আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর ১০টি মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে এগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই ১০ মেগা প্রকল্পের অন্যতম দেশের অহংকারের প্রতীক স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবং বহুল কাক্সিক্ষত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি আটটি প্রকল্প আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে অর্থাৎ দ্বাদশ নির্বাচনের আগেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এ জন্য বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছে আওয়ামী লীগ সরকার।
যদিও একটি পক্ষ এসব মেগা প্রকল্পকে ‘নির্বাচনী উদ্বোধনী’ বলছেন। তারা অভিযোগ করে বলছেন, নির্বাচনে ভোট টানতে সরকার তড়িঘড়ি করে এসব প্রকল্প উদ্বোধন করছে। এখনো সব প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। নেই নিখুঁত প্রস্তুতি। রেলের প্রকল্পগুলোর কোনোটির সেতুর কাজ বাকি, কোনোটির স্টেশন প্রস্তুত হয়নি। সড়কপথের প্রকল্পগুলোরও একই অবস্থা। তার পরও ভোটের আগে তড়িঘড়ি করে এসব প্রকল্প উদ্বোধন করতে চায় সরকার। তবে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু উন্নয়ন করেছে, তাই অবশ্যই এসব প্রকল্পের কথা জনগণের কাছে বলবে। এসব প্রকল্প দেখিয়ে পুনরায় নৌকায় ভোট দেওয়ার আবেদন জানাবে জনগণকে। এটা আওয়ামী লীগের অধিকার। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা এসব প্রকল্পকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দেখছেন।
জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর ও আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে আটটি মেগা প্রকল্প। এগুলো হলো : ১. পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, ২. কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প, ৩. আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প, ৪. খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প, ৫. মেট্রোরেল প্রকল্প, ৬. কর্ণফুলী টানেল, ৭. পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে ও ৮. শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প : ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানোর পাশাপাশি স্টেশন ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে আলাদা প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে) পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। এ প্রকল্পে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। প্রকল্প সূত্রমতে, মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ শতাংশ। চলতি সেপ্টেম্বরেই প্রকল্পের এই অংশের উদ্বোধনের জন্য ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ ভাগ। তবে ভাঙ্গা-যশোর পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৭৯ শতাংশ, এ অংশের উদ্বোধন হবে ২০২৪ সালের জুনে। সূত্রমতে, ৭ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চাওয়া হবে। তিনি ২০ সেপ্টেম্বরের পরে যেদিন সময় দেবেন, সেদিন উদ্বোধন হবে।
কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্প : চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১০২ কিলোমিটার। এ প্রকল্পের ফলে ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধনের পর রেল চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হয়ে গেছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ।
আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প : আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন প্রকল্পের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আখাউড়া-আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। দুই দেশের মধ্যে এ রেলপথ চালু হলে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার কমে হবে মাত্র ৩৫০ কিলোমিটার। ৪৭৭ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ভারত অনুদান দিচ্ছে ৪২০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্প ৮-১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধন করতে পারেন। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আখাউড়া-আগরতলা প্রকল্পের কাজ ৯০ ভাগের বেশি হয়েছে। রেললাইন বসানোর কাজ পুরো শেষ।
খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প : দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হলেও মোংলা বন্দর এত দিন ছিল রেল সংযোগের বাইরে। এ জন্য খুলনা থেকে মোংলায় নেওয়া হয় রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ। নানা জটিলতায় পাঁচবার সময় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির। এবার নির্মাণকাজ শেষের পথে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, শেষ মুহূর্তের ফিনিশিং কিছু কাজ বাকি আছে স্টেশনগুলোর। প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেক সভায় অনুমোদন হওয়ার ১৩ বছর পরে এসে আলোর মুখ দেখছে। এই প্রকল্পটিও প্রধানমন্ত্রীর জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে ভারত সফরের সময় আলাদা সময় বের করে উদ্বোধন করা হতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে।
মেট্রোরেল লাইন-৬ : দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বর্তমানে মেট্রোরেল নিয়মিত চলাচল করছে। আর অক্টোবরেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশটিও। এরই মধ্যে এ অংশে শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলক চলাচল। উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে আর অপেক্ষা করতে হবে না দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। দুর্ভোগ পোহাতে হবে না অসনীয় যানজটের। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে ঢাকাবাসী এ পথ মেট্রোরেলে পাড়ি দেবে মাত্র ৩৮ মিনিটে।
কর্ণফুলী টানেল : কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজ শেষ। এ প্রকল্পের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে অক্টোবরে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। এ প্রকল্প সমাপ্ত হলে দেশের যোগাযোগব্যবস্থার এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের বিবরণ অনুসারে, নির্মাণাধীন টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এ ছাড়া ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের একটি অ্যাপ্রোচ সড়কের পাশাপাশি একটি ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ রয়েছে, যা মূল শহর, বন্দর ও নদীর পশ্চিম দিককে এর পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে : বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে। এ এক্সপ্রেসওয়ে হতে যাচ্ছে আধুনিক ঢাকার নতুন গেটওয়ে। দেশের প্রথম ১৪ লেনের মহাসড়ক, যার ৮টি এক্সপ্রেসওয়ে। নান্দনিক এ সড়ক ধরেই তৈরি হচ্ছে পূর্বাচল স্যাটেলাইট সিটির নকশা। মহাসড়কের দুই পাশে রয়েছে ১০০ ফুট খাল। সাড়ে ১২ কিলোমিটার এ সড়কে থাকবে পাঁচটি অ্যাডগ্রেড ইন্টারসেকশন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে নির্মিত এ সড়কপথে শেষ সময়ে চলছে লাইটপোস্ট আর রোড মার্কিংয়ের কাজ। রাজধানীর বুকে ১২ দশমিক ৩ শূন্য কিলোমিটার দীর্ঘ ১২ লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে নতুন শহর পূর্বাচলের সঙ্গে যুক্ত হবে নগরীর বাকি অংশ। একই সঙ্গে যানজট কমিয়ে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করবে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ, অপেক্ষা কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উদ্বোধনের। চলতি সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করার কথা।
বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল : হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল আগামী ৭ অক্টোবর চালু হতে যাচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ভবনও এখন দৃশ্যমান। চলছে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে বাড়বে উড়োজাহাজ চলাচল ও যাত্রীসেবার মান।
রেলের চার প্রকল্পের উদ্বোধনের সার্বিক বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নয়ন হচ্ছে। ঢাকা থেকে মানুষ সরাসরি কক্সবাজার যাবেÑএটা একটা বিরাট অর্জন। মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। পদ্মা রেল সংযোগের ফলে যশোর পর্যন্ত সংযোগ হয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের ফলে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমে আসছে। এরপর মোংলা পোর্ট যুক্ত হচ্ছে রেলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। এরপর আন্তদেশীয় একটা রুট হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প। রেলের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে এগুলো যুগান্তকারী অর্জন।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 ঠিকানা রিপোর্ট
 ঠিকানা রিপোর্ট  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
