নিজস্ব প্রতিনিধি : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত নাটকীয় কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাজনৈতিক মহলসহ দেশবাসীকে বিস্মিত করে নির্বাচন এগিয়ে এনে তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, নির্বাচিত সংসদেরমেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে     দল থেকে অভ্যন্তরীণভাবেই মহাসংকটে রয়েছে বিএনপি।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বিএনপি। সুস্পষ্ট এই প্রতিশ্রুতি তাদেরকে আগেই শৃঙ্খলিত করে ফেলেছে। এখন নির্বাচন কমিশন সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপিকে চিঠি দিয়ে দলটিকে আরেক জালে ফেলেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপিকে তার সমমনা অন্যান্য দলকেও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে শরিক হওয়ারও অনুরোধ করেছেন।
উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশন বিএনপি ও তার সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার নতুন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে মর্মে কিছুদিন আগেই সাপ্তাহিক ঠিকানায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির মহাসচিব বরাবর সংলাপের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো এবং সমমনা সহযোগীদের নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়ার আহ্বান ও তার ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার পেছনেও গূঢ় রাজনীতি রয়েছে, যা মূলত সরকারি স্বার্থই রক্ষা করছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো তাগিদ বোধ করছে না সরকার। আবার বিএনপির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার কথা অসংখ্যবার বলেছেন। তবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের অ্যাজেন্ডা জানতে চান বিএনপির নেতারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে কি না নিশ্চিত না হয়ে তারা নীরবে কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসতে আগ্রহী নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার-বহির্ভূত হলেও তারা সামগ্রিক রাজনৈতিক বিষয় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন, নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বসতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয় এতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তা আসতে বাধা নেই। জানা যায়, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপরই বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ব্যাপারে বিএনপি ও তার সমমনাদের মতামত ও সুপরিশ বিবেচনায় নেবে নির্বাচন কমিশন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এর আগে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে বৈঠকের পর এখন হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন বিএনপির সঙ্গে সংলাপের তাগিদ বোধ করছে কেন। এর পেছনের রহস্যই-বা কী। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বিএনপি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এসব দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিকেরা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন। বিএনপির দাবির যৌক্তিকতাও তারা বিবেচনায় নিয়েছেন। তবে আইনগত, সাংবিধানিক ও কূটনৈতিক সমস্যা, সীমাবদ্ধতাও রয়েছে তাদের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি আইনগতভাবে মীমাংসিত বলে তারা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। একান্ত আলোচনায় বিএনপির বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। গত ২১ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চান। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্য কোনো প্রস্তাব থাকলে উপস্থাপনের জন্য বলেন। রাষ্ট্রদূত এটাও বলেন, তিনি বিএনপি বা কোনো দলের পক্ষে কথা বলতে আসেননি। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেন তারা। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে বিরোধীদের প্রস্তাব, সুপারিশ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্য বলেন। নির্বাচন কমিশন তারপরই বিএনপিকে চিঠি পাঠায় আলোচনার জন্য। গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নহীন করার জন্যই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিএনপি ও তার সহযোগীদের আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বিএনপি সিইসির সঙ্গে আলোচনায় বসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তবে তাদের অনানুষ্ঠানিক সংলাপে বসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এ দাবিই মুখ্য করে আনবে। আবার এ দফায়ও সংলাপে আদৌ অংশ না-ও নিতে পারে। এটি নির্ভর করবে লন্ডন থেকে বার্তা আসার ওপর। গত নির্বাচনে মধ্যস্থতা ও বিএনপির পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন। এবার খোদ মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিছুটা ভিন্ন পথে সে কাজটিই করছেন। তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে পরিষ্কার করেই বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কোনো দলের প্রতি দুর্বলতা নেই। নির্বাচনে কোন দল জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এল, তা-ও তাদের বিবেচ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য প্রশ্নহীন, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন মার্কিন কূটনীতিকেরা। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে মধুময় সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তাতে ফাটল ধরানো সম্ভব না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অধিকতর উন্নত করতে আগ্রহী তারা। বাংলাদেশকে চীনের ওয়ান বেল্ট মহাপরিকল্পনা থেকে সরিয়ে আনা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রকল্পে বাংলাদেশের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চলমান টানাপড়েন কমিয়ে আনারও চেষ্টা করছে তারা।
প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা অভ্যন্তরীণভাবে তাদের কতটা দুর্বল করেছে, তা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাও। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী হিংসাত্মক, নৈরাজ্যকর রাজনীতি দৃশ্যত পরিহার করে বিএনপি নীরব, অহিংস কর্মসূচি পালন করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর কার্যকর চাপ, প্রভাব সৃষ্টিকারী অবস্থান না নেওয়ায় বিপাকে পড়েছে বিএনপি। তাদের হয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে অথবা নির্বাচন বর্জন করে নিজেদের নিঃশেষ প্রক্রিয়া নীরবে এগিয়ে নিতে হবে। নির্বাচন প্রতিহত করার মতো শক্তি বিএনপি এখনো অর্জন করতে পারেনি। শীর্ষ নেতৃত্বসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন বর্জন নাকি অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রবলভাবেই ক্রিয়াশীল রয়েছে। দল ভাঙার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তা সম্ভব না হলেও নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য অংশের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে জোর তৎপরতা চলছে। এমনই অবস্থা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জন্য বড় রকমের সংকটেরই বার্তা দিচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে সংকট ঘনীভূত হবে এবং প্রকাশ্য রূপ নেবে।
শেষপর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও অধিকাংশ দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করছে সরকার। এ ব্যাপারে সরকার ও নির্বাচন কমিশন গভীর সমঝোতায় অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এমন কোনো আভাসও ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ পশ্চিমা কূটনীতিকেরা দেননি। তারা যদি কঠোর কোনো সিদ্ধান্তও নেয় চীন, ভারত, জাপান বাংলাদেশের পাশে জোরালোভাবে প্রকাশ্য অবস্থান নেবে।
জানা যায়, বিএনপির নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মেয়াদপূর্তির বেশ আগেই সংসদ নির্বাচন করিয়ে নেওয়ার কথাও বিবেচনায় রেখেছেন। আগামী দিনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি সরকারের জন্য অপেক্ষাকৃত স্বস্তিদায়ক হলেও তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির জন্য বিপর্যয়াত্মক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                
