Thikana News
২৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের শেষ পরিণতির গল্প

ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের শেষ পরিণতির গল্প



 
ইন্টারনেট সহজলভ্যতার যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের বিচরণ বাড়ছে। জোয়ান কি বুড়ো-সব বয়সী মানুষেরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। স্মার্টফোন আছেÑবিশেষ করে, এ জাতীয় মানুষের ফেসবুকে কমপক্ষে একটি হলেও অ্যাকাউন্ট আছে। সারা দিনের ব্যস্ততার ফাঁকে হোক, ঘুমোতে যাওয়ার আগে হোক কিংবা কারও সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় হোক, ফেসবুকে সময় দিতেই হচ্ছে। একদিন ফেসবুক ব্রাউজিং না করলে তো তরুণ ইউজারদের চোখের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। না জানি দেশ-বিদেশে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা চোখের আড়াল হয়ে গেল। কেননা, মূলধারার সংবাদমাধ্যমের চেয়ে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া নানা ঘটনার দিকে মানুষের নজর বেশি। সবারই চোখ এখনÑকোন ঘটনা আজ ভাইরাল হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরুতে শুধু ব্যবহারকারী লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে এসব প্ল্যাটফর্মে নানা ধরনের কনটেন্ট আপলোড করে রেমিট্যান্স আয়ের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই তো মানুষ এখন শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সীমাবদ্ধ না থেকে কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে টাকা আয় করা যায়, সে সন্ধানে নেমে পড়েছে। যে যেভাবে পারছে বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটকসহ যেসব প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করা সম্ভব, সেসব প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট আপলোড করছে। এই যে যারা কনটেন্ট আপলোড করছে, তাদেরকেই মূলত কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো। যারা নিয়মিত কনটেন্ট তৈরি করছে, সকল নিয়মকানুন মেনে কনটেন্ট আপলোড করছে এবং ধৈর্যসহকারে লেগে থাকছে, তারাই মূলত সফলতার মুখ দেখছে। মাস শেষে লাখ লাখ টাকা আয় করে ভাগ্য বদল করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা, কিংবা সেই মাধ্যমে নিজেকে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে উপস্থাপন করে লাখ লাখ টাকা আয় করে ভাগ্য বদল করা-এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটিয়েছে ভাইরাল হওয়ার নেশা। যার কনটেন্ট বা ভিডিও যত বেশি ভাইরাল হবে, সে তত বেশি সবার মাঝে পরিচিত হয়ে উঠবে; যত বেশি পরিচিত হয়ে উঠবে, তত বেশি তার কনটেন্ট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে, বেশি বেশি রিঅ্যাক্ট, শেয়ার ও কমেন্ট আসবে, তত বেশি অ্যানগেজ বাড়বে, আর তত বেশি আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু কোন জাতীয় কনটেন্টের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটা সম্ভব, তা বুঝেই কনটেন্ট নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করে বর্তমান কনটেন্ট ক্রিয়েটররা।

বর্তমানে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মূল নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কনটেন্ট ভাইরাল করতেই হবে। ভাইরাল না হলে তাকে যেমন কেউ চিনবে না, তেমনি আয়ের পরিমাণও সীমিত হবে। সেই ভাইরাল হওয়ার নেশায় পড়ে অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর যা-তা নির্মাণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ছে, পাবলিক সেসব দেদার গ্রহণ করছে। পাবলিকের কোনো দোষ নেই এখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্রল করতে গিয়ে পাবলিকের নজরে যেটা আসছে, সেটিই উপভোগ করছে। দিন শেষে যাদের ভিডিও ইউজাররা বেশি বেশি দেখছে, তাদের কাছে জনপ্রিয় ও পরিচিত হয়ে উঠছে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা। শুধু তা-ই নয়, ইদানীং কিছু কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের আইডল। পছন্দের কনটেন্ট ক্রিয়েটর কীভাবে জীবনযাপন করছে, কী খাচ্ছে, কী পরছে, কোথায় যাচ্ছে, সবই যখন কনটেন্ট আকারে প্রচার করছে, তখন সাধারণ মানুষজন সেসবের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তাদের ফ্যান-ফলোয়ার্সের সাপোর্ট দ্বারা রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এসব কথিত সেলিব্রেটি কিংবা ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অনলাইন জীবনের আড়ালে লুক্কায়িত থাকছে ভয়ংকর এক জগৎ। কেউ কেউ নিজে থেকেই সেই ভয়ংকর জগৎ তুলে ধরে কনটেন্ট হিসেবে, কারওটা আবার সংবাদমাধ্যম তুলে ধরে, কারওটা আবার নানা অপ্রীতিকর ঘটনা বা দুর্ঘটনায় লোকচক্ষুর অন্তরাল ভেদ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ এসব ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডাল সামাল দিতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুষড়ে পড়ে। ফ্যান-ফলোয়ার্সের নেতিবাচক মন্তব্যের কবলে পড়ে খোয়াতে হয় অর্জিত জনপ্রিয়তা, বন্ধও হয়ে যায় আয়ের কাক্সিক্ষত পথ। অর্থাৎ যারা কিনা এই প্ল্যাটফর্মে সংযত হতে পারে না, নিজের অর্জিত জনপ্রিয়তাকে সামাল দিতে পারে না, সংবরণ করতে পারে না নিজের লোভকে কিংবা ভাইরাল হওয়ার মোহে অন্ধ হয়ে পড়ে, তারাই একটা সময় ছিটকে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। যে সাধারণ ইউজাররা এত দিন কনটেন্ট দেখে দেখে ভাইরাল করে রেখেছিল, তারাই অতিষ্ঠ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক পরিচিত রিমন মিয়া নামের এক কনটেন্ট ক্রিয়েটরের ব্যক্তিগত নেতিবাচকতার গল্প উঠে এসেছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে। যেখানে দেখা যায়, ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর নেত্রকোনার রিপন মিয়া প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করলেও নিজের বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিচ্ছে না, নিজে ইটের দালান-বাড়ি বানিয়ে বসবাস করলেও সেখানে আশ্রয় দিচ্ছে না বাবা-মাকে; এমনকি নিজে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ইন্টারভিউতে নিজেকে অবিবাহিত দাবি করছে, নিজের স্ত্রীকে বড় ভাইয়ের বউ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে এবং নিজেকে বেশ অহংকারী হিসেবে উপস্থাপন করছে। যে রিপন মিয়া অসচ্ছল জীবন থেকে কনটেন্ট ক্রিয়েশন করে ভাইরাল হয়ে লাখ লাখ মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই রিপন মিয়ার বাস্তব চিত্র যখন জনসম্মুখে উঠে এসেছে, তখনই মানুষ ঘৃণার বিষ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে।

সাধারণ ইউজারদের ধারণা, তারা যাদের ভিডিও কনটেন্ট দেখে ভক্ত হয়েছে, তারা হবে আইডল, ঠিক যেমন চলচ্চিত্র জগতের অভিনয়শিল্পীরা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কনটেন্ট আর ব্যক্তিগত জীবন তো ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিকতা বজায় থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আড়ালে থাকে। কিন্তু জোয়ার-ভাটার এই জীবনে কে কখন কীভাবে তরী নিয়ে জলে ডুবে যায়, আর কে কখন ভাঙা তৈরি নিয়েও তীরে ফিরতে পারে, তা বলা মুশকিল। তাই যখন কোনো কনটেন্ট ক্রিয়েটরের স্ক্যান্ডাল জনসম্মুখে প্রকাশ পায়, তখন ঠিক যেভাবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, ঠিক তেমনি রাতারাতি পতন ঘটে যায়। মানুষ তার ভুল-সঠিক বাছবিচার না করে গালি নিক্ষেপ করে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। আর এভাবেই ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের পতন ঘটে এবং এই মাধ্যম থেকে একবার যার পতন ঘটে, তার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ খুবই কম হয়।

আলোচিত রিপন মিয়া একটা সময় দরিদ্র ছিলেন। কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও প্রচার করতেন। ধীরে ধীরে তার সহজ-সরল অভিব্যক্তি ও দরিদ্রগোছের চলাফেরার কনটেন্ট মানুষের ভালো লাগতে শুরু করে। মানুষ তাকে ভাইরাল করে। মনিটাইজেশন পেয়ে তিনিও যেন আকাশের চাঁদটা হাতে পেয়ে যান। তার এই জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করে। রিপন মিয়াও তাতে সাড়া দিয়ে দেশের প্রথম সারির সেলিব্রেটিদের কাতারে উঠে আসেন। কিন্তু কে জানত তার এই সরলতার আড়ালে রয়েছে এক অমানবিক গল্পের প্লট। যদিও সন্তান হিসেবে রিপন মিয়া বাবা-মাকে ভরণপোষণ দেবেন কি না; তার স্ত্রী আছে কি নেই, তা জানানো বা না জানানো, একান্তই তার ব্যাপার ছিল। কিন্তু বিষয়টি যখন সংবাদমাধ্যমে এসে নেতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা হয়ে উঠেছে রিপন মিয়াকে প্রত্যাখ্যান করার শক্তিশালী হাতিয়ার।
একসময়ের ভাইরাল রিপন মিয়া তার ব্যক্তিগত জীবনের অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে খ্যাতির কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছেন, তা বলা যেতেই পারে। হয়তো এই রিপন মিয়া আর আগের মতো মানুষের সহানুভূতি-সহযোগিতা পাবেন না। ধীরে ধীরে ভাইরাল রিপন মিয়া হারিয়ে যাবেন অতল গর্ভে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তার প্রতি হয়তো সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে। রিপন মিয়াকে ফিরে যেতে হবে সেই ফেলে আসা স্বাভাবিক জীবনে। রিপন মিয়ার মতো এমন অসংখ্য ভাইরাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর খুব দ্রুতই হারিয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। এর মূলে থাকে নিজে যা না তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা। অর্থাৎ মিথ্যা গল্পে নাটক করে যখন আসল গল্প জনসম্মুখে চলে আসে, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে-যারাই ভাইরাল, তারাই ভাইরাস। আর ভাইরাস মাত্রই এড়িয়ে চলা বুদ্ধিমানের কাজ।

কনটেন্ট ক্রিয়েটর জগতে যারা ভাইরাল হচ্ছে এবং দিন শেষে তাদের পরিণতি খুবই বাজে হচ্ছে, তাদের থেকে নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কে কীভাবে রাতারাতি ভাইরাল হয়ে কথিত সেলিব্রেটি হয়ে যাচ্ছে, তা যেন ধুলো-অন্ধকার। নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত না হতেই নিজেকে যখন উঁচু স্থানে মানুষ আবিষ্কার করে ফেলে, সেই মাটির ওপর তখন আর কত দিন দাঁড়িয়ে রাজত্ব করা যায়। মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমন একটা প্ল্যাটফর্ম-এখানে যারা মাথায় তোলে, তারাই আবার টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দেয়। তাই কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের তার নিজস্ব কনটেন্টের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে। রাতারাতি ভাইরাল হওয়ার পরে সেই ভাইরালের ভার সহ্য করতে হবে। সর্বোপরি নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। কেননা, আইডল যদি ভুল করে বসে, সেই ভুল শুধরানোর সুযোগ ফ্যান-ফলোয়ার্স কখনো দিতে চাইবে না। তাই কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে পথচলার পরিণতিটা যেন ভয়ানক না হয়, সেদিকে নজর রেখে পা ফেলার জন্য পরামর্শ থাকবে। ভাইরাল হওয়া নয়, ভারসাম্য বজায় রাখাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে টিকে থাকার একমাত্র মূলমন্ত্র।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট, ঢাকা।
 

কমেন্ট বক্স