৩৬ জুলাই আন্দোলনের সৃজনশীলতা নানামুখী ও নানামাত্রিক। আন্দোলন পরিকল্পনা ও পরিচালনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দিকনির্দেশনা, রূপান্তর ও বাস্তবায়ন ইত্যাদির মধ্যে যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও মুনশিয়ানার দিক রয়েছে। একটি ভুল পদক্ষেপ বা পদস্খলন আন্দোলনে বিপর্যয় ঘটাতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। কারণ এর কতকগুলো কুশলী দিক আছে, যা আন্দোলনকে সর্বদা সজীব, সতেজ ও গতিশীল রেখেছে; থিতু হতে দেয়নি। আর আছে সময়োপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রতিপালন।
আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান কৌশলগত দিক হলো নেতৃত্বের ‘প্লুরালিটি’ বা বহুত্ব। ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরিচালনায় কোনো একক নেতৃত্ব ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক নেতৃত্বে ছিলেন ছয়জন সমন্বয়ক। এ ছাড়া সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক ছিলেন অনেক। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিজস্ব সমন্বয়ক-সহসমন্বয়ক ছিলেন। তারা কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। দুই দফায় দুটি তালিকাও প্রকাশিত হয়। ৮ জুলাই প্রকাশিত তালিকায় সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়কের সংখ্যা ছিল ৬৫। ৩ আগস্ট প্রকাশিত তালিকায় সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৫৮। তালিকায় ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও ছিলেন। এই বহুত্বের ভাবনা থেকে তারা নেতানেত্রী (লিডার) শব্দের পরিবর্তে সমন্বয়ক (কো-অর্ডিনেটর) শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে ও সংহতি রক্ষা করে চলবেন। অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম নেতৃত্বের বহুত্ব ও সমন্বয়ক নামকরণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘আন্দোলনের কৌশলগত দিক ছিল একক নেতৃত্ব না রাখা এবং পরিচিত কাউকে সামনে না আনা। আমি যেহেতু পরিচিত ছিলাম না, তাই সামনে ছিলাম। প্রতিদিনই গান-কবিতা হচ্ছে, অপরিচিতদের দেখে সবাই যুক্ত হচ্ছে। কেউ বুঝতে পারেনি, এখানে নেতৃত্বটা দিচ্ছে কে। ... মানুষ মুক্তি খুঁজছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সেই মুক্তি ঘটেছে।’ (প্রথম আলো, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা, ৪-১১-২৪)। তাদের পরিকল্পনা ও ভাবনা বিফলে যায়নি। ছয় সমন্বয়ক যখন ডিবি কার্যালয়ে ছয় দিন ধরে বন্দী, তখনো নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি, আন্দোলনও থেমে যায়নি। ৩০ জুলাই গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, গুম-খুন, হামলা-মামলার প্রতিবাদে ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সমন্বয়ক আবদুল কাদের দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেন। ৩১ জুলাই সরকারের ক্রমাগত অত্যাচার ও ছাত্রসমাজের নয় দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন সহসমন্বয়ক রিফাত রশীদ।
দ্বিতীয় কৌশলগত দিক হলো অহিংসা ও অরাজনৈতিকতা। কোনো রাজনৈতিক ‘কালার’ বা রং না নিয়ে অহিংস অরাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন তারা। ১৫ জুলাই পর্যন্ত এ ধারা বহাল ও অক্ষুণ্ন ছিল। ওইদিন সরকার-সমর্থিত ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডার বাহিনী ও পুলিশ-র্যাব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল ও ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মারপিট ও জখম করে যে তাণ্ডবলীলা চালায়, তাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আর অরাজনৈতিক চরিত্র ধরে রাখতে পারেননি। দেখা গেল, ১৭ জুলাই কতক সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জনগণও যুক্ত হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও বামপন্থী রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা বেড়েছে। আন্দোলনের স্বার্থে তারা বাধা দেননি বা অস্বীকারও করেননি। অথচ এর আগে তারা সভা-সমাবেশে দলীয় রাজনীতি হতে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করেন। এর কৌশলগত দিকটি হলো নিজেরা রাজনীতিমুক্ত হলে অন্যদের আন্দোলনে যুক্ত করা সহজ হবে। তাদের এরূপ পরিকল্পনা বিফলে যায়নি, সার্থক হয়েছে। রাজনীতিমুক্ত থাকার দাবিটা ছিল স্রেফ ‘বর্ণচোরা’ রূপ। বাস্তবতা এই যে, তারা নিজেরা রাজনীতি থেকে কখনো মুক্ত ছিলেন না। এ যুগের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্ররা রাজনীতি করেন না, তা সত্য নয়। সত্য গোপন করে তারা কিছুটা ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সমন্বয়ক আবু তাহের মজুমদার স্মৃতিচারণা করে বলেন, “৯ জুন রাতেই রিফাত রশীদ ও হাসিবুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা করি। সে রাতে যেসব পয়েন্ট মাথায় নিয়ে আমাদের ‘আর্ট অব মুভমেন্ট’ সাজিয়েছিলাম, সেই পয়েন্টেই পরে আন্দোলন জোরদার হয়। এ সময় ফেসবুক গ্রুপ ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে থাকি। ঢাকার বাইরে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পাঁচ-সাতজনের একটি দল গঠন করা হয়েছিল। ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের যতগুলো স্থানে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই যুক্ত ছিলাম। ... মূলত মাঠের রাজনীতিতে মানুষকে সংগঠিত করা এবং এর কৌশলের জায়গায় বেশি কাজ করতে হয়েছে আমাকে। এ ক্ষেত্রে সান জু’র লেখা বই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ (রণকৌশল) মাঠের রাজনীতিতে কৌশল সাজাতে বেশ সাহায্য করেছে। আমি ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ায় বাংলাদেশের ভূগোল নিয়ে বোঝাপড়া, পাশাপাশি সান জু’র কিছু ধারণা-কৌশল এবং মাঠের বাস্তবতাÑসব একসঙ্গে করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। বাংলা ব্লকেডের সময় কোন কোন স্থানে ব্লকেড হবে, ঠিক করতাম। পয়েন্টগুলো এমনভাবে নির্বাচন করা হতো, যাতে সর্বোচ্চ ফলাফল আসে। আন্দোলনের পয়েন্টগুলো আগে থেকেই ফেসবুক ও গণমাধ্যমে জানিয়ে দিতাম।” (প্রথম আলো, ৪-১১-২৪)।
সান জু (Sun Tzu) ছিলেন প্রাচীনকালের চীনের একজন সামরিক জেনারেল। তার লেখা গ্রন্থখানি অনূদিত হয়ে বিশ্বের বহু দেশে প্রচলিত আছে। মাহফুজ আলম বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করেন (২০১৭)। রণকৌশল সম্বন্ধে সান জু বলেন, শুধু সৈন্যের মধ্যে লড়াইয়ে শক্তিপ্রয়োগ নয়, অন্য অনেক বিষয় রয়েছে। তিনি নৈতিকতা, পাণ্ডিত্য এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন উপাদানকে শারীরিক যুদ্ধের চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ... তিনি যুদ্ধকে শুধু হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করতে চান না; বরং একেবারে অক্ষত না হলেই নয় এমন ক্ষতি করে জয়ী হওয়াকে যথাযথ কৌশল বলে মনে করেন। (দ্য আর্ট অব ওয়ার, ইন্টারনেট)। আবু তাহের মজুমদার যে ‘আন্দোলন কৌশলে’র কথা বলেছেন, তাতে সান জু’র এই নীতির অনুসরণ রয়েছে বলে অনুমিত হয়।
তৃতীয় কৌশলটি ছিল উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ‘কর্মসূচি’ প্রণয়ন, ঘোষণা ও প্রতিপালন। আন্দোলন চলাকালে কেন্দ্রীয়ভাবে এক এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে এবং পরের দিন/দিনগুলোতে তা প্রতিপালিত হয়েছে। ৩৬ দিনের লাগাতার আন্দোলনে এরূপ মোট কয়টি কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে? পরিসংখ্যান নিয়ে আমরা ১১টি কর্মসূচির নাম জানতে পেরেছি। কর্মসূচির নামগুলো তাক লাগানোর মতো অভিনব ও চমকপ্রদ। পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তারিখসহ নামগুলো উল্লেখ করা হলো :
১. জুলাই ১-৬, মিছিল ও সমাবেশ : প্রথমে সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে কোটা বাতিলের এবং পরে কোটাপদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে এরূপ কর্মসূচি পালিত হয়।
২. জুলাই ৭-১১, বাংলা ব্লকেড : মিছিল ও সমাবেশে পুলিশের হামলা ও লাঠিপেটার বিরুদ্ধে ৬ তারিখে ঘোষণা ও ৭-১১ তারিখে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
৩. জুলাই ১২-১৩, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ : পুলিশের ক্রমাগত হামলা ও ধরপাকড়ের প্রতিবাদে ১১ তারিখে এই কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে ১২-১৩ তারিখ পালিত হয়।
৪. জুলাই ১৪, পদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান : আন্দোলনের প্রতি সরকারের উপেক্ষা ও উদাসীনতার প্রতিকার চেয়ে এবং তাদের দাবিদাওয়ার সমাধান চেয়ে মিছিলসহকারে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি পালিত হয়।
৫. জুলাই ১৭, গায়েবানা নামাজ ও কফিন মিছিল : ১৩ তারিখ চীন থেকে ফিরে এসে ১৪ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ভাষার প্রকারান্তরে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে অপমান করলে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৫ তারিখে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদসহ ৬ জন শহীদ হলে তাদের স্মরণে এরূপ কর্মসূচি ঘোষিত ও পালিত হয়। ওইদিনই ‘কমপ্লিট শাটডাউনে’র কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
৬. জুলাই ১৮, কমপ্লিট শাটডাউন : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে (যা তিনি কর্তৃপক্ষকে ফোনে জানান বলে পরবর্তীকালে জানা গেছে) পুলিশ গুলি চালালে অধিক হারে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নিহত হলে তার প্রতিবাদে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
৭. জুলাই ৩০, মার্চ ফর জাস্টিস : এই দিন ছয় সমন্বয়ক ডিবি আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকা হাইকোর্টে আন্দোলনকারীরা জড়ো হন।
৮. আগস্ট ১, রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ : ৩১ জুলাই সহসমন্বয়ক রিফাত রশীদ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশে ছাত্রহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলার প্রতিবাদ এবং ছাত্রসমাজের নয় দফা দাবি আদায়ে ওই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, নির্যাতনের ভয়ংকর দিন-রাতের স্মৃতিচারণ, নিহত ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীদের স্মৃতিচারণ এবং আন্দোলন ঘিরে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিত্রাঙ্কন, দেয়াললিখন, ফেস্টুন তৈরি ইত্যাদির মাধ্যমে এ কর্মসূচি পালন করতে হবে।
৯. আগস্ট ২, গণমিছিল/দ্রোহযাত্রা : সর্বস্তরের মানুষ এক দফা দাবিতে গণমিছিল করে এসে শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন। এটি দ্রোহযাত্রা নামেও পরিচিত।
১০. আগস্ট ৩, সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ দাবি করে এরূপ কর্মসূচি পালন করা হয়।
১১. আগস্ট ৫, মার্চ টু ঢাকা : সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ৬ তারিখে সারা দেশ থেকে এসে ঢাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার আহ্বান ছিল। কিন্তু ঘোষণা পাল্টিয়ে এক দিন আগেই তা পালিত হয়। ঢাকায় প্রবেশের সব রাস্তা দিয়ে লোকাগমনে জনতার ঢল নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বহু লোক হতাহত হন। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনও নিশ্চিত হয়। তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে বন্ধুদেশ ভারতে পলায়ন করেন।
কর্মসূচিগুলো যেমন ঘটনার প্রেক্ষাপটে খুবই উপযোগী, তেমনি সবার নজর কাড়ার মতো আকর্ষণীয় ছিল। নিঃসন্দেহে এগুলো সমন্বয়কদের সুচিন্তার ফসল, উর্বর মস্তিষ্কের পরিচায়কবাহী। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য কী ছিল? প্রথম সারির প্রথম নায়ক নাহিদ ইসলাম স্মৃতিচারণা করে বলেন, “আন্দোলনে সব সময় ভিন্ন ধরনের নামে কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা।
হরতাল-অবরোধ-এসব খুব প্রচলিত। মানুষ জানে এখানে কী হয়-একটা বাধা আসে, পুলিশ বা ছাত্রলীগ হামলা করে। তাই আমরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নাম দিলাম এই চিন্তা করে যে শহুরে মধ্যবিত্ত এখানে যুক্ত হোক। আবার জেন-জি প্রজন্মও যেন যুক্ত হয়, তা-ও আমাদের লক্ষ্য ছিল। এই ভিন্নধর্মী কর্মসূচির প্রভাব কিন্তু আন্দোলনে বেশ ভালোভাবেই পড়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন যখন দমনের চেষ্টা হলো, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। আবার দোয়া-মোনাজাত, গায়েবানা নামাজÑএ ধরনের কর্মসূচিও ছিল আমাদের। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতে সংযুক্ত হয়েছেন। আদতে আমরা ডান-বাম, শহর-গ্রামসহ নানান মতাদর্শের মানুষ যেন একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে, এমন এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল মধ্যপন্থী। বামপন্থী-ইসলামি-বিএনপিপন্থীÑসবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।” (প্রথম আলো, ৪-১১-২৪)
এটা একদিক, এর অপর দিক হলো সরকার পক্ষকে ধোঁকা দেওয়া, ধাঁধায় ফেলা। শেষের দিকে কর্মসূচির মুহুর্মুহু পরিবর্তন এনে তারা এক রহস্যজাল তৈরি করেছেন। শেষের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির তারিখ ছিল ৬ আগস্ট। ‘শুভস্য শীঘ্রং’Ñভালো কাজে দেরি করা চলে না। সিরাজ যুদ্ধে বিরতি দিয়ে ভুল করেছিলেন, তিনি জীবন দিয়ে তার খেসারত দিয়েছেন। আন্দোলনে জোয়ার এসেছে, তার ‘ভাও’ বুঝে ছাত্ররা এক দিন আগেই তা পালন করেন। তারা সরকারকে স্থির থাকতে দেননি। ওইদিনই বাস্তিল দুর্গের মতো গণভবন ধসে পড়ে। এই তৎপরতা ও গতিশীলতা ছিল আন্দোলন সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
এমনকি ব্যানারের নামকরণ নিয়েও তারা ভেবেছেন এবং আন্দোলনের যথার্থ স্পিরিট ধারণ করে সময়োপযোগী ব্যানার তৈরি করেছেন। ১ জুলাই যে ব্যানার নিয়ে তারা মিছিল করেন, তাতে তিন সারিতে লেখা ছিল, ‘২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ/ সকাল ১১টা, তারিখ ০১ জুলাই ২০২৪/ স্থান রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’ দু-তিন দিন পরে ‘কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন’ শিরোনামও দেখা যায়। ৫ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং অল্প পরে জনতা যুক্ত হলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন’ গৃহীত হয়, যা বাকি দিনগুলোতে অব্যাহত ছিল। ব্যানারে এরূপ নামকরণ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, “১ জুলাই আন্দোলন শুরু হলেও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে যাত্রা শুরু হয় ৫ তারিখ। ফেসবুক গ্রুপে নাম আহ্বান করলে এই নামের পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। আর এমন নাম দেওয়ার কারণ হলো, কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের আন্দোলনটা ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গা থেকে। ফলে এমন একটা নাম আমরা দিতে চেয়েছি, যাতে নামের মধ্যেই একটা নীতি প্রতিফলিত হয়। শুধু চাকরি নয়, এ আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিতাড়ন, ভালো আমলাতন্ত্রÑএসবও যুক্ত করতে চেয়েছিলাম। মাঠে শুধু বৈষম্যবিরোধীটাই টিকে গেছে।”
আমরা ১ আগস্টের ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ (আমাদের বীরদের স্মরণ) কর্মসূচির কথা আলোচনা করব। একদিকে গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, হয়রানি চলছে; অপরদিকে সরকার লোকদেখানো ‘রাষ্ট্রীয় শোক’ পালন করছে। ছয় সমন্বয়ক ডিবি কার্যালয়ে আটক, তখনো মুক্তি পাননি। যেকোনো শোক পালন অনুষ্ঠানে কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অন্য নেতাকর্মী ও সমর্থকগণ সেদিন সরকারের এই কর্মসূচির প্রতিবাদে এর বিপরীতে ‘মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে’ ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচারের কর্মসূচি পালন করেন। তারা আগের দিন ৩১ জুলাই এই কর্মসূচি ঘোষণা করে রাত থেকেই ফেসবুকের প্রোফাইলে লাল রঙের ব্যবহার শুরু করেন। অভিনব এই কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কর্মসূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বের করেন। ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেন শিক্ষকেরা। বস্তুত গতানুগতিক পদ্ধতিতে নয়, শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকে নতুন রূপ-রস-আঙ্গিকে সাজিয়ে জনতার কাছে উপস্থাপন করেছেন। আর এখানেই নিহিত আছে তাদের সৃষ্টিশীল মন ও কুশলী চিত্তের পরিচয়। [চলবে]


ওয়াকিল আহমদ


