সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহটি নিউইয়র্কে মহাব্যস্ত ড. ইউনূস। জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ। এর আগে ২০২৪-এ যোগ দিয়েছিলেন জুলাই আন্দোলনের কুশীলবদের নিয়ে। কিন্তু ২০২৫-এ গড়েছেন নতুন ইতিহাস। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি’র দু’জন করে প্রতিনিধি। জোর প্রচারণা, ‘আওয়ামী লীগের মব’ ঠেকাতে আনা হয়েছে তাদের। কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, উদ্দেশ্য ভিন্ন, আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে জাতিসংঘের শতভাগ সম্মতি আদায়। ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্বর্তীমূলক’ নির্বাচনের বিতর্ক যেনো না ওঠে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সম্পাদিত হচ্ছে এ নিয়ে সমঝোতা।
ইউনূসের রাষ্ট্রপতিত্ব ঠেকাতে দেশে দেশে ‘আওয়ামী মব’
★ নতুন সরকারে রাষ্ট্রপতি হতে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ
নিউইয়র্ক মিশনে অংশ নিয়ে হতবাক ড. ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আছেন সাড়ে চার মাস। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন দিয়ে অবসরে যেতে যান। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন নির্দেশনা। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা নিয়ে নিউইয়র্কে পাচ্ছেন ক্রমাগত চাপ। নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকারে রাষ্ট্রপতি হতে হবে তাঁকে।
মার্কিন কূটনীতিকরা জানিয়েছেন আগ্রহের কথা। সরকারের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক দূত সার্জিও গোর। একইসঙ্গে ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূতও তিনি। ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একান্ত ঘনিষ্ঠজন। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে তার সরকারের সায় রয়েছে।
‘আইএমএফ’ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান ক্রিস্টানিয়া জর্জিয়া। পূর্বকাল থেকেই তিনি ড. ইউনূসের কার্যক্রমের ভক্ত। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিউইয়র্কে সাক্ষাৎ করেন।
একই আশাবাদ সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং বেলজিয়ামের রানি মিসেস ম্যাথিওর।
সফরসঙ্গী তিনটি দলও ড. ইউনূসকে প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপির পক্ষে চেয়ারপারসন বেগম জিয়া, তারেক রহমান। জামায়াতের পক্ষে আমীর ডা. শফিকুর রহমান স্বয়ং। এছাড়া কিংস পার্টি-খ্যাত এনসিপিও। যদিও ৮৫ বছর বয়স্ক ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতিত্বে আগ্রহী নন। বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে। কোন না কোন ‘মার্কা’ বিজয় লাভ করবে। নতুন কোন দলীয় সরকার বা মার্কার অধীনে নয়। রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেয়ে দলনিরপেক্ষ ও বিতর্কমুক্তই থাক অবসরটুকু।
ড. ইউনূস-এর এই বার্তা বাইরে তেমন প্রচার পায়নি। চিরশত্রু শেখ হাসিনা গং-ও তেমন ওয়াকিবহাল নয়। ফলে প্রতিদিন ইউনূস পতনের ডাক দিচ্ছে মহলটি। বৃটেন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় চলছে ‘মব কার্যক্রম’। আওয়ামী লীগের ফান্ডে এস আলম-এর আড়াই হাজার কোটি টাকা। বিতর্কিত এই ধনকুবেরকে ‘শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার’ বলা হয়। ‘ইউনূস-পতনে’ গৃহীত হয়েছে দেশে-বিদেশে ‘আক্রমণ প্রকল্প’। কারণ, তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে বসানোর তথ্যটি ফাঁস হয়েছে। সেটি ঠেকানো জরুরি বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। প্রবাস-পালানো নেতৃবর্গ তাঁকেই পয়লা শত্রু ভাবছে। দেশে জেল, জরিমানা, বিচার, রাজনীতি স্থগিতকরণ চলমান। ড. ইউনূসের পতন হলে পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।
‘লিথাল ঊইপেন’ বনাম ‘ভাঙা ডিম’ নিক্ষেপ ★ জেএফকে’তে
সফরকারী রাজনীতিকেরা যেভাবে নিগৃহীত
কথা ছিলো আওয়ামী লীগ প্রতিহত করবে ড. ইউনূসকে। কিন্তু ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওনাকে ছুঁ’তে পারেনি। জেএফকে’র ভিআইপি দরজা দিয়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে গেছেন। সঙ্গে ৬ জন উপদেষ্টা, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাবৃন্দ। কিন্তু সফরসঙ্গী ৫ রাজনীতিক যেতে পারেননি। কারণ তাদের ভিসা ক্যাটাগরি ছিলো ই-১, ই-২। এই ক্যাটাগরিতে ভিআইপি লাউঞ্জের সুবিধা মেলে না। ফলে জনএফ কেনেডি এয়ারপোর্টে তারা ছিলেন অসহায়।
আরেকটি দুর্ঘটনা- ভুল টার্মিনালের নির্দেশনা। টার্মিনাল ফোর-এর বদলে স্থান নির্ধারিত হয় ‘এইট’-এ। জানা যায় জেএফকে কর্তৃপক্ষ সেখানকার অনুমতি দিয়েছিলো। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা প্রস্তুত ছিলেন। উভয় পক্ষে কয়েক শতাধিক নেতা-কর্মী পৃথক ফুটপাতে উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত ছিলো নিজস্ব নেতাদের অভ্যর্থনা জানাতে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, হুমায়ন কবির। জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহেল তাহের। এছাড়া এনসিপির সম্পাদক আখতার হোসেন, ড. তাসমিন জারা।
আট নম্বর টার্মিনালে অপেক্ষারত নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্তিকর তথ্য পান যে, কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আছেন। সবাই ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। ফলে বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন খোকন কর্মসূচি সমাপ্ত করেন। ব্যানার, ফেস্টুন, ফুলের তোড়া আনা অভ্যর্থনাকারীরাও চলে যান।
অন্যদিকে আওয়ামী শিবিরে জানিয়ে দেয়া হয় প্রকৃত তথ্য যে, চার নম্বর টার্মিনাল দিয়ে অতিথিরা বের হচ্ছেন। সুযোগ বুঝে আক্রমণাত্মক মানসে জমায়েত হয় তাদের একটি অংশ। গালাগাল খেলেও শারীরিক নির্যাতন ঘটেনি বিএনপি মহাসচিবের। এনসিপির তাসনিম জারাকে ‘খা*কি মাগী’ বলা হয়। আরেকজন বলেন ‘মহিলা মানুষ ছেড়ে দে’। অতঃপর মিজানুর চৌধুরী নামে যুবলীগ নেতা তেড়ে আসে। ভাঙা ডিম ছুঁড়ে মারে আখতার হোসেনের প্রশস্ত পিঠে। মুহূর্তেই দৃশ্যসহ ভাইরাল হয় বিকেলের আলোড়িত ঘটনাটি। রাত সাড়ে নয়টায় জ্যাকসন হাইটসে গ্রেফতার হয় ‘ডিম-মিজান’। বৃহত্তর সিলেটের যুবলীগ নেতা তিনি। গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে ‘এনওয়াইপিডি’।
ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন আখতার। বলেন, হাসিনার গুলির ভয়কে উপেক্ষা করেই জুলাই আন্দোলন করেছি। সেখানে এই ভাঙা ডিমের আঘাতে কী এসে যায়!
আওয়ামী পক্ষ অবশ্য বিষয়টিকে ‘বিশাল বিজয়’ বলছে। তাদের মতে- এটি কোনো ‘অশ্বডিম্ব’ নয়। ‘লিথাল উইপেনের চেয়েও শক্তিশালী প্রতিবাদ।’
আ.লীগবিহীন নির্বাচন ► জাতিসংঘের
হ্যাঁ-না ★ ‘ইনক্লুসিভ ইলেকশন’
বিষয়ক সমঝোতার শেষ চেষ্টা
২০২৪-এর ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে জাতিসংঘ। তাদের প্রামাণ্য প্রতিবেদন অনুসারে শহীদের সংখ্যা ১৪০০। এই বিশাল হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে ছাত্রশক্তি। বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত। ছাত্রশক্তির দাবির মুখে সরকার সেটি ঘোষণা করে।
জাতিসংঘের আরেকটি ঘোষণায় ‘ইনক্লুসিভ ইলেকশন’ দাবি করা হয়। যেটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সর্বজনীন নির্বাচন বলে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বঞ্চিত হবে কেনো- সেই প্রশ্ন উঠেছে। এটি উত্থাপন করে ‘ডিপ্লোমেটিক করেসপনেন্ডন্ট অ্যাসোসিয়েশন’। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস বক্তব্য দেন। বলেন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই অন্তর্ভুক্তিমূলক। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বিষয়েও প্রশ্ন করা হয়। সব দলের থাকা না-থাকা বিষয়ে উত্তর দেননি।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ড. ইউনূস সকাশে সাক্ষাৎ করেন। ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচনকে স্বাগত জানান। কারিগরি ও কূটনৈতিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেন। আওয়ামী লীগ-বিহীন নির্বাচনে আপত্তি নেই বলে জানান। তবে বিষয়টি জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে নিতে বলেন। সমঝোতা চূড়ান্ত সাপেক্ষে নির্বাচনের পরামর্শ দেন। ড. ইউনূসও সে মতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস তার বন্ধু। ফলে জটিলতা কাটিয়ে নেয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা।
সংশ্লিষ্ট আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত লাগতে পারে। এ জন্যে মুখ্য তিনটি দলের প্রতিনিধিদের নিউইয়র্ক আগমন। বিষয়টি দেশে-বিদেশে ভীষণ স্পর্শকাতর। তাই এই ইস্যুতে কোন বিবৃতি, পর্যালোচনা নেই। নির্বাচন-পরবর্তী কোনো র্বিতক যেনো না ওঠে সেজন্যে অতি সন্তর্পণে চলছে সমঝোতা-পর্ব। তার আগে ইস্যুটি আওয়ামী মহলে দিতে নারাজ। সেক্ষেত্রে নির্বাচন নিয়ে সৃৃষ্টি হতে পারে মাঠকাঁপানো জটিলতা।


সালেম সুলেরী


