সিরাজুল ইসলাম সরকার
বঙ্গবন্ধু বেশ কিছুদিন বাড়িতেই কাটালেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। বাবা খুব দুঃখ পেলেন যখন বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি আইন বা ল পড়বো না। বাবা ছেলেকে বললেন, যদি ঢাকায় পড়তে না চাও, তবে বিলাত যাও। সেখান থেকে বার এট ল ডিগ্রি নিয়ে আসো। যদি দরকার হয়, আমার সমস্ত জমি-জমা বিক্রি করে তোমাকে টাকা দেবো। বঙ্গবন্ধু বললেন, এখন বিলাত গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে আমি পারবো না। বঙ্গবন্ধু ছিলো ভীষণ জেদ। কার বিরুদ্ধে? মুসলিম লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টো হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করতেই হবে। জনগণ আমাদের ভালো জানতো, এবং আমাদের কাছেই সব প্রশ্ন করতো। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দূর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়া শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না, রাজধানী করাচিতে। সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছুই নেই। বঙ্গবন্ধু তার বাবাকে সবকিছু বললেন।
বঙ্গবন্ধুর বাবা বললেন, আমাদের জন্য কিছুই করতে হবে না। তুমি বিয়ে করেছো, তোমার একটা মেয়ে আছে (শেখ হাসিনা), তাদের জন্যও কিছু একটা করা দরকার।
বঙ্গবন্ধু তার বাবাকে বললেন, আপনিও আমাদের জন্য জমি-জমা অনেক কিছু করেছেন। যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসবো। তবুও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।
বাবা ছেলেকে আর কিছুই বললেন না।
রেনু বললো, এভাবে তোমার কতকাল চলবে?
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন, বাবার সাথে যখন কথা বলছিলেন, রেনু আড়ার থেকে সব শুনছিলেন।
রেনু (ফজিলতন নেছা) খুব কষ্ট করতেন, কিন্তু কিছুই বলতেন না। রেনু সবসময় যা পারতেন বঙ্গবন্ধুর জন্য টাকা জোগার করে রাখতেন। যাতে বঙ্গবন্ধুর কোন কষ্ট না হয়।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা রওনা হয়ে আসলেন। রেনুর শরীর খুব খারাপ দেখে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন ইত্তেহাদ পত্রিকায় কাজ করতেন, সেখান থেকে কিছু টাকাও পেতেন। যদিও সে সময় দৈনিক ইত্তেহাদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। পূর্ব বাংলার সরকার প্রায় সময়েই ব্যান্ড করে দিতো। এজেন্টরা টাকা দেয় না। যদিও ইত্তেহাদ পূর্ব বাংলায় খুব বেশি চলতো।
ঢাকায় এসেই ছাত্রলীগের সম্মেলন যতো তাড়াতাড়ি হয়, তার ব্যবস্থা করলেন। এর আগে আর কখনও ছাত্রলীগের কাউন্সিল হয়নি। নির্বাচন হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুও আর ক্ষমতায় থাকতে চান না। ঢাকার তাজমহল সিনেমা হল ভাড়া করা হলো। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে কনফারেন্স হলো। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বললেন, আমি আজ থেকে আপনাদের ছাত্রলীগের সভ্য থাকতে চাই না। ছাত্র পরিষদের সাথে আমার জড়িত থাকার আর কোন অধিকার নেই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ এখন আমি আর ছাত্র নই।
তিনি বলেন, তবে পূর্ব বাংলায় ছাত্রসমাজ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব জনগণ কোনদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার জন্য, বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য আপনারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, মানুষ চিরদিন তা স্মরণ রাখবে। আপনারাই এ দেশে বিরোধী দল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। এটই ছিলো বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার মূল সারাংশ।
নির্বাচন হয়েছিলো। দবিরুল ইসলাম তখন জেলে ছিলেন। তাকে সভাপতি, খালেদ নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিলো। দবিরুল সম্বন্ধে কারো আপত্তি ছিলো না। তবে খালেদ নেওয়াজের ব্যাপারে অনেকের আপত্তি ছিলো। কারণ সে কথা একটু বেশি বলতো। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করলেন।
বঙ্গবন্ধুর বিদায়ের সময়ে কেউ তার অনুরোধ ফেললো না। অথচ এই খালেদ নেওয়াজ এই সংগঠনের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি করেছিলো। চেষ্টা করতো সত্য, কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না। আর অন্যের কথা বেশি শুনতো। নিজে ভালো কি মন্দ তা ভাবতো না। একমাত্র ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সম্পাদক আবদুল ওবাদুদের জন্য প্রতিষ্ঠান সমূহ ক্ষতি হতে পারেনি।
পরে ওয়াদুদ পূর্ব পাকিস্তানের সম্পাদক হয়েছিলেন, যদিও বঙ্গবন্ধু আর সদস্য ছিলেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। বঙ্গবন্ধুও বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করেননি। সবাই বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করতো।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অনেক পরিশ্রম করে একটি ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্রের খসড়া ড্রাফট করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক আলোচনা করেই খসড়া গঠনতন্ত্র তৈরি করেছিলেন। সবাই একমত হয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কয়েকদিন পর্যন্ত সভা চললো। দু’একবার শামসুল হকের সাথে মাওলানা ভাসানীর গরম গরম আলোচনাও হয়েছিলো। একদিন শামসুল হক ক্ষেপে গিয়ে মাওলানা ভাসানীকে বলে বসলেন, ‘এ সমস্ত আপনি বুঝবেন না। কারণ এ সমস্ত গঠনতন্ত্র নিয়ে জানতে হলে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন। তা আপনার নেই’।
মাওলানা ভাসানী ক্ষেপে মিটিংয়ের স্থান ত্যাগ করলেন। বঙ্গবন্ধু শামসুল হককে বুঝিয়ে বললেন, শামসুল হক বুঝতে পারলেন। শামসুল হক বুঝতে পেরে ভাবলেন, কথাটা সত্য হলেও বলাটা ঠিক হয়নি। কথাটা বুঝতে পেরে মাওলানা ভাসানীকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
শামসুল হক ছিলেন খুব রাগী মানষ। কিন্তু এই রাগ বেশিক্ষণ থাকতো না।
মাওলানা ভাসানীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো ওয়ার্কিং কমিটিকে নমিনেশন দেয়া। ভাসানী যাদের নমিনেশন দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর তা মোটেও পছন্দ ছিলো না। বঙ্গবন্ধু ভাসানীকে বললেন, আপনি এ সমস্ত লোক কোথায় পেলেন? আর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করলেন? এরাতো সুযোগ পেলেই চলে যাবে।
মাওলানা সাহেব বললেন, আমি কি করবো? কাউকে ভালো করে জানিও না, চিনিও না। তোমার ছাত্ররা যাদের নাম দিয়েছে, আমি তাদেরকেই সদস্য করেছি।
বঙ্গবন্ধু বললেন, দেখবেন বিপদের সময় এরা কি করে?
ওয়ার্কিং কমিটি গণতন্ত্র গ্রহণ করলো এবং কাউন্সিল সভা থেকে একে অনুমোদন করা হবে ঠিক হলো। খসড়া গঠনতন্ত্র ছাপিয়ে দেয়া হলো। কারো কোন প্রস্তাব থাকলে পেশ করতে বলা হলো। জনমত যাচাই করার জন্য খসড়া গঠনতন্ত্রটি রাখা হলো। তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দেয়ার প্রস্তাব প্রস্তাব করা হয়। কেবলমাত্র দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এ কথাও বলা হলো।
আরো অনেক অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম দেয়া হয়েছিলো। সবাই প্রতিষ্ঠানের দিকে আত্মনিয়োগ করলেন। বঙ্গবন্ধু, শামসুল হক ও মওলানা ভাসানী তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় প্রথম সভা করতে যান। জামালপুরের উকিল হায়দার আলী মল্লিক সেখানে আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। ছাত্রনেতা হাতেম আলী তালুকদার অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন এই সভা কার্যকরী করার জন্য।
এরা ৩ জন সভায় উপস্থিত হয়ে দেখলেন, সভায় অনেক জনসমাগম হয়েছে। যখনই সভা আরম্ভ হবে, তখনই বঙ্গবন্ধু ১০/১৫ জন লোককে চিৎকার করতে দেখলেন। বঙ্গবন্ধু ঐদিকে ভ্রক্ষেপ না করে সভা আরম্ভ করেন। জামালপুরের লোকেরা ভেবেছিলো, শামসুল হক সভাপতিত্ব করবেন, আর মাওলানা ভাসানী প্রধান বক্তা থাকবেন। সভা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পুলিশ এসে মাওলানা ভাসানীকে একটি কাগজ দিলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তব্য রাখবোই।
ভাসানী দাঁড়িয়ে বললেন, ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না। তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন। আল্লাহ আমিন। মাওলানা মোনাজাত শুরু করলেন। কিছুই বাকি রাখলেন না। মাইক্রোফোন দিয়ে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত চিৎকার করে মোনাজাত করলেন। কিছুই বাকি রাখলেন না। যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার ও সিপাহীরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগলো। আধা ঘণ্টা পুরো মোনাজাতে পুরো বক্তৃতা করে শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগওয়ালারা বেয়াকুফ হয়ে গেলেন!
রাতে এক বাড়িতে খেতে গেলেন। মাওলানা ভাসানীর রাগ, খাবেন না! তিনি থাকতে কেনো সভাপতি হিসেবে শামসুল হকের নাম প্রস্তাব করা হলো? বঙ্গবন্ধু এক মহাবিপদে পড়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু মাওলানা সাহেবকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, আপনি এমন করলে লোকে কি বলবে? মাওলানা সাহেব কি আর বুঝতে চান? তাকে নাকি অপমান করা হয়েছে। শামসুল হকও রাগ হয়ে বলেছেন, মাওলানা সাহেব সবার সামনে এ কথা বলছেন কেনো?
সেদিনই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন ভাসানী সাহেবের উদারতার অভাব। তারপরও বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভক্তি
ও শ্রদ্ধা করতেন। কারণ তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তাত ছিলেন। যে কোন কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনায় প্রয়োজন। যাঁরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোন ভালো কাজ করতে পারেন না।
এ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধুর ছিলো। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং ত্যাগ আমাদের করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে। মুসলিম লীগ সরকার নির্যাতন চালাবে এবং নির্যাতন ও জুলুম করেই ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবে। নির্যাতনের ভয় পেলে বেশি নির্যাতন পেতে হয়। এখনও মুসলিম লীগের নামে মানুষকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে কিছুটা। কিন্তু বেশিদিন ধোঁকা দেয়া চলবে না। মুসলিম লীগের প্রতি যে মোহ এখনও আছে, জনগণকে বুঝাতে পারলে এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে, মুসলিম লীগ অত্যাচার ও জুলুম করতে সাহস পাবে না। বঙ্গবন্ধু সবাইকে এই নির্দেশই দিলেন।