হাজারো নির্যাতনেও জাতীয়তাবাদ দমানো যায় না। বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদের এটিই ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট।