আগুনের কুণ্ডলী ঘুরছে ঢাকার বঙ্গবাজার, মহাখালীর সাততলা বস্তি, কাপ্তানবাজার মুরগি পট্টি, সুইপার কলোনি থেকে ভোলার ওয়েস্টার্ন পাড়ার তুলার গুদাম। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা বা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও। সমসময়ে ঘটে চলা এসব অগ্নিকাণ্ডকে সাদা চোখে স্বাভাবিক বা নেহাত দুর্ঘটনা ভাবা যাচ্ছে না। ভেতরে ভেতরে সরকার অনেকটা স্তব্ধ। কিন্তু শব্দ করছে না। যেখানে কিছুদিন আগেও কোথাও সামান্য শব্দ বা আতশবাজি হলেও একে আগুন-বিস্ফোরণের নাশকতা বলে চালাত সরকার। একের পর এক, এমনকি পবিত্র রমজানেও ঘটে চলা এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে ভয়ানক ষড়যন্ত্র দেখছে সরকারের একটি অংশ।তারা এসবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আমলের ৭৩-৭৪ এর সিন্ড্রোম দেখছে। বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতে জাসদসহ ওই সময়ের প্রতিক্রিয়াশীলদের ছক তখন বোঝা যায়নি। বুঝতেবুঝতে ঘটে যায় পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডি।গত মাস কয়েকে বিভিন্ন জায়গার কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পেছনে সে ধরনের পরিকল্পনার সন্দেহ করা হলেও অকাট্য তথ্য-প্রমাণ মিলছে না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কয়েকটিরও এ-বিষয়ক সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু ক্লু নেই। গত বছরের ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যও সেভাবে উদ্ধার হয়নি। আছে কেবল ওইসব অগ্নিকাণ্ডে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকার ক্ষয়ক্ষতি, ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন ছাড়াও ৮৫ জনের মৃত্যুর তথ্য। কারণ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কথা।
প্রশ্ন উঠেছে, নাশকতা যদি না-ও হয়ে থাকে, তাহলে কি আগুন-বিস্ফোরণের ঘটনা একটির পর আরেকটি চলতেই থাকবে? চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে সীমা অক্সিজেন কারখানায় গ্যাস বিস্ফোরণস্থলেরআধা কিলোমিটার দূরে উৎক্ষিপ্ত লোহার পাতের আঘাতেও মানুষ মারা গেছে। এ ঘটনায় ছয়-সাতজন নিহতের আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ৫০ জন। সীতাকুণ্ডের ঘটনার ঘায়ের মাঝেই রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার এলাকায় সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা গেছে ২০ জন। সিদ্দিকবাজারের আগে একই কাণ্ড ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে। বিগত কয়েক বছরে এ ধরনের ছোট-বড় বিস্ফোরণের খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। প্রায় সব বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়েছে ‘গ্যাস লিকেজ’ বা ‘জমে থাকা গ্যাস’কে। কোনো ঘটনাই তদন্তের বাইরে থাকছে না। কয়েকটির দুর্ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। যে কটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বিস্ফোরণের জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে।
এর আগে ২০২১ সালের জুনে রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণের জন্যও দায়ী করা হয়েছিল তিনতলা ভবনের নিচ তলায় জমে থাকা গ্যাসকে। অথচ ওই ঘটনায় ভবনের নিচ তলায় কোনো গ্যাস সংযোগ পাওয়া যায়নি, গ্যাস সিলিন্ডারও অক্ষত ছিল। সে সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, তারা সেখানে মিথেন গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন, যা পয়োনিষ্কাশন লাইন থেকে লিক হতে পারে। এর আগের বছর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনার পোস্টমর্টেমও ছিল এমনই। তদন্ত সংস্থা সিআইডি বিস্ফোরণের কারণ উদ্্ঘাটন করে জানিয়েছিল, মসজিদের ভেতরে গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন একধরনের রুটিন ওয়ার্ক। এ কমিটিকে রিপোর্ট দিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দীর্ঘ সময় চলে যায়। নানা ঘটনার তোড়ে মানুষও ঘটনা ভুলে যায়। বারবার অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলোকে শুধু দুর্ঘটনা মানতে কষ্ট হলেও মানতে বাধ্য হওয়া লাগছে। ঢাকার বঙ্গবাজার, সায়েন্স ল্যাব, সিদ্দিকবাজারসহ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মাঝে বিশেষ কিছুর ইঙ্গিত থাকলেও বলতে চাচ্ছে না সরকার। কিন্তু সরকারের একটি অংশ এসবের গোড়ায় হাত দেওয়ার দাবি তুলে সরকারের ভেতর তোলপাড় ঘটাচ্ছে। সামনে বড় রকমের অঘটনের ছায়া দেখছে তারা। তাদের শান্ত-নিবৃত রাখাও এখন আরেক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে দল ও সরকারের শীর্ষ মহলের।
তাদের যুক্তি হচ্ছে, এসবের বিহিত করতে না পারলে সামনে আরো কোনো ধরনের অঘটনের শঙ্কা তাদের।তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আনছেন আগস্ট ট্র্যাজেডির আগের নমুনার কথা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও কিছু অস্ত্র বাইরে থেকে যায়। ওইসব অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই, বাড়িঘর দখলের মতো নৈরাজ্য চলেছে। থানা পর্যন্ত লুট হয়েছে। ব্যাংক লুটও হয়েছে। পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়েছে সমানে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীও নামিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এতে একে একে দলীয় লোকজনই বেশি ধরা পড়তে থাকে, যা দলের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি করে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় একপর্যায়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠিত হয় বাকশাল। তাও হিতে বিপরীত ডেকে আনে।