Thikana News
৩১ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫


ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিচ্ছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি দ্বীপের রানী ভোলা

ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিচ্ছে সৌন্দর্যের লীলাভূমি দ্বীপের রানী ভোলা



 
পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দ্বীপের রানি ভোলা জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য এখনো বাংলাদেশের অনেক মানুষেরই অজানা। কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ বা দ্বীপের রানি খ্যাত বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ভোলা জেলা। বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা তার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিস্তৃত নদী ও চর এবং সবুজ প্রকৃতির মিশেলে এক অপরূপ লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত।

মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নদী দ্বারা বেষ্টিত এই জেলায় প্রকৃতির এক অনন্য রূপ দেখা যায়, যা ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভোলা শহর ঢাকা থেকে নদীপথে দূরত্ব ১৯৫ কি.মি.। সড়কপথে বরিশাল হয়ে দূরত্ব ২৪৭ কি.মি. এবং লক্ষ্মীপুর হয়ে দূরত্ব ২৪০ কি.মি.। ভোলার সঙ্গে অন্য কোনো জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। অন্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখার জন্য ভোলাবাসীকে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরির ওপর নির্ভর করতে হয়।
ভোলা বরিশাল বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। গাঙ্গেয় অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা। এর আয়তন ৩,৪০৩.৪৮ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-পশ্চিমে বরিশাল, উত্তর-পূর্বে লক্ষ্মীপুর, পূর্বে নোয়াখালী জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে পটুয়াখালী জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী। এই জেলাটি চরফ্যাশন, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, মনপুরা ও লালমোহন-এই সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত।

ভোলা জেলার পূর্ব নাম দক্ষিণ শাহবাজপুর। জেসি জ্যাক তার ‘বাকেরগঞ্জ গেজেটিয়ার’-এ বলেছেন, দ্বীপটি ১২৩৫ সালে তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল এবং এই এলাকায় চাষাবাদ শুরু হয়েছিল ১৩০০ সালে। ১৫০০ সালে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা এই দ্বীপে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। শাহবাজপুরের দক্ষিণাঞ্চলেও আরাকান ও মগ জলদস্যুরা তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে।
শাহবাজপুর ১৮২২ সাল পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ জেলার (বর্তমান বরিশাল) একটি অংশ ছিল। উনিশ শতকের শুরুতে, মেঘনা নদীর সম্প্রসারণের কারণে জেলা সদর থেকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের সঙ্গে সংযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এরপর ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ শাহবাজপুর ও হাতিয়াকে বাকেরগঞ্জ থেকে আলাদা করে নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভোলা ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬৯ সালে একে একটি মহকুমা হিসেবে পুনরায় বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৭৬ সালে প্রশাসনিক সদর দফতর দৌলতখান থেকে ভোলায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৪ সালে এটি একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। (উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া)

ভোলা নামকরণের ইতিহাস : ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মতো অপ্রশস্ত ছিল না। একসময় এটা পরিচিত ছিল বেতুয়া নদী নামে। খেয়া নৌকার সাহায্যে নদীতে পারাপার চলত। থুত্থুড়ে বুড়ো এক মাঝি খেয়া নৌকার সাহায্যে লোকজনকে পারাপারের কাজ করত। তার নাম ছিল ভোলা গাজি পাটনি মতান্তরে ভোলানাথ বাবু। আজকের ভোলা শহরের যুগীরঘোলের কাছেই তার আস্তানা ছিল। এই ভোলা গাজির নামানুসারেই সে সময় ভোলা জেলার নামকরণ হয়।
ধান, সুপারি, ইলিশের জেলা হিসেবে ভোলার খ্যাতি দেশজুড়ে। উজান থেকে নেমে আসা তিনটি প্রধান নদীÑপদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রবাহিত পলি দিয়ে মোহনার বুকে জেগে উঠেছে দ্বীপ জেলা ভোলা। এ জেলার সৃষ্টির ইতিহাস যেমন আকর্ষণীয়, ঠিক তেমনি এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও রয়েছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। বিশেষ করে, এখানকার চরাঞ্চলের অতিথি পাখির উড়ে বেড়ানো, হরিণের পালের ছোটাছুটি, নদীর বুকে সারি সারি জেলে নৌকা, দল বেঁধে বুনো মহিষের বিচরণ, একরের পর একর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, আকাশছোঁয়া কেওড়া বাগান আর সাগর মোহনার সৈকতÑসবকিছুই যেকোনো মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। চলুন এবার ভোলার দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে আলোচনা করি।

জ্যাকব টাওয়ার : ২২৫ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে আকর্ষণীয় ও উঁচু টাওয়ার। সম্পূর্ণ স্টিল কাঠামোতে তৈরি এই টাওয়ার ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। টাওয়ারের চারদিকে ব্যবহার করা হয়েছে স্বচ্ছ গ্লাস। বাইনোকুলারের সাহায্যে ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত টাওয়ারের চতুর্দিকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন ভ্রমণপিপাসুরা।
জ্যাকব টাওয়ার ভোলা জেলার চরফ্যাশনে অবস্থিত। এটি উপমহাদেশের সর্বোচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। আইফেল টাওয়ারের আদলে নির্মিত ১৬ তলাবিশিষ্ট এই ওয়াচ টাওয়ারের প্রতিটি তলায় ৫০ জন ও পুরো টাওয়ারে ৫০০ জন দর্শক অবস্থান করতে পারেন। দৃষ্টিনন্দন এই টাওয়ারে সিঁড়ি দিয়ে চূড়ায় ওঠার পাশাপাশি ১৬ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্বচ্ছ গ্লাসের ক্যাপসুল লিফট।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর : ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী এক সাহসী বীর যোদ্ধার নাম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। পিতার চাকরির সুবাদে সেনানিবাসে কেটেছে দুঃসাহসী মোস্তফা কামালের শৈশব জীবনের বেশির ভাগ সময়। ২০ বছর বয়সে সেনাসদস্য হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা মোস্তফা কামাল পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের সময় তাকে মৌখিকভাবে ল্যান্স নায়েকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখযুদ্ধে এই বীর সন্তান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৮ সালে ভোলা জেলা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে আলীনগর ইউনিয়নের মোস্তফা নগরে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর মৌটুপীর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে কামাল নগর রাখা হয়েছে। জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন, বীরশ্রেষ্ঠর ব্যবহৃত সামগ্রী, ছবি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ধারক বিভিন্ন গ্রন্থ স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া লাইব্রেরিতে আরও আছে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবনী, উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ, বিজ্ঞানবিষয়ক রচনাবলি, সাধারণ জ্ঞান, শিশুসাহিত্য, কবিতাসমগ্রসহ নানান ধরনের বৈচিত্র্যময় বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ।

স্বাধীনতা জাদুঘর : তরুণ প্রজন্মকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করার উদ্দেশ্যে ভোলার বাংলাবাজার এলাকায় তোফায়েল আহমেদ ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোগে স্বাধীনতা জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। স্বনামধন্য স্থপতি ফেরদৌস আহমেদ প্রায় এক একর জায়গার ওপর নির্মিত ভোলার আকর্ষণীয় এই বিনোদনকেন্দ্রটি ডিজাইন করেন। স্বাধীনতা জাদুঘরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া এখানে তথ্যভিত্তিক ভিডিও এবং দুর্লভ ছবির সংগ্রহ দেখে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের সুযোগ রয়েছে।

স্বাধীনতা জাদুঘরের প্রথম তলায় রয়েছে বঙ্গভঙ্গ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশ ভাগ ও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিক ইতিহাস। দ্বিতীয় তলায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। আর তৃতীয় তলায় আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস।

ফাতেমা খানম মসজিদ : স্বাধীনতা জাদুঘরের একদম পাশেই অবস্থিত ভোলায় দৃষ্টিনন্দন আরেক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে ফাতেমা খানম মসজিদ। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে এক একর জমির ওপর নির্মিত মসজিদটি খুবই দৃষ্টিনন্দন। আধুনিক স্থাপত্যরীতি ও ইসলামি সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ এ মসজিদ। বিভিন্ন ধরনের পাথর ও টাইলস দিয়ে সুসজ্জিত। মসজিদের ভেতর দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি লাগানো। মসজিদে প্রধান একটি বড় গম্বুজসহ চারপাশে চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। এখানে একসঙ্গে আড়াই হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের মূল গেট থেকে মসজিদ পর্যন্ত সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত।

চরফ্যাশন খামার বাড়ি : ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘খামার বাড়ি’। প্রতিদিন হাজারো মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এখানে ঘুরতে আসেন। বাহারি প্রজাতির গাছ আর ফুলের সমারোহ এলাকাজুড়ে। মনোমুগ্ধকর এ জায়গাটি দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নিয়েছে। চরফ্যাশন উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে নজরুল নগর ইউনিয়নের ‘শারেকখালী’ গ্রামে এ দর্শনীয় স্থানটি অবস্থিত। খামার বাড়ি বা মেসার্স জেনিক ফিশারিজ নামের এ দর্শনীয় স্থানটি পর্যটকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ৫০ একর এলাকা নিয়ে এ দর্শনীয় স্থানটির অবস্থান। পুরো এরিয়ার যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা। চারদিকে শুধু নজরকড়া মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, যা দেখতে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। ভোলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে এর সুনাম এখন জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
খামার বাড়িতে ঘোড়া, হরিণ, বাঘ, সিংহ, কুমির, হাঁস, জিরাফসহ অসংখ্য বৈচিত্র্যময় প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের আদলে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আছে দুটি মিনি হেলিপ্যাড। পাহাড়ের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ আধুনিক কিল্লা, যেখানে ছাতার নিচে বসে সময় কাটায় ভ্রমণপিপাসুরা।

চর কুকরী-মুকরী : প্রায় এক হাজার বছর পুরোনো এ চরে আজও সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। বঙ্গোপসাগরের কোলে মেঘনা-তেঁতুলিয়ার মোহনায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বিশাল বনাঞ্চল-বেষ্টিত এ দ্বীপে বিচরণ করছে অসংখ্য হরিণ, গরু, মহিষ, বানর এবং নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী। চর কুকরীতে যাওয়ার পথে বিস্তৃত বনায়নে মাঝেমধ্যে চিতাবাঘেরও উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলার মূল ভূখণ্ড থেকে দক্ষিণে মেঘনা নদী পার হয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চর কুকরী-মুকরীর অবস্থান। দ্বীপের পূর্ব দিকে প্রমত্তা মেঘনা, উত্তরে বুড়া গৌরাঙ্গ এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। চর কুকরী-মুকরীকে মিনি সুন্দরবনও বলা হয়ে থাকে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, বন্য প্রাণী আর সমুদ্রসৈকতকে ঘিরে সৌন্দর্যের এক বর্ণিল উপস্থিতি, যা প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।

ঢাল চর : লবণাক্ত বনাঞ্চল, কাছাকাছি স্থানের মাটির চারিত্রিক পার্থক্য, মরা গাছের শুকনো গুঁড়িগুলো যেন ফসিলের (মৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের অংশবিশেষ পাথরে পরিণত হওয়া এমন ধরনের বস্তুকে বোঝায়) মতো মনে হয় আর ভেজা গুঁড়িগুলোকে মনে হয় প্রবাল পাথর। যারা ছবি তুলতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য তো এক অনন্য স্থান। ক্যাম্প করে থাকার জন্য অনেক সুন্দর একটা জায়গা এই ‘ঢাল চর’।
প্রকৃতির রুক্ষতা যেখানে নির্মল সৌন্দর্যের আরেক কারণ, তেমনই এক চরের নাম ‘ঢাল চর’। এই চরের একটি প্রান্তকে তারুয়া সমুদ্রসৈকতও বলা হয়। চরের বিচিত্র প্রাণী, গাছপালা আর মাটির ভিন্নতা দেখলে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। গত কিছু বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই চরকে আরও নির্জন করেছে। এই দ্বীপে আছে হরিণ, বনমোরগ, শিয়াল, লাল কাঁকড়া এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

নিজাম হাসিনা মসজিদ : বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলায় নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ অত্যাধুনিক মসজিদ নিজাম হাসিনা মসজিদ। ভোলা শহরের উকিলপাড়া নামক স্থানে প্রায় দেড় একর জমির ওপর দ্বিতল এই মসজিদটি স্থাপন করেছে নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন। দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ-সংবলিত অপূর্ব এই নিজাম হাসিনা মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন রঙের মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। নিজাম হাসিনা মসজিদে রয়েছে পুরুষ ও নারীদের জন্য পৃথক অজুখানা এবং নামাজ আদায়ের স্থান। এই মসজিদে প্রায় দুই হাজার মুসল্লির একত্রে নামাজ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। নিজাম হাসিনা মসজিদে ৬০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি গম্বুজ রয়েছে। আর মসজিদে স্থাপিত মিনারের উচ্চতা ১২০ ফুট। ক্যালিগ্রাফি, আকর্ষণীয় ফোয়ারা এবং সাজানো ফুলের বাগান মসজিদের সৌন্দর্যকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

মহিষের দই : দ্বীপ জেলা ভোলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত মহিষের দুধের কাঁচা দধি। এটা ভোলার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে। এখানকার অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদান এটি। এই টক দধি গুড়, মিষ্টি অথবা চিনি দিয়ে খাওয়া যায়। এই দধি সব সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে থাকতেই হবে। এ ছাড়া খাবার হজমে কাঁচা দুধের দধি বাড়তি সহায়তা করায় এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। স্থানীয়রা খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে দই খায়। দই-চিড়ার সঙ্গে হালকা মুড়ি ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খাওয়া যায়। গরমের মৌসুমে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করা হয়। এ ঘোল গরমের দিনে মানবদেহকে ঠান্ডা রাখে। অনেকে কুটুম বাড়িসহ দূরদূরান্তের পছন্দের মানুষকে উপহার কিংবা দেশের বাইরেও প্রিয়জনের কাছে এখানকার দধি পাঠান। মহিষের এই টক দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপাদান রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য অনেক উপকারী বটে।

মনপুরা দ্বীপ : দ্বীপ জেলা ভোলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট্ট আরেক দ্বীপ মনপুরা। ভোলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপাসাগরের কোল ঘেঁষে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা ৮০০ বছরের পুরোনো এ দ্বীপটি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা।
প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদের বৈচিত্র্যে ভরপুর এ দ্বীপে না এলে বোঝাই যাবে না এই দ্বীপ উপজেলায় কী মায়া লুকিয়ে আছে। পর্যটক বা ভ্রমণপিপাসু মানুষকে মুগ্ধতার বন্ধনে আটকে দেওয়ার বহু জাদু ছড়ানো আছে এ দ্বীপে। এখানে ভোরের সূর্য ধীরে ধীরে পৃথিবীতে তার আগমনী বার্তা ঘোষণা করে। আবার বিকালের শেষে এক পা-দুপা করে সে আকাশের সিঁড়ি বেয়ে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে পশ্চিমাকাশে মুখ লুকোয়। রাতে নতুন শাড়িতে ঘোমটা জড়ানো বধূর মতো সলাজ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় পুরো দ্বীপ।

জমির শাহ পুণ্য সাধকের স্মৃতিবিজড়িত এই মনপুরা দ্বীপের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ৭০০ বছর আগে পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল মনপুরায়। তাই আজও এখানে পর্তুগিজদের নিয়ে আসা কেশওয়ালা লোমশ কুকুর দেখতে পাওয়া যায়।
মনপুরার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে হাজার হাজার একরের ম্যানগ্রোভ বন। যেখানে জীবিত গাছের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল ক্যানভাস মনপুরাকে সাজিয়েছে সবুজের সমারোহে।
মনপুরার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল চর তাজাম্মুল, চরজামশেদ, চরপাতিলা, চর পিয়াল, চরনিজাম, লালচর, বালুয়ার চর, চর গোয়ালিয়া, সাকুচিয়াসহ ছোট-বড় ১০-১২টি চরে বন বিভাগের প্রচেষ্টায় চলছে নীরব সবুজ বিপ্লব। চোখ-ধাঁধানো রূপ নিয়েই যেন এসব চরের জন্ম। চরগুলো কিশোরীর গলার মুক্তোর মালার মতো মনপুরাকে ঘিরে আছে। শীত মৌসুমে হাজার হাজার অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে সমগ্র চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের অতিথি পাখির উড়ে বেড়ানো, হরিণের পালের ছোটাছুটি, সুবিশাল নদীর বুক চিরে ছুটে চলা জেলে নৌকা, ঘুরে বেড়নো মহিষের পাল আর আকাশছোঁয়া কেওড়া বাগান কঠিন হৃদয়ের মানুষের মনও ছুঁয়ে যায়। চারদিকে নদীবেষ্টিত মনপুরায় নৌকা কিংবা সাম্পানের ছপছপ দাঁড় টানার শব্দ আর দেশি-বিদেশি জাহাজের হুইসেল মিলেমিশে একাকার হলে মনে হয় কোনো দক্ষ সানাইবাদক আর তবলচির মন-ভোলানো যুদ্ধ চলছে।
মনপুরায় যে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যই দেখা যাবে, তা নয়। গতানুগতিক সব খাবার ছাড়াও তিনটি স্পেশাল আইটেম আছে মনপুরার। এগুলো হচ্ছে খাসি পাঙাশ, মহিষের দুধের কাঁচা দই ও শীতের হাঁস। নদী থেকে ধরে আনা টাটকা খাসি পাঙাশ আর চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো মহিষের পাল (বাতান) থেকে সংগৃহীত কাঁচা দুধ বা দইয়ের স্বাদই আলাদা। তা ছাড়া মেঘনার টাটকা ইলিশের স্বাদও ভোলা যায় না কখনো।

তারুয়া সমুদ্রসৈকত : ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠে ঢালচর এলাকা। স্থানীয়রা যখন এই এলাকায় মাছ ধরতে আসতেন, তখন শত শত তারুয়া নামের একপ্রকার মাছ উঠে আসত তাদের জালে। ধারণা করা হয়, সে কারণেই এ এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে তারুয়া, যা এখন সবার কাছে সমুদ্রসৈকত নামে পরিচিত।
তারুয়া সমুদ্রসৈকত (Tarua Sea Beach) ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত ঢালচরের সর্বদক্ষিণের ভূখণ্ড। প্রায় ৭ কি.মি. দীর্ঘ এই তারুয়া সমুদ্রসৈকতের এক পাশে বঙ্গোপসাগর আর অন্য পাশে বিস্তীর্ণ চারণভূমি, যার শেষ হয়েছে তারুয়া সৈকত-সংলগ্ন ম্যানগ্রোভ বনে। হরিণ, বন্য মহিষ, বানর, লাল কাঁকড়াসহ বৈচিত্র্যময় প্রাণীর বসবাস এই দ্বীপে। প্রকৃতির নিখাদ নির্জনতা এবং মোহনীয়তা যেসব মানুষকে আন্দোলিত করে, নতুন করে বেঁচে থাকার উদ্দীপনা জোগায়, তার সকল উপকরণই তারুয়া সমুদ্রসৈকতে উপস্থিত। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে এই সৌন্দর্য সাজিয়েছে, আপন ভঙ্গিমায়।

ভোলায় জন্ম নেওয়া দেশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব :
১. বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল-মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ। ২. তোফায়েল আহমেদ-রাজনীতিবিদ, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী। ৩. নাজিউর রহমান মঞ্জুর-মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ। ৪. মাওলানা কামালউদ্দীন জাফরী-বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, উদ্যোক্তা ও সংগঠক। ৫. মোশারেফ হোসেন শাজাহান। ৬. অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। ৭. আন্দালিব রহমান-সাবেক সংসদ সদস্য, আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ। ৮. সিদ্দিকুর রহমান-সাবেক সাংসদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৯. নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ-বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ৯. হাফিজ ইব্রাহিম-সাবেক সাংসদ। ১০. আলী আজম মুকুল-সাবেক সাংসদ। ১১. মেজর (অব.) জসিম উদ্দিন-সাবেক সাংসদ। ১২. মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ-সাবেক মন্ত্রী ও ফুটবলার। ১৩. নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন-সাবেক সাংসদ। ১৪. সাদ জগলুল ফারুক-সাবেক সাংসদ। ১৫. জাফর উল্যাহ চৌধুরী-সাবেক সাংসদ। ১৬. নাজিম উদ্দিন আলম-সাবেক সাংসদ ও ডাকসুর জিএস। ১৭. আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব-সাবেক সাংসদ। ১৮. নলিনী দাস-ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী। ১৯. আমিনুল হক-ফুটবলার। ২০. সাঈদ বাবু-অভিনেতা। ২১. তৌসিফ মাহবুব-অভিনেতা।
সুযোগ পেলে সপরিবারে ঘুরে আসুন সৌন্দর্যের লীলাভূমি দ্বীপের রানি খ্যাত ভোলা জেলা। ভোলায় ভ্রমণ আপনার অভিযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করবে, সন্দেহ নেই।
 

কমেন্ট বক্স