মফিজুল হুসাইন
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অলিখিতভাবে বিপরীতমুখী। ভারত তাদের দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত মিত্র আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে বা দেখতে চায়, তবে সরাসরি আমেরিকার পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে চায় না। পক্ষান্তরে, আমেরিকা বর্তমান সরকারকে একটি বৈধ পন্থায় ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়, তবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কিছুটা সম্মান দিতে কৌশলগত বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য করলেও দলটির বিশেষ কোনো ক্ষতি যেন না হয় বা বিরোধীরা ক্ষমতা পেলে কোনো প্রতিহিংসার ঘটনা যেন না ঘটে, সেদিকে নজর রাখবে।
তারা চাইলে বাংলাদেশের রফতানি বা অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা বা শুল্ক আরোপ করে এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে ফেলে দিতে পারে, কিন্তু তা না করে কৌশলগত প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। একের পর এক কূটনৈতিক তৎপরতা, একটি এলিট নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা, ভিসানীতি, দুর্নীতির প্রতি কড়া নজর ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দৃঢ়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই সুদূরপ্রসারী। যেমন এলিট ফোর্স র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভীতির সংস্কৃতি দূর করে দিয়েছে; যার ফলে বিরোধীরা মাঠে নামার সাহস দেখিয়েছে।
ভিসানীতি দিয়ে উচ্চশ্রেণির আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ নির্বাচন ইঞ্জিনিয়ারিং করার সকল কুশীলবকে ম্যানেজ করা হয়েছে, যাতে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অতি শিগগিরই দুর্নীতি বা মানি লন্ডারিংয়ের অজুহাতে সরকারের অর্থ জোগানদাতা ব্যবসায়ীদের নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনে আওয়ামী লীগের অর্থের জোগান বন্ধ করা হবে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট ওয়াচের কড়া বিবৃতি দেওয়ায় মনে করার কারণ রয়েছে যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি এমন কিছু আরোপ করা হবে, যাতে বিরোধীরা নির্বিঘ্নে আন্দোলন জমাতে পারে। আর ভারতের আগ্রহের বিষয়টাকে আমেরিকা দুভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, (১) বিরোধী দল বা যারা জয়লাভ করবে, তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হবে যেন পোস্ট নির্বাচনে কোনো প্রকার সহিংসতা না ঘটে। (২) তৃতীয় কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় এনে একটা কুলিং সময় অর্থাৎ শান্ত পরিবেশ বজায় রেখে পরবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।
ইতিহাস বনাম রাজনৈতিক সংস্কৃতি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই জঘন্য পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে ইতিহাসকে তার জায়গায় থাকতে দিচ্ছে না। ইতিহাস সেটাই, যা সত্যিকার অর্থেই ঘটেছে কিন্তু সেই ইতিহাস তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এসে সত্যি ইতিহাসকে নানা ধরনের বিশেষণ দিয়ে বিকৃত করে দিচ্ছে। বর্তমানে দুটি বিশেষণ বেশ জনপ্রিয়। একটি হচ্ছে ‘বাকশালি’ প্রপাগান্ডা এবং অপরটি ‘বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের’ প্রপাগান্ডা। যেমন কেউ যখন বলে ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিয়াউর রহমান জানতেন এবং তিনি দায়িত্বশীল পদে থেকে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিয়ে অন্যায় করেছেন। তিনি ক্ষমতা নিয়ে ওই খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তিনি নিজেও জড়িত। তাহলেই ওই ব্যক্তি হবেন বাকশালি। আবার কেউ যদি বলে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য গুম, খুন, নির্বাচনী, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে, তাহলে তিনি হবেন বিএনপি-জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী। এই ইতিহাস বিকৃতি যে নিম্ন বা মাঠপর্যায়ের তর্ক-বিতর্কে ঘটে তা নয়, জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা, প্রথিতযশা দলীয় বুদ্ধিজীবী, একাডেমিশিয়ান এবং সাংবাদিকেরা জাতীয় টিভির পর্দায় বা সভা-সেমিনারে নির্লজ্জের মতো অহরহ বলে যাচ্ছেন। এটা তো হলো দুটি উদাহরণ। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম কখনোই সত্যিকারের ইতিহাস জানতে পারবে না। এই অসুস্থতা কীভাবে নিবারণ হবে কেউ জানে না। তবে আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক চর্চা, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ না করা, একে অপরের প্রতি সহনশীলতায় হয়তো মুক্তি আসতে পারে। আশার কথা, মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ছেলে সোহেল তাজ ইতিহাসকে যথাস্থানে রাখার জন্য কিছুটা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে তার প্রয়াস সর্বজনীন নাকি শুধু তার বাবার স্থান পুনস্থাপন, সেটা পরিষ্কার নয়।
শেখ সেলিম বনাম হাসানুল হক ইনু
শেখ সেলিম আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে এবং শেখ মণির ছোট ভাই। তিনি বিভিন্ন সময় গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে খবরের শিরোনাম হন। হাসানুল হক ইনু বহু খণ্ডে বিভক্ত জাসদ একাংশের সভাপতি, যিনি স্বাধীনতার পর গণবাহিনী গঠন করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে প্রায় অস্থির রেখেছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা রেখে সামরিক ট্যাংকের ওপর নেচেছিলেন। শেখ সেলিম বিভিন্ন সময় এই ইনুর বিরুদ্ধে সেসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, যা এখন ক্লিসে (যা বারবার বলায় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে) হয়ে গেছে। অবশ্য তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যায় আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদও জড়িতÑএ ধরনের বক্তব্য দিতেন। শেখ সেলিমের বক্তব্যের জবাবে হাসানুল হক ইনু তার প্রেস সেক্রেটারির মাধ্যমে জানতে চান, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ সেলিম ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসে কী করছিলেন! জনাব শেখ সেলিম এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।
তবে সম্প্রতি তিনি ইনুর সঙ্গে আরও এমন কিছু তথ্য যোগ করে যুবলীগের একটি সভায় বক্তব্য রাখেন, যাতে অনেকে বিস্মিত হয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি ঐতিহাসিক ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের কে ফোর্সের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত বলে দাবি করেন এবং তার মেয়েকে গত জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত কোটায় সংসদ সদস্য করায় সমালোচনা করেন। তিনি আরও দাবি করেন, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক রয়েছে, যিনি বা যারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারে এবং তার কাছে প্রমাণও আছে বলে দাবি করে বলেন, এসব প্রকাশ করলে তিনি নিজেই মারা পড়বেন। শেখ সেলিমের কাছে যদি সত্যিই শেখ হাসিনার জীবননাশের কোনো প্রমাণ থাকে, সেটা তিনি শেখ হাসিনার নিরাপত্তাপ্রধান বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গোপনে জানাতে পারতেন। প্রকাশ্যে বলে সেই বিশ্বাসঘাতকদের (?) সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিলেন কেন? আর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত, সেটা আজ পর্যন্ত কোনো গবেষক/লেখকের কাছ থেকে শোনা যায়নি। তবে খালেদ মোশাররফ আগস্ট হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী ফারুকের মামা হন এবং তারা মাঝেমধ্যে দেশের আর্থসামাজিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। সে রকম আলোচনা তো মন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামান বা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গেও মেজর ডালিমের হতো। তাহলে তো তারাও জড়িত হওয়ার কথা। আসলে শেখ সেলিম কিছুটা হতাশা থেকে মাঝেমধ্যে এ রকম কথা বলেন। তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা তাকে কেবিনেটে স্থান দিচ্ছেন না।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কান্না বনাম আওয়ামী লীগ
খুব ইন্টারেস্টিং চরিত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সম্প্রতি একটি অনলাইন পোর্টালে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে কেঁদেই ফেলেছেন। কান্নার পরপরই আবার হেসে ফেলেন। তার এই হাসিকান্নার রহস্য ভেদ করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তিনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সম্পাদিত ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাককে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ-বিরোধী প্রপাগান্ডায় ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রংপুরের সেই বাসন্তীর মাছ ধরার জাল পেঁচিয়ে লজ্জা ঢাকার ছবি তার ইত্তেফাকেই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর তিনি স্বনামে সেই হত্যাকাণ্ডের যৌক্তিকতা দেখিয়ে ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় লেখেন। তারপর এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রতাপের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব করেন। এরশাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দুই বছরের মাথায় এরশাদকে ত্যাগ করে নিজস্ব জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
২০০৭ সালের ১/১১ সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলে তিনি পালিয়ে আমেরিকায় চলে আসেন। পরে দেশে ফিরে হাওয়া বুঝে শেখ হাসিনার মহাজোটে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্বের স্বাদ নেন। অতি সম্প্রতি তার নির্বাচনী এলাকা ভান্ডারিয়ার একটি পৌরসভা নির্বাচনে তার চাচাতো ভাই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান। সেখানে তিনি এরশাদের আমল থেকে অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করে কিংবদন্তিরূপে পরিণত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজে সরাসরি নির্বাচনী তদারকি করার পরও হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না। ৭৫ বছরের পুরোনো আওয়ামী লীগও দেখল, মঞ্জু সাহেবের বেলা শেষ, সুতরাং সে স্থান দখল নিতে তারা ছাড়বে কেন। আবার মঞ্জু সাহেবও আমেরিকার চাপে আওয়ামী লীগের নড়বড়ে অবস্থা উপলব্ধি করে পরোক্ষভাবে আগের নির্বাচনগুলো নিয়ে একটু টিপ্পনী কাটলেন। একটু কেঁদেকেটে বললেন, দেশটা কোনো নরমাল দেশ নয়, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে দেশ চালাতে ব্যর্থ। তার মানে মঞ্জু-আওয়ামী লীগ প্রেম প্রায় শেষ।
-নিউইয়র্ক