Thikana News
০১ নভেম্বর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫





 

একটি ‘দোস্ত’ দোস্ত না  রাহা’র গল্প

একটি ‘দোস্ত’ দোস্ত না  রাহা’র গল্প





 
এই লেখাটা লিখতে গিয়ে ঈশপের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। এক তৃষ্ণার্ত নেকড়ে পাহাড়ের ঝর্ণার উপরের দিকে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার পানি পান করছে। সে সময় ঝর্ণার নিচে এক ভেড়া পানি পান করতে আসে। উপর থেকে ভেড়াকে দেখে ক্ষুধার্ত নেকড়ে ভেড়াকে খেতে মনস্থির করে। এ জন্য সে তাকে হত্যার একটা অজুহাত বের করে। উপর থেকে নিচে নেমে সে পানি পানরত ভেড়াকে পানি নোংরা করার অভিযোগ করে। ভেড়া জানায়, ‘পানি যেখান থেকে নিচে নামছে, সেখানে তো তুমি ছিলে তাহলে আমি কীভাবে পানি নোংরা করলাম।’ এই অজুহাত ব্যর্থ হওয়ায়, নেকড়ে বলে ‘গত বছর তুই আমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছিস।’ ভেড়া উত্তরে বলে, ‘বাহ, গত বছর তো আমার জন্মই হয়নি’। উত্তর শুনে নেকড়ে বলে, ‘ঠিক আছে, তুই না বললেও তোর বাবা-মা’র কেউ বলেছে। নেকড়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই বুঝতে পেরে ভেড়া বলে, ‘আমি দুঃখিত, তোমার কথা যদি সত্যও হয়, সেক্ষেত্রেও, আমার কোনো অপরাধ নেই। ভেড়ার কথায় কর্ণপাত না করে নেকড়ে তাকে ঠিকই হত্যা করে খেয়ে ফেলে।

গল্পটা মনে পড়ল সম্প্রতি ভারতের পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর দেখে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া থেকে ভারতের অব্যাহত তেল আমদানির শাস্তিস্বরূপ ভারতের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। একই কারণে ভারতকে অনির্ধারিত জরিমানাও করা হবে বলে জানানো হয়। এই ঘোষণার পূর্বে ভারতের উপর শুল্কহার ছিল ২৫ শতাংশ। তার সঙ্গে পরে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ যোগ করে মোট শুল্কহার ৫০ শতাংশ করা হয়। ব্রাজিল ছাড়া অন্য কোনো দেশের উপর ৫০ শতংশ শুল্কহার ধার্য করা হয়নি।

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তার দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য বিদ্যমান শুল্কহার পুনর্নির্ধারণের ঘোষণা দেন। এরইমধ্যে বাংলাদেশসহ বহু দেশের উপর ধার্যকৃত নতুন শুল্কহার ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে Give and Take ভিত্তিতে বাংলাদেশের উপর পূর্বে ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়।

ভারতের শুল্কহার বৃদ্ধির পেছনে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির যে যুক্তি দেয়া হয়, সেই যুক্তিতে ইইউসহ আরও কিছু দেশের শুল্কহার বৃদ্ধির কথা থাকলেও, সেসব দেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার ভারতের মতো বৃদ্ধি করা হয়নি। তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫.৭ বিলিয়ন ডলার। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পণ্য আমদানির পরিমাণ ৮৫.৫ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ইইউ রাশিয়ার সঙ্গে ৭৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। রাশিয়া থেকে ইইউ’র আমদানিকৃত পণ্যের একটি বড় অংশ তেল ও এলএনজি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ইইউ রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিলেও ভারত কর্তৃক রাশিয়া থেকে তেল আমাদনির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ভারত রাশিয়া থেকে প্রতিদিন ২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমাদনি করে। ভারতের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও জাতীয় স্বার্থে রুশ তেল আমদানি অপরিহার্য বলে জানানো হয়। 

যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে তেল না কিনলেও ইউরোনিয়াম ও সারসহ আরও কিছু পর্ণের ক্রেতা। ভারতের মতো ইইউ একই অপরাধে অপরাধী হলেও ভারতের উপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘটনাকে কেউ কেউ শক্তিশালী ও মতলববাজ পক্ষ কর্তৃক অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য কোনো বাহানার যে অভাব হয় না, সেই ধারণার সঙ্গে তুলনার প্রয়াস পান। অবশ্য ভারতকে কোনো অর্থে দুর্বল প্রতিপক্ষ ভাবার অবকাশ নেই। ভারতের বর্তমান শাসকদল ভারতকে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি বলে দাবি করে, যদিও বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর মতে বিজেপি শাসনে ভারতের অর্থনীতি এখন মৃতপ্রায়। ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারত সামরিক  সামর্থ্যরে দিক দিয়েও বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। ভারতের প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এহেন আচরণকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অন্যায্য, অসঙ্গত ও অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করেন। ভারতীয় প্রতিক্রিয়াকে পাত্তা না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে ভারতের সঙ্গে আর কোনো আলোচনা হবে না বলে জানিয়ে দেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একসময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বন্ধুত্ব পেতে এমন কিছু নেই যা করেননি। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় পর্যন্ত তিনি অংশ নেন। মোদির উদ্যোগে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর টেক্সাসের হিউস্টনের একটি স্টেডিয়ামে ‘হাউডি মোদি’ (How do you do, Modi) নাম দিয়ে ভারতীয় আমেরিকানদের এক বিশাল সমাবেশের (৪০-৫০ হাজার) আয়োজন করা হয়, যেখানে মোদি ট্রাম্পের হাত ধরে ও বুকে বুক মিলিয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে ‘আগলি বার, ট্রাম্প সরকার’ অর্থাৎ আগামীবার ট্রাম্পের সরকার বলে স্লোগান তোলেন। গঠন করা হয় ভারতীয়-আমেরিকান হিন্দু রিপাবলিকান ফোরাম। সেবার অবশ্য নির্বাচনে বাইডেন জয়ী হন। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় আমেরিকানদের ভোট ও তার নির্বাচনী তহবিলে তাদের অর্থ পেতে ট্রাম্প মোদির তালে তাল মেলান। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের যোগদানের আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহের জন্য মোদি তার বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরকে দু’দফায় ওয়াশিংটনে পাঠালেও আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। অভিষেক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ না পেলেও মোদি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে এসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতনসহ বাংলাদেশ বিষয়ে নানা বানোয়াট অভিযোগ তুলে ধরে ট্রাম্পের কানভারী করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। ট্রাম্প এসব অভিযোগের প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে ভারতকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র (এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ইত্যাদি) ও অন্যান্য মার্কিন পণ্য বিক্রির প্রস্তাব দেন। মোদি এই প্রস্তাবে তাৎক্ষণিকভাবে ইতিবাচক সাড়া না দিলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ মনক্ষুণ্ন হন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা ছিল না মর্মে বক্তব্য দিয়ে মোদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরাগভাজন হন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতের তল্পীবাহক শেখ হাসিনা সরকারের পরনে ভারত নিজেকে এক প্রকার সর্বহারা বা এতিম বলে ভাবতে শুরু করে এবং যেকোনো মূল্যে ড. ইউনূসের সরকারের উৎখাত ঘটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় শেখ হাসিনার পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে ধ্যানজ্ঞান হিসাবে গণ্য করে। ভারতীয় মিডিয়া ও সমাজ মাধ্যমে বাংলাদেশ বিরোধী ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির সব ধরনের অপচেষ্টা চালানো হয়। এ সময় বাংলাদেশ মোদির কথিত বন্ধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনে আগ্রাসন অত্যাসন্ন এবং ভারতীয় পণ্য সরবরাহ (চাল, ডাল, গম, আলু পেঁয়াজ ইত্যাদি) বন্ধ করায় বাংলাদেশের মানুষ অনাহারে মরবে বলে প্রচারণা চালানো হয়। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ভারতীয় পণ্য না আসা সত্ত্বেও ড. ইউনূসের বাংলাদেশে গত এক বছরে একজন মানুষও অনাহারে মারা যায়নি, বরং বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করতে না পেরে ভারতের বহু ব্যবসায়ীই সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে যা রাখে আল্লাহ মারেকে এবং শকুনের দোয়ায় গরু মরে না প্রবাদ বাক্য দুটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় মোদির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তথাকথিত দোস্তির অবসান হলো বলা যায়, যদিও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কোনো কথা নেই- সেটিও সত্য।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘটনা বিশ্ব অর্থনীতিকে এক বড় চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন জনায়, বর্ধিত শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন কোষাগারে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার জমা হবে, যদিও বর্ধিত শুল্ক পরিশোধপূর্বক পণ্য আমদানি করে মার্কিন আমদানিকারকরা পণ্যের বর্ধিত মূল্য নিজেরা বহন না করে ভোক্তা মার্কিন নাগরিকদেরই বহন করার সম্ভাবনা বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট।
 

কমেন্ট বক্স