সালেম সুলেরী পয়লা সেপ্টেম্বর ‘বিএনপি’র ৪৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এই দিনে জাতীয়তাবাদী দলের উন্মোচন। বিকেলে ঢাকার রমনা গ্রিনে বসে সাংবাদিক সম্মেলন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নতুন দলের ঘোষণা দেন। এর আগে ১৮ দফা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর পয়লা সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেন ১৮টি নাম। কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ সদস্য ছিলেন তাঁরা।
জিয়ার সেই রাজনৈতিক রানিংমেটরা আজ অধরা। দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শুধু জিয়ার নামটিই মহাআলোচিত। কিন্তু সঙ্গের ১৮ জনের অধিকাংশই অধরা, অনালোচিত। উত্তরসুরীরা তাঁদের স্মরণ করেন না, নামও নেন না। তাঁদের ত্যাগ তীতিক্ষার কথা কেউ শোনে না, শোনায় না। জন্ম বা মৃত্যুতিথিতে হয় না স্মরণসভা বা স্মৃতিতর্পণের আয়োজন। সামরিক শাসন থেকে রাজনীতিতে আসেন জিয়া। উত্তরাধিকার সূত্রে সামরিক শাসন পেয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিব নিহত। আধা সামরিক শাসন দেন নতুন প্রেসিডেন্ট মোশতাক। আবার ৩ নভেম্বর ক্ষমতা নেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করে নিজেই ‘আর্মি চিফ’ হন। ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি নেন। মোশতাকের বদলে প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপ্রধান বানান। সেই সরকারই ৬ নভেম্বর সামরিক শাসন দিয়েছিলো। পরদিন সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে সরকার পাল্টায়।
ক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়া গণতন্ত্রের সন্ধান করেন। সামরিক শাসনকে পত্রপাঠ বিদায় দিতে উদ্যোগী হন। ১৯৭৮-এর ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হয় ‘জাগদল’। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি ছিলেন বিচারপতি সাত্তার। তিনি জিয়া সরকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২৮ আগস্ট বর্ধিত সভা ডেকে ‘জাগদল’ বিলুপ্ত করেন। দুদিন পর জিয়া ‘বিএনপি’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। যদিও সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন ‘জাগদল’কে। সেই বিচারপতি সাত্তার ছিলেন দুর্দিনের কন্ডারী। ১৯৮১-এর ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত। ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। বিএনপিরও হাল ধরেন, চেয়ারম্যান হন। পরে বেগম খালেদা জিয়ার হাতে চেয়ারম্যানশিপ তুলে দেন। এতো ত্যাগ, এতো নিবেদন, কিন্তু নাম নেই। জন্মতিথি, মৃত্যুতিথিতে কাক-পক্ষীও কথা বলে না। সাত্তার-মরিয়ম সম্পতির ঘরে সন্তানাদিও ছিলো না। ফলে পারিবারিকভাবেও তিনি স্মৃতিপ্রদীপের আলোকবর্তিকা নন। রাজনীতিক মশিয়ূর রহমান জাদুমিয়া জাদু দেখিয়েছিলেন। পুরো ভাসানী ন্যাপ দলটিকে বিএনপিতে অধিভুক্ত করেন। মওলানা ভাসানীর সুপ্রিয় মানুষটি স্বীকার করেন সর্বোচ্চ ত্যাগ। দলীয় প্রতীক ‘ধানের শীষ’ উপহার দেন বিএনপিকে। ১৯৭৩-এ প্রতীকটি ভাসানী ন্যাপের ছিলো। টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীও ধানের শীষে নির্বাচন করেন।
জাদু মিয়া ছিলেন বিএনপির সেকেন্ডম্যান। সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সরকারে সিনিয়র মিনিস্টার। প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক দীক্ষাদাতাও ছিলেন। ১৯৮৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ছিলো সংসদ নির্বাচন। ‘ধানের শীষ’ প্রতীককে এনে দেন ‘উইন উইন’ বিজয়। ২৯৮-এর মধ্যে বিএনপি পায় ২০৭ টি আসন। নৌকা মার্কার আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি। আবার আওয়ামী লীগ (মিজান) মই মার্কায় ২টি। জাসদ ৮টি, ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ১টি। আইডিএল বা ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি। নিবন্ধন পেলেও নির্বাচন করতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। বৃহত্তর রংপুরের-ডোমার ডিমলায় এমপি হন জাদু মিয়া। জাতীয় সংসদ নেতা বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু রহস্যজনক অসুস্থতায় প্রয়াত হন ১৯৮৯-এর ৯ মার্চ। না, দল বা সমাজ ওনাকে মনে রাখেনি। স্মৃতির অতল তলে হারিয়ে গিয়েছেন প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ছিলেন ডা. বদরদ্দোজা চৌধুরী। খালেদা জিয়ার শাসনামলে রাষ্ট্রপতি ছিলেন ৭ মাস। প্রয়াণ দিবসে জিয়ার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাননি। শোকবাণীতে জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলেননি। ফলে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা ফুঁসে ওঠে। ফলে বিএনপি ছেড়ে ‘বিকল্পধারা’ গড়েন। কিন্তু বিএনপির কাছে তিনি সতীর্থ নন, ‘মিরজাফর’ ছিলেন। সূচনাপর্বে ছিলেন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। থ্রিপিস-খ্যাত আরেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদিন সরকার। ছিলেন মোহাম্মদউল্লাহ, আব্দুল মোমেন খান, রসরাজ মন্ডল। অর্থনৈতিক খাতের সিংহপুরুষ সাইফুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। চৌকষ আইনজীবী, পল্লীকবির জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। মক্তিযুদ্ধকালীন জিয়া সতীর্থ কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। সম্পাদক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, অধ্যক্ষ হামিদা আলী। বিএনপি প্রশিক্ষণ কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফিরেজে নুন। যুগ্ম-মহাসচিব এসএ বারী এটি। বর্তমান মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওনার পিএস ছিলেন। বিন্তু না, পূর্বতনদের আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের রীতি নেই। শুধু বিস্মৃতির অতলে হারানোর বেদনা আছে। ড. গনি, অধ্যাপক শামসুল হক, ক্যাপ্টেন হালিম, কিংবা তরিকুল ইসলাম, লে. ক. (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, বিনীতা রায়। যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম, বা এরশাদীয় হুদা-মতিন। ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব, ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা।
রাজনীতির বাইরেও জিয়ার প্রিয় অসংখ্য মুখ। জাসাস-এর প্রথম পূর্ণাঙ্গ সভাপতি কবি আল মাহমুদ। প্রেস সচিব অভিনেতা-আবৃত্তিকার কাফি খান। দৈনিক দেশ সম্পাদক সানাউল্লাহ নূরী। প্রেসক্লাব সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী। বিএফইউজে সভাপতি রিয়াজউদ্দিন আহমদ। চলচ্চিত্রের শফি বিক্রমপুরী, আমজাদ হোসেন। ‘যদি কিছু মনে না করেন’-খ্যাত ফজলে লোহানী।
বিএনপির দলীয় সঙ্গীত ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’। গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির কিংবা শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। না, বিএনপির কোন আমলেই তিনি সম্মানিত হননি। এক বুক বেদনা নিয়ে পৃথিবীর পাট চুকিয়েছেন। জিয়ার পছন্দের গান- ‘আবার জমবে মেলা, হাটখোলা, রথখোলা’। না, গীতিকার-সুরকার লোকমান হোসেন ফকিরও বিস্মৃতির অতলে। জিয়ার রানিংমেটদের স্মৃতিতর্পণের কোনো উদ্যোগ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা ফজলু দলের দায় না সম্পদ?
বিএনপিকে বিড়ম্বনায় ফেলেছেন মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে আসীন তিনি। সত্তর-আশির দশকে ‘রূপবান বক্তা’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ছাত্রলীগের-সম্পাদক ছিলেন মুজিবহত্যা পরবর্তীকালে। পরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দলে সম্পাদক। ‘গামছা প্রতীক’ ছেড়ে ২০০৬-এ ‘ধানের শীষে’। ৫ আগস্টের ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানকে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর অপমান ঠেকাতে সোচ্চার এই মুক্তিযোদ্ধা। লাগাম ছেড়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে দ্বিপক্ষীয় বিপদ ডেকেছেন।
অ্যাডভোকেট ফজলু বলেছেন, তিনি মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা। ৫ আগস্টের আন্দোলনকারীদের সবাই জামায়াত-শিবির। তাদের প্রায় সব নেতাই অভিনেতা। এমন বক্তব্যে সর্বমহল এখন বিক্ষুব্ধ। সেগুনবাগিচার বাসার সামনে প্রতিবাদী তরুণদের ঢল। মাইক লাগিয়ে অশ্লীল ভাষায় চলছে গালি-গালাজ। বলা হচ্ছে ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা’ ও ভারতের দালাল মুজিববাহিনীকে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুও বলা হচ্ছে। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের শত্রু ছিলো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে হত্যার চেষ্টাও চালিয়েছিলো। তরুণরা বলছে, ‘ফজু পাগলা’ বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা। ৫ আগস্টের সার্বজনীন আবেগকে অপমান করেছে। এজন্য ওনাকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। বিএনপি প্রধান কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলো। ফজলু- দলের জন্যে দায় না সম্পদ, প্রশ্ন ওঠে। অবশেষে তিন মাসের জন্যে সদস্যপদ সাসপেন্ড করা হয়েছে। বিএনপির এই শাস্তি এনসিপিপন্থীরা মানবে কি-না, জানা যায়নি।
ব্যাচেলর-বাহাস ►রুমিন ফারহানা বনাম হাসনাত আব্দুল্লাহ
বিএনপি-ব্যাচেলর ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। আক্রমণ করেছেন এনসিপি ব্যাচেলর হাসনাত আব্দুল্লাহকে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত। নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়ায় শুনানি চলছিলো। সেক্ষেত্রে রুমিন ফারহানার প্রতিপক্ষ আক্রান্ত হন। তিনি আবার এনসিপির সাথে সম্পৃক্ত। দক্ষিণ-এর সমন্বয়ক আক্রান্ত হওয়ায় বাধে বিরোধ। হাসনাত আব্দুল্লাহ রুমিন ফারহানার বিরুদ্ধে তৎপরতা চালায়। বলে, শেখ হাসিনার পতনে রুমিন বেশি কষ্ট পেয়েছে। তিনি বিএনপির ‘আওয়ামী লীগ বিষয়ক সম্পাদক’।
জবাবে রুমিন ফারহানা দমে যাননি। বলেন, আমি একটি ডাকাতের মতো চেহারার ছেলেকে দেখলাম। আরও কিছু অশ্লীল শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, উভয়ে উভয়কে ‘ফকিন্নি’ বলেছে। বিষয়টির সমাধনে উভয় পক্ষের সমঝোতামূলক পদক্ষেপ চায় সর্বসাধারণ।