দুর্গাসাগর দিঘি বরিশাল মহানগরী থেকে বারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। গত জানুয়ারি মাসে ঘুরে এলাম প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিবাহী এই পর্যটন স্পট। আজকের লেখায় ঘুরে আসা দুর্গাসাগর দিঘি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। চারদিকে সবুজে ঘেরা বন, ভেতরে স্বচ্ছ জলরাশির বিশাল দিঘি ও মধ্যখানে দ্বীপ-এটাই হচ্ছে দুর্গাসাগর দিঘির সংক্ষিপ্ত রূপ। দিঘির পশ্চিম-উত্তর দিকে রয়েছে শান-বাঁধানো ঘাট ও প্রবেশদ্বারে অসংখ্য ছোট ছোট বটগাছ। ছোট গাছগুলোকে দেখতে হুবহু ছাতার মতো মনে হয়। পর্যটকদের আনন্দ দিতে পাশে নির্মিত মিনি পার্কে আনা হয়েছে একঝাঁক চিত্রা হরিণ, বিশাল আকৃতির উট পাখি, ময়ূর, খরগোশ ও বুনো বানর। তাই দুর্গাসাগর দিঘির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সারা বছর লেগে থাকে এখানে দর্শনার্থীর ভিড়।
কথিত আছে, রানি দুর্গাবতী ছিলেন রাজা শিব নারায়ণের স্ত্রী। রাজার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং তার সুশাসনে পুরো রাজ্যে তিনি একজন প্রজাহিতৈষী রানি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। প্রজাদের সুপেয় পানি সমস্যার সমাধানকল্পে ১৮৭০ সালে রাজকোষ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল এক দিঘি খনন করেন তিনি। তার নামানুসারে তখন দিঘির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর দিঘি। রানি দুর্গাবতী তখন যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন, ততটুকু জমি নিয়েই খনন করা হয়েছিল এই দিঘি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দিঘিটি প্রায় ৪৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রথম দিঘি পুনঃসংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দিঘির পশ্চিম পারে জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো রয়েছে। পর্যটকেরা চাইলে এখানে রাতযাপন করতে পারেন। দিঘিটি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। নামমাত্র নির্ধারিত প্রবেশমূল্যে দিঘিতে প্রবেশ করা যায়। দিঘির তিন দিকে শান-বাঁধানো ঘাট ও মধ্যখানে ৬০ শতাংশ ভূমির ওপর রয়েছে দ্বীপ। এই দ্বীপই হচ্ছে দিঘির আকর্ষণ। ২৫০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত দিঘিকে এমনভাবে খনন করা হয়েছে যে দ্বীপের ওপর বাতাস এলে এর ধাক্কা লাগে পুরো দিঘিতে। এখানে নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যে মাছ শিকার করা যায়। স্থানীয়ভাবে এই দিঘি মাধবপাশা দিঘি নামে পরিচিত। শীত ও বসন্তকালে দিঘিকে ঘিরে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি পরিলক্ষিত হয় বলে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে। দিঘির শান-বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে পর্যটকেরা যেমন বিনোদনের নতুন মাত্রা খুঁজে পান, তেমনি এখানের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দিঘির চারপাশে সুপারি, নারকেল, মেহগনি ও শিশুগাছ রোপণ করে সবুজ বেষ্টনীর মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। শীতকালে অতিথি পাখিদের সমাগমে মুখরিত থাকে দিঘি। সরাইল, বালি হাঁসসহ নানা প্রজাতির পাখি দিঘির স্বচ্ছ পানিতে আশ্রয় নিলে পুরো এলাকা হয়ে ওঠে ছবির মতো সুন্দর। তাই নানা প্রজাতির পাখি দেখতে এ সময় পর্যটকেরা ছুটে আসেন এখানে।
দুর্গাসাগর দিঘির চারপাশের গাছগাছালি ও পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। দর্শনার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে জানতে পারি, গাছে গাছে কৃত্রিম পাখির বাসা স্থাপন করায় পানকৌড়ি ও ডাহুকের মতো দুর্লভ পাখি দেখা যায় এখানে এলে। পাশে নির্মিত বিশ্রামাগার, রেস্টুরেন্ট পুরো দিঘিকে একটি পিকনিক স্পটে রূপান্তরিত করেছে। তাতে দিঘির জৌলুশ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। অভয়ারণ্য সৃষ্টিতে দিঘির চারপাশে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে বনেজি ও ঔষধি বৃক্ষের বাগান। দিঘিতে প্রতিবছরের চৈত্র মাসে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র স্নান উৎসব পালন করে থাকে। দিঘি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের পৈতৃক নিবাস। ফলে পর্যটকেরা এখানে এলে শেরেবাংলার বাড়ি ঘুরে যেতে পারেন।
বরিশাল ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ একটি জনপদ। খাল-বিল, নদী-নালা ও দ্বীপ এই অঞ্চলক করেছে সমৃদ্ধ। মাধব পাশাসহ বরিশাল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন এখনো দেখা যায়। রয়েছে বহু রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। মাধব পাশায় অবস্থিত দুর্গাসাগর দিঘি সেই প্রাচীন সভ্যতার এক অমর কীর্তি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই দিঘিটি এখন নতুন রূপ পেয়েছে দেখে ভালো লাগল। সময়-সুযোগ হলে এই স্থানটি ঘুরে এসে ইতিহাসের অংশ হতে পারেন।
লেখক : কলামিস্ট ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, নিউইয়র্ক।

আহবাব চৌধুরী খোকন


