দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অতি সক্রিয়তার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বিএনপিসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর কাছে রীতিমতো ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন হাস। সেই সুবাদে ওই সময়ে দেশের প্রত্যন্ত জনপদেও আলোচিত হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর বেশ কিছুদিনের নীরবতা। এরই মধ্যে অবশ্য পেশাদার কূটনীতিক জীবনেরও টেনেছেন সমাপ্তি।
তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আবারও আলোচনায় এসেছে পিটারের নাম। এর মধ্যেই ঢাকায় এসেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি ওই দেশের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির কৌশলগত উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। সেই পরিচয়েই গত ৩০ আগস্ট শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার পর এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ইকে-৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। পরদিন রোববার দুপুরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকও করেন। পরে রাতে রাজধানীর গুলশানে ব্রিও ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট নামে একটি রেস্তোরাঁয় এক নৈশভোজে অংশ নেন, যাতে ছিলেন আরও চার বিদেশি। বহুল আলোচিত এই মার্কিন কূটনীতিক এমন সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন, যখন আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। গত দুই মাসে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জানতে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ে ২০টিরও বেশি বৈঠক হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, পিটার হাসের এবারের ঢাকা সফরে পূর্ব বন্ধুত্বের সূত্রে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে দোহা হয়ে ওয়াশিংটনের পথে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে তার।
রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপট এবং নতুন পরিচয়ে পিটার হাসের বাংলাদেশে ফিরে আসা- এ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সংশ্লেষ রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মনে প্রশ্ন, তিনি কি সত্যিই অবসর নিয়েছেন, নাকি অন্য পরিচয়ে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন? গত বছর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘ইনক্লুসিভ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেওয়া নিয়ে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনায় বসেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন পিটার হাস। জোরপূর্বক গুম নিয়েও তার অবস্থান স্পষ্ট ছিল। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনি নিয়মিত আলোচনা করতেন। যদিও নির্বাচন শেষে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন তিনি। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুই বছর চার মাস দায়িত্ব পালন শেষে গত বছরের ২২ জুলাই মধ্যরাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান বহুল আলোচিত পিটার হাস।
বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরই নতুন দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসেন পিটার হাস। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকটি অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। যদিও ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের দাবি, পিটার হাস এখন আর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কেউ নন, তাই তার সঙ্গে দূতাবাসের কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তার পূর্বের রাজনৈতিক তৎপরতা এবং এখনো নানা সময়ে বাংলাদেশে অবস্থান আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকের মতে, ফরেন সার্ভিসের দায়িত্ব ছেড়ে আবারও তার ঢাকায় ফিরে আসা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা দৃশ্যমান। গত তিন মাসে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা একাধিক রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কমিশন, বিচার বিভাগ এবং উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক শুধু সৌজন্য নয়, বরং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচন এলেই মার্কিনিদের এমন তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এর আগের নির্বাচনগুলোর আগেও এমনটি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আগ্রহ নানা কৌশলগত কারণেই থাকে। গত বছরের জুলাইয়ে পিটার হাস রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব থেকে অবসরে গেলে বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পান ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। ঠিক ১৭ বছর আগে দুই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঢাকায় যাওয়া-আসার মাঝখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কাকতালীয় হলেও ২০০৭ সালের মতো এবারও বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালনের সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব কিছুদিন পালন করবেন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ)। ওই সময় ২০০৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস; কিন্তু ১৪ মাসের মাথায় হঠাৎই মার্কিন প্রশাসন তাকে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। ফলে তিনি বেশ তাড়াহুড়া করেই ঢাকা ছেড়ে যান। ২০০৮ সালের এপ্রিলে জেমস এফ মরিয়ার্টি পরের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে ৯ মাস ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলেছিলেন গীতা পাসি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। এই নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। তার নেতৃত্বে এই বৈঠকগুলোতে নির্বাচনকালীন কাঠামো, মানবাধিকার পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব এবং ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের সম্ভাব্য রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়। তবে এই ধারাবাহিক বৈঠকগুলো শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন তৎপরতা প্রমাণ করে, নির্বাচন ঘিরে দেশটি শুধু নীতিগত অবস্থান নয়, বরং কৌশলগত প্রভাবও নিশ্চিত করতে চায়।