Thikana News
২২ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ প্রয়োজন জনসচেতনতা

ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ প্রয়োজন জনসচেতনতা
ম আমিনুল হক চুন্নু

পরিবেশদূষণ ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের বেশ কিছু সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উন্নয়ন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। অথচ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা। একটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্য, গড় আয়ুসহ অনেক কিছুই নির্ভর করে সে দেশের পরিবেশের ওপর। বর্তমানে দেশে পরিবেশের যে অবস্থা, তা শুধু চিন্তিত হওয়ারই নয়, বরং উদ্বেগেরও। তা ছাড়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণ। বৃক্ষ যেমন পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সহায়তা করে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রক্ষা পেতে সহায়তা করে। কিন্তু আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলছি। নিষিদ্ধ পলিথিন-জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমেই আমাদের মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে শব্দদূষণ তেমন কোনো ক্ষতিকর মনে না হলেও তা মানুষের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, জিকা, চিকনগুনিয়া, ডায়রিয়া সংক্রমণ ও পানিতে আর্সেনিক থাকার কারণে সৃষ্ট চর্মরোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছর বিশেষ করে ডেঙ্গুর প্রকোপ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
তা ছাড়া ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। বিশ্বের অর্ধেক মানুষই ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। জুলাই ২০২৩ জাতিসংঘের এক সংবাদ সম্মেলনে এ সতর্ক বার্তা দেন ডব্লিউএইচওর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের ইউনিট প্রধান রমন ভেলাউধন। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০০-২০২২ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৮ গুণ বৃদ্ধি হয়েছে বলে রেকর্ড করেছে। এ সময় আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ থেকে বেড়ে ৪২ লাখ হয়েছে। এ ছাড়া প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রমন ভেলাউধন। কারণ সংস্থাটি সাম্প্রতিক বছরে আরও বেশি পরিসংখ্যান পেয়েছে। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে এবং আনুমানিক ১২৯টি দেশকে প্রভাবিত করেছে বলে মত প্রকাশ করেন।

প্রতিবছর ডেঙ্গুতে ৪০-৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তবে অনেক দেশ আছে, যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এ তথ্য জানানো হয় না। তা ছাড়া মৃত্যুর হার বেশির ভাগ দেশে প্রায় এক শতাংশের কম বলে ভেলাউধন মন্তব্য করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ তথ্যমতে, প্রতিবছর ১০০-৪০০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৮০ শতাংশ সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। সর্বশেষ ৪ জুলাই ২০২৩ এডিস মশার প্রাক-মৌসুম জরিপের তথ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ‘পুেেরা ঢাকার সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।’

অন্যদিকে ২৫ জুলাই ২০২৩ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সংবাদমাধ্যম টিভি নাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গুর ব্যাপক তাণ্ডব শুরু হয়েছে। রাজ্যে এখন পর্যন্ত ৫ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে ২০০ জনেরও বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। টিভি নাইন বলছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে যাওয়ার আগে ইমিগ্রেশনের সময় বাংলাদেশিদের ডেঙ্গু পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে। আরেক সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দ বলেছে, সময় যত এগোচ্ছে, ততই এই রাজ্যে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা।

সংবাদসূত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে বিশ্বে ডেঙ্গুর প্রকোপ ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এডিস-জাতীয় মাত্র একটি মশার কামড়েই একজন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। কেবল জ্বর বা শরীর ব্যথার মধ্যেই এই রোগ সীমিত থাকছে না, বহু ক্ষেত্রে এই রোগের ভাইরাস শরীরের ভাইটাল অর্গান, যেমন লিভার ও কিডনিকেও আক্রমণ করে অচল করে দিচ্ছে। আর বিকল কিডনি নিয়ে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি মহামারির দিকে যাচ্ছে। এবার অতীতের ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিনই হু হু করে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি কোনো উদ্যোগেই যেন দমানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাকে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগীর চাপ। ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় হাসপাতালে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট। সেই সঙ্গে রোগীর অতিরিক্ত চাপে নাকাল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

২৫ জুলাই ২০২৩ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৬ জন মারা গিয়েছে। একই সময়ে আরও ২ হাজার ৪১৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৭ হাজার ৯২৭ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ঢাকায় আছেন ৪ হাজার ৬৪৬ জন। তবে গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ২৮১ এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২। আক্রান্তের মধ্যে ঢাকার বাইরে ছিলেন ২৩ হাজার ১৬২ জন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হাসপাতালে যাননি এমন আরও কয়েক লাখ রোগী ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু ওই সময়ে কেস রিপোর্ট ছিল ১ লাখ কিন্তু কেস ছিল ৮-১০ লাখের মতো। এবার ওই সংখ্যাটাকেও ক্রস করে যায় কি না! স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ডেঙ্গু সম্পর্কিত দৈনিক তথ্যও এই আভাস দিচ্ছে।

বাংলাদেশে ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল ও নেহাতই অপ্রতুল। ঢাকাসহ দেশের অনেক শহরের বিভিন্ন সড়কে বেশ কিছু বৃহদাকার ডাস্টবিন থাকলেও সেগুলো নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করা হয় না। ফলে বাড়তি বহু ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিন উপচে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এসব স্থান মশা-মাছি ও অন্যান্য রোগ-জীবাণুর ব্রিডিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়েছে। মশকের দ্রুত বংশবিস্তারের ফলে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া বাসাবাড়ির দৈনন্দিন ময়লা-আবর্জনা পিসপোজালের কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকায় বহু ক্ষেত্রে এসব ময়লা-আবর্জনা পলিথিন ব্যাগে ভরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়। আর বহুতলবিশিষ্ট ভবনের বাসিন্দারা একইভাবে জানালা দিয়ে ময়লা-আবর্জনা ভবনের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়। তার ফলে দিনে দিনে আশপাশে ময়লার ভাগাড় তৈরি হয়। আর এগুলোই এডিস মশার প্রজননের উৎকৃষ্ট স্থান।

২২ জুলাই ২০২৩ বাংলাদেশ ও বিশ্বের পরিবেশরক্ষায় নিবেদিত আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের (বেন) ২৫ বছর পূর্তি উৎসব ও পরিবেশ মেলায় ডাক্তার আব্দুল বাতেন (চেয়ারম্যান, সিইও) তার বক্তব্যে বলেন, ডেঙ্গু ছাড়াও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে বহু মানুষ ব্যাপক হারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পানিতে আর্সেনিক থাকায় বহু মানুষ চর্মরোগসহ নানা ধরনের সংক্রমিত রোগের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া, পানিসম্পদ এবং পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হোসাইন ম আজম বলেন, বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সরাসরি প্রভাব বলে মনে করছেন। যদিও এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ বাড়াতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে বলে তারা মনে করছেন। তাই ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনলে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ স্থায়ীভাবে কমানো সম্ভব হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট চিকিৎসক ঝুন্নুন চৌধুরী তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মশা নিধনে শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেতনতা বাড়িয়ে কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটি নেতা ও প্রায় ৪০ বছর যাবৎ বাঙালির দাবি আদায়ের লড়াকু সৈনিক জনাব হাসান আলী তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুও। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে অভিযান ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য তিনি আহ্বান জানান। অন্যদিকে মো. মুস্তাফিজুর রহমান (সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, স্কলার্সহোম, সিলেট) বাংলাদেশ থেকে তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসটি কোভিড-১৯ এর মতো বাতাসে ছড়ায় না। এটি ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। তবে যেহেতু প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম, তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে। উদাহরণস্বরূপ বৃষ্টিতে বাড়ির চারপাশে ভাঙা পাত্র বা পরিত্যক্ত ড্রাম বা গাড়ির টায়ারে দীর্ঘদিন জমে থাকা পানি কিংবা এসির জমে থাকা পানি দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করা ইত্যাদি। তাই প্রথমেই আমাদের চারপাশ পরিষ্কার করে মশার আবাসস্থল নষ্ট করে ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করতে হবে।
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলছে। রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে জ্বরে আক্রান্তের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কারণ ভাঙাচোরা সড়কের খানাখন্দে জমে থাকা পানিও মশক প্রজননের প্রধান উৎসস্থল। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ছাড়াও শাকসবজি, ফলমূল ও মাছে বিষাক্ত ফরমালিন অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ও হোটেল-রেস্তোরাঁর পচা-বাসি, মরা মুরগির মাংসসহ এসব খাবার খেয়েও বহু মানুষ নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব কারণে কেউ কেউ বাংলাদেশকে একটি ‘ডিজিজ ফ্যাক্টরি’ বা ‘রোগের আখড়া’ হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু দেখা দিলেও গত ২৩ বছরে তা নিধন করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় সরকার বিভাগ দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে স্বাস্থ্য বিভাগ ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে, তেমনি ডেঙ্গু একটি বাহকজনিত রোগ, তাই দেশজুড়ে স্বাস্থ্য বিভাগকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগে থেকেই দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েক মাস আগে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করলেও ঢাকার দুই সিটি যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি বলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে নগরবাসী মনে করেন।

আল-জাজিরা টিভিতে সম্প্রতি প্রচারিত এক রিপোর্টে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে ত্রুটিপূর্ণ নগর পরিকল্পনা ও সরকারি অব্যবস্থাপনাকে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জানা যায়, ডেঙ্গু নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে সরকার মশক নিধনের জন্য ওষুধ স্প্রে করার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কিন্তু নিম্নমানের ওষুধের জন্য এ কর্মসূচিও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশের এহেন পরিস্থিতি দেখে বহু প্রবাসী বাংলাদেশি স্বদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। আনন্দ করতে গিয়ে শেষমেশ না প্রাণটাই বিসর্জন দিতে হয় সে কারণে! গত বছর সেপ্টেম্বরে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক জরিপে বিশ্বে বসবাসযোগ্য শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৮তম। ঢাকার চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে নাইজেরিয়ার লাগোস ও যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক নগর। বাংলাদেশের বহু মন্ত্রী, মেয়র এবং রাজনীতিবিদ দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যে উন্নয়ন নাগরিকদের জীবনমান ও বাসোপযোগী শহর উপহার দেয় না, সেটা কিসের উন্নয়ন?

পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মানুষের আচরণের কারণে এডিস মশা নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়েছে। বদলে গেছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার গতিপ্রকৃতি। এ মশা শুধু দিনেই নয়, রাতেও কামড়ায়। রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কম। তবে মশার পরিবর্তিত আচরণ জেনে যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করা যায়, তাহলে এটিকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় মানুষজন ক্ষুব্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বেগ প্রকাশ সত্ত্বেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা সাধারণ জনগণ, পৌর ও নগরবাসী কিছুতেই মানতে পারছেন না। তবে করোনার মতো বিশ্বব্যাপী মহামারিকে আজকের বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের সময়ে ডেঙ্গু দমনে ব্যর্থতা কারও পক্ষেই সহজভাবে মেনে নেওয়ার কথা নয়।

ডেঙ্গু অপরিচিত কিংবা নতুন কোনো রোগ নয়। প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্বে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। কোথায়, কোন সময় এডিস মশা জন্ম নেয়, তা সবারই জানা। তা সত্ত্বেও কেন এই ব্যর্থতা? সে প্রশ্নই সবার? এটা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা, নাকি কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাব? এ কথাও ঠিক, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু সরকারের ওপর দিয়ে নাগরিক সমাজ নির্বিকার থাকলে হবে না। সকলকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু কার কখন হবে তা কেউ বলতে পারবে না। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবার সতর্কতা, তৎপরতা আবশ্যক। নইলে বিজ্ঞানের যুগে মানুষকে এডিস মশার কাছে হার মানতে হবে।

লেখক : গবেষক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক।

কমেন্ট বক্স